নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড এয়ারপোর্টে যখন পোঁছালাম, এয়ারপোর্ট দেখেই তো আমার আক্কেল গুরুম, ছোটো একটা এয়ারপোর্ট যেন চট্টগ্রামের শাহ আমানত এয়ারপোর্ট, নেই কোন আহামরি সাজসজ্জা, না আছে সুন্দর এরাইভাল ওয়াকওয়ে, আমিরা এগুলাম সিকিউরিটি চেকইনের জন্য, চেইকইন জন্য এগিয়ে গিয়ে লাইন ধরলাম, কয়েকটা ফ্লাইট এক সঙ্গে নামার কারণে প্রচুর মানুঢ জড়ো হয়েছে, কিছুক্ষণ পর দুই সিকিউরিটি অফিসার দুইটা জার্মান শেফার্ড নিয়ে এলো, দুইজনে মিলে স্নিফার ডগ দিয়ে সকল যাত্রীর ব্যাগ শুঁকাইতে লাগলো, আমার ব্যাগের কাছে এসে বেশ কিছুক্ষণ চোক চোক করলো, আমি তো অবাক হয়ে গেলাম যে কি এমন আছে আমার ব্যাগে যে এতক্ষণ শুঁকবে?
একটু পরেই কুকুর রণে ভঙ্গ দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল, মনে মনে বললাম, যা ব্যাটা আমি ড্রাগ প্যাডলার না যে তুই কিছু শুঁকে পাবি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার সিকিউরিটি চেক সেরে বেরিয়ে পড়লাম এয়ারপোর্ট থেকে, বাসে করে এগুলাম অকল্যান্ড দেখতে দেখতে, নিউজিল্যান্ডের সর্ব বৃহত শহর অকল্যান্ড কেমন যেন শূন্য শূন্য, বাড়ি ঘর, দোকানপাট, শপিংমল সব গুলোই কেমন যেন পুরনো টাইপের যেমন ইটালিতে দেখেছি, মনে মনে ভাবলাম নিশ্চয় এরা পুরনো ঐতিহ্য ধরে রেখেছে, রোড গুলো ছয় লেইনের, শহর বলুন বা হাইওয়ে সব রোডই অনেক বড় বড়, আমি যখন সেন্ট্রাল হোটেলে বাস থেকে নেমে প্রবেশ করলাম হোটেলটা প্রথম দেখাতেই পছন্দ হলোনা, বুঝতে পারলাম অনেক পুরনো হোটেল।

এই হোটেলে উঠতে মন চাইলোনা, কিন্তু আমার এজেন্ট বলেছিলো এই হোটেলেই যেন উঠি, এইখান থেকেই সে আমাকে পিক করতে আসবে আগামীকাল সকালে, বাধ্য হয়ে চেকইন করলাম, আমাকে সিঙ্গেল রুম দেওয়া হলো, বেলবয় আমাকে রুমে নিয়ে গেলো, ভিতরে প্রবেশ করে বড় একটা ধাক্কা খেলাম, সিঙ্গেল বিছানাটার থেকে অল্প একটু বড় রুমটা, টয়লেটটাও তথৈবচ, এইসব দেখে নিচে নেমে বললাম সরি রুমটা আমার পছন্দ হয়নি, দরকার হলে আমাকে ডাবলবেডের রুম দাও, ওরা অপারগতা জানালো রুম ফ্রি নেই বলে, আমি শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে সিঙ্গেল রুমটাতেই স্থান গাড়লাম।
আমার এজেন্ট ভদলোক আজ সন্ধ্যায় লান্ড করবেন অকল্যান্ডে, আমি অযথায় শুয়ে বসে না থেকে দুপুরে বেরুলাম কিছু খাওয়ার উদ্দেশ্যে, এলাকাটা যেহেতু সেন্ট্রাল অকল্যান্ড, আমার ঘুরে দেখার জন্য বেটার প্লেস, আমি কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীন এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলাম, সাথে উইন্ডো শপিং যা জীবনেও করিনি এখন তাই করতে শুরু করলাম, একদিকে দেখলাম স্ট্রিট ফুড বিক্রি হচ্ছে, এগিয়ে গিয়ে উঁকি দিলাম, ওরা হটডগ বিক্রি করছে দেখে জিজ্ঞেস করলাম কিসের হটডগ?
ওরা জানালো বিফ, আমি একটা নিয়ে মাস্টার্ড সস লাগিয়ে খেতে খেতে শহরের সৌন্দর্য্য দেখতে লাগলাম, কিন্তু অবাক হলাম ছয় লেনের রোডে গাড়ী বলতেই নেই, হটাৎ একটা দুইটা আসে, চলে যায়।
সন্ধ্যার আগে হোটেলে ফিরে এলাম, রিসেপসনে জিজ্ঞেস করলাম ওদের নিজের রেস্টুরেন্ট আছে কিনা?
ওরা জানালো টপ ফ্লোরে রেস্টুরেন্ট আছে, আমি চাইলে রুমেও অর্ডার করে খেতে পারি।

পরদিন ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো, ফোন রিসিভ করতেই রিসেপশন থেকে বললো কল আছে আমার জন্য, একটু পরেই আমার এজেন্ট হ্যালো বলে বললো, সে ঘন্টা দুই একের মধ্যে আসবে আমাকে পিক করতে, আমাকে বলেছে চেকআউট করে নিতে।
আমি ফ্রেস হয়ে রুমেই ব্রেকফাস্ট করে নিলাম, এরপর নিচে নেমে এসে চেকআউট করে অপেক্ষা করতে লাগলাম এজেন্ট ভদ্রলোকের জন্য।
ভদলোক আসলে উনি নিজেই আমার সব ব্যাগেজ গাড়ীতে তুলতে হেল্প করলেন, গাড়ীতে উঠার পর সে বললো, আমার আপত্তি না থাকলে ও আমাকে লোকাল ভিসা ও জাতীয়তা প্রাপ্তির ব্যাপারে হেল্প করবে এমন লোকের কাছে নিয়ে যেতে চাই, ওই লোকটিই আমাকে এইখানকার সকল বিষয়ে অবগত করবে এবং সকল প্রকার হেল্প করবে।
আমি রাজি হলে সে আমাকে নিয়ে গেলো লোকাল এজেন্টের কাছে, লোকটি আমাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়ে পরিচয় দিলো তার নাম মার্ক, সে আমাকে সকল বিষয়ে হেল্প করবে।
মার্ক বলতে লাগলো, অকল্যান্ড নিউজিল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর, নিউজিল্যান্ডের রাজধানী হলো ওয়েলিংটন হলেও মানুষ পছন্দ করে অকল্যান্ডকে, এই দেশের আদি বাসিন্দারা হলো মাওরি উপজাতি, এদের সংস্কৃতি সাধারণ নিউজিল্যান্ডবাসিদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হলেও ওরা মিশে আছে সাধারণ মানুষের ভীড়ে, এরপরেও ওরা ওদের সংস্কৃতি ছাড়েনি, ওদের নিজস্ব গ্রাম আছে, যেখানে ওরা ওদের সংস্কৃতির চর্চা করে যা নিউজিল্যান্ডবাসির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে তোলে ওদের।

পরদিন সকালে মার্ক এলো আমাকে পিক করার জন্য, প্রথমে নিয়ে গেলো ব্যাংকে একাউন্ট খুলার জন্য, একাউন্ট খুলার সাথে সাথে আমাকে ইন্টারন্যাশনাল ডেবিট কার্ড দেওয়া হলো যা আমি যে কোন ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক যেমন এইচএসবিসি, স্ট্যান চ্যাট টাইপের ব্যাংকে লেনদেন করতে পারবো, এরপর গেলাম ব্যবসা কি করা যায় তা সম্পর্কে জানতে, যেহেতু ও শুনেছে আমি গাড়ীর ব্যবসায়ী, তাই সে আমাকে নিয়ে গেলো কিছু গাড়ীর ডিলারের কাছে, ওদের কাছে জানতে পারলাম নিউজিল্যান্ডে গাড়ী আমদানিতে কোনো ডিউটি নেওয়া হয়না, ফলশ্রুতিতে আপনি যে কোন গাড়ী খুব অল্প দামে কিনতে পারবেন, সেই সময় দেশে আমি নতুন টয়োটা নোয়া কিনেছিলাম সাড়ে সাত লাখ দিয়ে যা নিউজিল্যান্ডে দেখলাম মাত্র দেড় লক্ষ টাকা দামে মানুষ কিনছে, দেখে অবাক হলাম আমি, ভাবলাম তাহলে তো গাড়ীর ব্যবসায় করতে পারি কিন্তু যা,শুনলাম একটা শোরুম করতে প্রায় তিন চার লাখ ডলার লাগবে শুরুতে, এরপর রানিং ক্যাপিটাল লাগবে আরো দুই লক্ষ, বুঝেন ঠ্যালা।
মার্ক এরপর নিয়ে গেলো কিছু রেস্টুরেন্টে, সেখানেও সব কিছু মিলে ঐ পাঁচ লাখের কাছাকাছি লাগবে, এছাড়া চাইলে বাড়ি একটা করেও রেসিডেন্সি নেওয়া যায় বা যে কোন ধরণের ইনভেস্টমেন্ট করেও নিউজিল্যান্ডের বসবাসের অনুমতি পাওয়া যায়।

সব কিছু দেখে শুনে ফ্রি হওয়ার পর মার্ক বললো সাইট সি করবো কিনা, আমি জিজ্ঞেস করলাম কি আছে?
সে বললো, আচ্ছা চলো শহর থেকে একটু দূরে যায়, তোমাকে আমাদের এইখানকার কয়েকটা সুপ্ত আগ্নেয়গিরি দেখাবো।
শুনেই আমার কলজেটা লাফ দিয়ে উঠলো, বলে কি সুপ্ত আগ্নেয়গিরি দেখাবে, তবুও সাহস করে বললাম, চলো দেখি।
দুজনে গাড়ীতে ছুটলাম আগ্নেয়গিরি দেখতে, সে বললো ওখানে যেতে যেতে দুপুর গড়িয়ে যাবে, তাই পথ থেকেই কিছু খেয়ে নেবো আমরা।
পথেই সাব নামক চেইন ফুড কোর্টে দাঁড়ালাম, ওখানে গাড়ীতে বসেই সে অর্ডার করলো দুইটা করে বিফ বার্গার ও চিকেন স্যান্ডুইচের, কিছুক্ষণের মধ্যে খাবার ডেলিভারি করা হলে আমরা আবার ছুটলাম আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
ঘন্টা দেড় ঘন্টা পর আমরা পোঁছালাম বড় বড় পাহাড় পর্বতের রাজত্বে, কিছুক্ষণের মধ্যে মার্ক সাইড রোড ধরলো যা একটা পাহাড়ি পথ, ওই পথটা ঘুরে ঘুরে উপরে উঠছে, উঠছি তো উঠছি যেন পথ শেষই হয়না, হটাৎ দেখি সামনে আকাশ, একটু সামনেই দেখলাম বেশ কয়েকটি গাড়ী রাখা আছে পার্কিংয়ে, আমাদের গাড়ীও পার্কিংয়ে রেখে আমরা বার্গারের বক্স নিয়ে নেমে পড়লাম, একটু সামনে দেখলাম বড় একটা ঘন্টা ঝুলানো যার অপর পাশে লোহা দিয়ে ঘেরাও করা আছে, মার্ক আমাকে নিয়ে সেদিকেই এগুলো, ঘেরাও করে রাখা ফেন্সের কাছে এসে দাঁড়ালাম দুজন, দেখলাম ফেন্সের ওদিকে বিরাট একটা গর্ত মতো একটা হয়ে আছে যার মধ্যে ছোটো খাটো আরেকটা পাহাড় ভরে দেওয়া যাবে, একেবারে তল পর্যন্ত সবুজে সবুজ হয়ে আছে কিন্তু আগ্নেয়গিরির ছিটেফোঁটাও নেই, আমি মার্ককে বললাম, কই তোমার আগ্নেয়গিরি?
জবাবে ও বললো, এইটাই আগ্নেয়গিরি যা শত বছর পর্যন্ত ঘুমন্ত বা সুপ্ত অবস্থায় আছে বলেই এমন মনে হচ্ছে, কিন্তু এইটা যদি জেগে উঠে তাহলে অকল্যান্ড শহরকে চেনাই যাবে কিনা সন্দেহ আছে।
আমি আবার ভয়ে ভয়ে তাকালাম, নিজ চোখে এমন একটা সুপ্ত আগ্নেয়গিরি স্বচোক্ষে দেখবো কখনোই চিন্তাও করিনি।

কতক্ষণ এক দৃষ্টিতে চেয়েছিলাম সেই দানবকে কিন্তু ধ্যান ভাঙ্গলো মার্কের ডাকে, বললো চলো ওদিকে বসে বার্গারটা খেয়ে নিই।
দুজনে ঘন্টার কাছে এসে বসলাম, বার্গার খেতে খেতে দেখছি আসে পাশের সৌন্দর্য্য মুগ্ধ হয়ে, কি অপরূপ সেই দৃশ্য কিন্তু দানবটা জেগে উঠলে হয়তো এইসব কিছুই থাকবেনা।
আমাদের আগে পরে আরো পর্যটক এসেছে আগ্নেয়গিরিটা দেখতে, সবাই ছবি তুলছে, আমরাও তুলছি, আমি মার্ককে জিজ্ঞেস করলাম এই ঘন্টাটা কিসের?
ও বললো, এইটা হলো এলার্ম যাতে আগ্নেয়গিরি জাগছে বা জাগবে দেখলে আগের দিনে এইটা বাজানো হতো ঢং ঢং করে, এইটা এখনো রয়ে গেছে একি ভাবে, প্রশাসন সব সময় এর রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে।
আমি ঘুরে ঘুরে ঘন্টাটা দেখতে লাগলাম, বিরাট একটা ঘন্টা, দেখতেই অবাক লাগে এইটা কিভাবে ঝুলালো এইখানে।
কিছুক্ষণ পর আমরা ফিরতি পথ ধরলাম।

সমাপ্ত।

যারা আগের পর্ব পড়েননি, তাদের জন্য লিংক দিলামঃ

https://www.sonelablog.com/%e0%a6%a8%e0%a6%bf%e0%a6%89%e0%a6%9c%e0%a6%bf%e0%a6%b2%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a1-%e0%a6%ad%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%ae%e0%a6%a3%e0%a7%87-%e0%a6%88%e0%a6%a6-%e0%a6%89/

0 Shares

৪৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ