নিছক গল্প-২

সাতকাহন ৪ জুলাই ২০১৩, বৃহস্পতিবার, ০৪:০৪:২০অপরাহ্ন গল্প ২০ মন্তব্য

মজিদ সাহেবের মনোরাজ্যের একটা অংশ বিদ্যাপিপাসু অতীশ দীপংকর এবং অপর অংশটা জীবনানন্দ দাশ শাসন করেন। অতীশ দীপংকরের আছর থাকায় তিনি সারাটাজীবন কঠোর পড়াশুনা করেছেন, সুমনের কলেজের কাছাকাছি উপজেলা সদরে এই বাড়িটা তৈরী করেছেন, সুমনের বড় ভাই ইমন’কে ড-এর সাথে ডট ছিনিয়ে আনার জন্য অষ্ট্রেলিয়া পাঠিয়েছেন। দাশ বাবু অবশ্য মজিদ সাহেবকে দিয়ে এতোটা দৌঁড়-ঝাঁপ করান না। জীবনানন্দ বাবু মজিদ সাহেবের অস্তিত্বে নিগূঢ়, নিবিড়, নিসর্গের ছায়া ফেলে রেখেছেন। মজিদ সাহেব সেই আলো আঁধারের জগতে ছায়া মানুষ হয়ে বিভ্রান্ত পায়ে হেঁটে বেড়ান। জীবনানন্দ পরাবাস্তবতার এক মিটি-মিটি নক্ষত্র-যাঁকে ছুঁয়ে দেখা দুঃসাধ্য ব্যাপার।

এই দুই প্রবণতার পিপাসা মিটিয়ে মজিদ সাহেবকে জীবন যুদ্ধটা করতে হয়। জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে নিয়োগ পাবার পর মজিদ সাহেব আটমাসের মধ্যে ছুটি নিতে পারেননি। তার পদটি একান্নবর্তী পরিবারের গৃহকর্তার মতো। মেথর-ধোঁপার কাজের খোঁজ-খবর রাখা থেকে শুরু করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা-সব কাজই করতে হয়। তিনি কোনো কাজ এড়িয়ে যাওয়া পছন্দ করেন না। বাঙলাদেশের পেন্ডিং মামলাগুলোর নথি একত্রিত করলে রাঙামাটির শুভলং পাহাড়ের রূপ নেবে। এই পাহাড়কে নিষ্পত্তির ঢেউয়ে মিলিয়ে দিতে হলে যে পরিশ্রম করা দরকার মজিদ সাহেব তা করছেন। কোর্টটাকে মোটামুটি গুছিয়ে তিনি চার দিনের ছুটিতে এসেছেন।

মজিদ সাহেবের মানস গঠনটা লাইগার টাইপের। লাইগার হচ্ছে লায়ন এবং টাইগারের মিলনে সৃষ্ট বাচ্চা। এমনিভাবে ঘোড়া প্লাস জেব্রা সমান ঘোব্রা। মজিদ সাহেব যে সপ্তাহে জীবনের প্রথম ফাঁসির আদেশ দিলেন সেই সপ্তাহেই তিনি টিএস এলিয়টের প্রেমের কবিতা সংকলন পড়া শেষ করেছেন। ফাঁসির আদেশ প্রাপ্তদের ফাঁসি কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত তিনি অস্বস্থি বোধ করেন-রাষ্ট্রপতির দয়ার জন্য লাল কাপড়ে মোড়া ফাইলগুলো স্বাক্ষর হয়ে না আসা পর্যন্ত তিনি বিষয়টির খোঁজ খবর রাখেন। মানুষের মনোভূমি যেমনি বিশাল তেমনি বৈচিত্র্যপূর্ণ-এর এক পুরদেশে ফোটে স্বর্গের পারিজাত অন্য অঞ্চলে হয়তো বধ্যভূমি, খুলির পাহাড়, জল্লাদের নৃত্য। একদিকে নদীর ওপারে আকাশের নীলিমায় মিলিয়ে যাবার বিমানবিক অনুভব অন্যদিকে একই আকাশ থেকে বাজ পড়ার মাটি কাঁপানো ভয়ংকর শব্দ। মজিদ সাহেব এই দুই বৈপরীত্যের সাথে ব্যালান্স করার জন্য গ্রামে আসেন এটা নাগরিক মনোবিকার হ্রাসের প্রাকৃতিক দাওয়াই।

মজিদ সাহেবের ছেলেবেলাটা কেটেছে মাদারীপুরের গ্রামের বাড়িতে একটা নিগৃঢ় নিভৃত নিসর্গ সান্নিধ্যে। তার মনের ক্ষতগুলো সেরে ফেলার জন্য এই সান্নিধ্য খুবই প্রয়োজন। এই পৌঢ় বয়সেও তিনি এর আকর্ষণকে অনুভব করেন। চোখ বুজলেই তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে লস্করদের বিশাল তাল গাছটার ডান পাশ দিয়ে হালকা হলুদ রঙের বিশাল চাঁদ, নদীর ওপর সবুজ রেখার মতো ভেসে থাকা গ্রাম, প্রবল বর্ষার ঘোলা জলে লাল টুক-টুকে বৈচা মাছের ছটফটানি, আন্ধির জংলায় তিন হাত উচু ফণা তোলা রাজ গোক্ষুর সাপ-তার ফুরুৎ ফুরুৎ করা দ্বি-খণ্ডিত খয়েরী রঙের জিহ্বা, কীর্তিনাশা নদীতে বেড় জালে ধরা দেড়মণ ওজনের বিশাল চিতল মাছ যার ডোরাকাটা দেহ বুনো ক্ষিপ্রতা আর মটর দানার মতো চোখ দুটোতে ছিলো ভয়ংকর হিংস্রতা। মজিদ সাহেবের মুখার্জী বাড়ির পুজামণ্ডপে রাখা বিশাল শঙ্খটির কথাও মনে পড়ে, শঙ্খটি এখনও তাকে জীবনানন্দ দাশের শঙ্খ শাদা নারীদের মনে করিয়ে দেয়।

মজিদ সাহেবের গ্রামটি ছিলো হাজার রকমের গাছপালা আর লতাপাতায় ঢাকা-বিভূতির অপু-দুর্গাদের গ্রামের মতো গাছেদের মাতৃস্পর্শে মজিদ সাহেবের ছেলেবেলাটা কেটেছে।

প্রায় অসম্ভব হলেও মজিদ সাহেব সেই শ্যামল নিসর্গ ফিরে পেতে চান। ব্যাপারটা রূপকথার প্রার্থনা পূরণের মতো, পদ্মা নদীর কোমরে বাঁধ দেয়ায় একশত পনেরটি নদী মৃত্যুবরণ করেছে, বাকী নদীগুলোও আর্তনাদ করছে, বাঙলার চরাচরজুড়ে নেমে এসেছে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়। মজিদ সাহেবের প্রার্থনা পূরণ করতে হলে ফারাক্কা বাঁধটা তুলে দিতে হবে, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়কে লঞ্চ ডুবিতে মৃতের পরিবারকে ছাগল দেয়ার পাশাপাশি নদী খননের কাজও করতে হবে। ত্রিশ ফুট চওড়া খাল থেকে চার ফুট ড্রেনে পরিণত হওয়া খালগুলোকে  ফিরিয়ে দিতে হবে তার পূর্বের রূপ। দিগন্তে সৃষ্টি করতে হবে লাল শিমুলের বাঁধ। লাগাতে হবে শিমুলচারা, নির্মল বাতাসের জন্য শ্রী চৈতন্যের জন্মস্বাক্ষী নিম গাছের বন-উপবন সৃষ্টি করতে হবে, এই কষ্টকর প্ল্যান কার্যকর করার মাধ্যমই হতে পারে যাত্রা বিন্দুতে সঠিক প্রত্যাবর্তন।

মজিদ সাহেব এই চার দিনের ছুটির মধ্যে মাদারীপুরের গ্রামের বাড়ি যাওয়া এবং গাছ লাগানোর চিন্তাটাও মাথায় রেখেছেন। এই মুহূর্তে তিনি ক্লান্তি দুর করার জন্য চোখ বুঁজে শুয়ে আছেন। সুমনের এখন কট বিহাইন্ড অবস্থা। সে মজিদ সাহেবের দরজার কাছে উকি-ঝুঁকি মারছিলো। চাচা ঘুমানোর সাথে সাথে তার ঘরটা পরিস্কার করা দরকার। তার ঘরটা এখনও বাদ্যযন্ত্রে ভরা মিয়া তানসেনের ঘর। সে কতটুকু গোল্লায় গেছে তা বিচার করার জন্য এই বাদ্যযন্ত্রগুলোকে এভিডেন্স হিসেবে ব্যবহার করবেন জজ সাহেব। মজিদ সাহেবের ঘরের বাতি নেভামাত্র সুমন এবং রঞ্জন ধরাধরি করে স্প্যানিশ গীটার, সাউন্ড বক্স, হারমোনিয়াম সরিয়ে নেয়। সুমনের কানে পিয়ার্সিং করে দুল পরানো। উৎকণ্ঠার কারণে দুল দুটো খুলতে ভুলে গেছে সে।

পরের দিন শুক্রবার। সুমন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছে। সে কতোটা ভালো ছেলে আজ তার প্রমাণ দেয়ার দিন। সুমন ফিবোনাক্কি রাশিমালার বৈশিষ্ট্যগুলো মজিদ সাহেবকে শুনিয়ে শুনিয়ে পড়তে থাকে। হঠাৎ কানের দুল দুটোর কথা মনে পড়ে-দুল দুটো খুলে ড্রয়ারে রাখার সময় সুমনার ছবিটা চোখে পড়ে তার।

(চলবে)

0 Shares

২০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ