ছোটবেলায় অনেককেই অনেক নামে ডাকা হয়। কাউকে ডাব্বুল, কেউ পাপাই, ট্যাপা, টেপলু, ঢ্যাপা,চকলেট, কাটলেট আরো কতো কতো আদুরে ডাক মুখে ফিরতো অনেকের প্রিয়জনের সেই কথা বলে বা লিখে শেষ করা যাবেনা। আসলে এসব নামে আদর করেই ডাকা হয় শিশুদের। আর একটু বড় হলে ক্ষ্যাপানো হয় এসব নামে ডেকে।

ছোটবেলায় দাদাবাড়ির সবাই আমাকে বাবু বলে ডাকতো। আমার ফুফু আর চাচা এখনো সে নামেই ডাকেন। আব্বা তাদের একান্নবর্তী পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর প্রথম সন্তান ছেলে হওয়ায় পরিবারে আনন্দের রোল পড়ে যায়। বাবুসোনা, বাবুই এসব আদুরে নামে ডাকতে ডাকতে আমার নাম এখনো সবার মুখে বাবু- ই রয়ে গিয়েছে। দাদাবাড়ির আশেপাশের পাড়াপড়শি সবাই আমাকে বাবু বলেই ডাকে।

আমার তৌহিদ নামটি রেখেছেন আম্মার নানা মানে আমার বড় আব্বা। তিনি তার সময়ে এলাকার একজন প্রসিদ্ধ আলেম ছিলেন যিনি হজ্জ্ব করেছিলেন পায়ে হেঁটে। কারন জাহাজে যাওয়ার জন্য তাকে রংপুর থেক্র চট্টগ্রাম বন্দরে যেতে হতো। তিনি বুড়িমারী সীমান্ত দিয়ে ভারত হয়ে পাকিস্তান, আফগানিস্তান হয়ে সৌদি আরব পৌঁছেছিলেন পায়ে হেঁটে চার মাসে। আম্মা তাকে এমন একটা ইসলামিক নাম দিতে বললেন যে নাম এলাকার আর কারও সন্তানের নেই। বড় আব্বা নাম রাখলেন তৌহিদ।

আমার নাম তৌহিদ রাখার পরে আম্মা তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন- নানা, আপনার নাতির এত সুন্দর নাম রাখলেন অনুমতি দিন ওকে মাদ্রাসায় আরবী লাইনে পড়াবো। বড় আব্বা আম্মাকে সরাসরি নিষেধ করেননি। শুধু বলেছিলেন - মা রে, তোর ছেলে যখন বড় হবে তখন এমন দিনজামানা আসবে যে কেউ আর গোড়ালির উপরে প্যান্ট পড়তে চাইবেনা। দাঁড়ি রাখা হুজুরদের আনস্মার্ট বলা হবে, মাদ্রাসা শিক্ষাকে অবহেলা করা হবে, চাকরিবাকরিতে দাঁড়িওয়ালা মানুষ পিছিয়ে পড়বে। তাই ওকে জেনারেল লাইনেই পড়াইয়ো। তিনি অত্যন্ত দূরদর্শী মানুষ ছিলেন সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা।

একটু বড় হলে আমার অন্য এক নানার বাড়ির খালা মামারা অনেকেই আমাকে তমাল নামে ডাকা শুরু করেন। আম্মা ভাবলেন যাক তৌহিদ আসল নাম আর ডাকনাম তমাল থাকুক। আসলে আম্মার এক ফুফা (আমার দুঃসম্পর্কের নানা) এই নামকরণ করেন। হিজল তমাল থেকে এই নাম। চির সতেজ, সবুজ বোঝায় যাকে। তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন আমাকে তমাল বলেই ডাকতেন। এরপরে আমার এলাকায় তার স্ত্রী অর্থাৎ আমার নানী'র এক কলিগের সন্তানের নাম রাখা হলো তমাল যার বাসা আমার বাসার পাশেই। আম্মা সেই রাগে দুঃখে সবাইকে বললেন আমাকে যেন তমাল নামে আর ডাকা না হয়। আমার সন্তানের ডাকনাম তমাল তারা জানার পরেও কেন এই নামই রাখতে হবে? দুনিয়ায় কি আর কোন নাম ছিলো না? সেই থেকে আমি আবার সবার মুখে মুখে তৌহিদ নামেই পরিচিতি পেলাম।

আমাকে ডাকা সবচেয়ে মজার নামটি রেখেছিলো আমার স্কুল জীবনের প্রিয় বন্ধুরা। ক্লাস সিক্স কি সেভেনে পড়ি তখন।স্কুলে আমাকে চেয়ারমেন বলে ডাকতো অনেকেই। চেয়ারম্যান থেকে চেয়ারমেন এই আর কি! এরপরে স্যারেরা পর্যন্ত আমাকে চেয়ারমেন নামে ডাকা শুরু করলেন। এর পিছনে একটা ছোট্ট গল্প আছে।

আমার আব্বা একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং রংপুরের অন্যতম দুর্ধর্ষ ও সাহসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত। আমার জন্মের সময় থেকেই তিনি এই এলাকার একজন সৎ ও নামকরা চেয়ারম্যানও ছিলেন। টানা একুশ বছর সফলভাবে তিনি এই দায়িত্ব পালন করেছেন। তার সাফল্যের কথা এখনো মানুষের মুখে মুখে। সে সুবাদে আব্বা আমার স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যও ছিলেন। আমার স্কুলে প্রায়ই যেতেন তিনি। একদিন স্কুলে গিয়ে আমার খোঁজ করলে হেডস্যার দপ্তরিকে ক্লাসে পাঠালেন আমাকে ডেকে আনতে। কিন্তু আমরা ক'জন বন্ধু পিকনিক করবো বলে ঠিক সেদিনই স্কুল থেকে পালিয়েছি। চারিদিকে খোঁজ পড়ল, চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলে কোথায়?

রীতিমত হুলুস্থূল হয়ে তদন্ত করে দেখা গেলো আমরা প্রথম ক্লাসের উপস্থিতি খাতায় রোলকলে ঠিকই উপস্থিত ছিলাম, এরপরে আর কেউই নেই। আমার সাথে আরো চারজনও অনুপস্থিত ছিলো বাকি ক্লাসগুলোতে। আর যায় কোথায়! আব্বা চরম অপ্রস্তুতবোধ করেছিলেন সেদিন হেডস্যারের সামনে নিশ্চিত। এসব কথা মনে হলে আমি আজও লজ্জিত হই। এখনো আব্বাকে স্যরি বলি, যদি তিনি শুনতে পান! সেদিন বাসায় এসে যে পিটুনি খেয়েছি তা সারাজীবনেও ভোলার নয়। তবে স্কুল ফাঁকি দিয়ে যেসব নিষিদ্ধ আনন্দ করেছি (সিগারেট খাওয়া, লেকে উদাম গোসল করা, তাস খেলা) সেটাও মনে রাখার মত।

শাস্তি হিসেবে পরের ক'টাদিন আব্বা আর আমাকে স্কুলে যেতে দেয়নি। কিছুদিন পরে আমার বন্ধুরা আমাদের প্রিয় এক স্যারের হস্তক্ষেপে আব্বাকে বুঝিয়ে আমাকে আবার স্কুলে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করেন। যেদিন স্কুলে গেলাম সেদিন সবাই আমার দিকে চেয়ে মুচকি মুচকি হাসে আর বলে- কিরে চেয়ারমেন কেমন আছিস? আমি অবাকই হলাম এই নামে ডাকছে কেন তারা আমাকে?

ঘটনা যেটা হয়েছিল- পরেরদিন স্যারদের কাছে স্কুল পালানো আমার বাকী সব বন্ধুদের বেদম প্রহারের শিকার হতে হয়েছিল। তারা স্যারের কাছে আব্বার নাম বলে অর্থাৎ চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলের সাথে পালিয়েছি। যে ঘটনার উদ্যোক্তা নাকি আমি! এটা বলে নিজেদের শাস্তি কমিয়েছে। এরপরে স্যারেরাও আমাকে ক্লাসে চেয়ারমেন বলে ডাকা শুরু করে। বন্ধুদের সাথে আজও যখন ফোনে কিংবা সামনাসামনি কথা হয় তারা চেয়ারমেন বলেই ডাকে। আর স্যারেরা? দেখা হলেই বলবে - কিরে চেয়ারমেন! ভালো আছিস বাবা?

সত্যি বলতে কি, আমি এটা উপভোগ করি। তবে শুধুমাত্র আমার সেই চার বন্ধু আর স্যারেরা যখন ডাকেন তখন। অন্য কেউ ডাকলে চরম বিরক্ত লাগে, রাগ ওঠে। এ নামে ডাকার জন্য স্কুলে ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দিয়েছি একজনের তার রেকর্ডও আছে। হবে নাই বা কেন? তারা যে আমার স্কুল জীবনের সেই স্মৃতিময় দিনের প্রথম স্কুল পালানোর সঙ্গী! তাদের মুখে ভালোবাসা মিশ্রিত চেয়ারমেন ডাক, এই আবেগীয় অনুভূতির প্রকাশ অন্যকারও কাছ থেকেতো আসবেনা এটাই স্বাভাবিক।

এর আগে কোনদিন কোথাও কারো সামনে নিজের নাম নিয়ে এমন স্মৃতিচারণা করিনি। ব্লগে প্রিয় ব্লগার ইঞ্জা ভাইয়ের পোষ্টকৃত নাম নিয়ে স্মৃতিকথা লেখার আমন্ত্রণে সোনেলায় এসব না বলা কথা সবার সাথে শেয়ার করতে পেরে ভালো লাগছে। নিজের নাম নিয়ে স্মৃতিকথা লেখার এই উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য ইঞ্জা ভাইসহ ব্লগ কর্তৃপক্ষকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

(ছবি- নিজের এডিটিং)

0 Shares

২৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ