বছর চারেক আগের কথা।
রুম খুঁজছিলাম এক ছোটভাইয়ের জন্যে। ব্যয়বহুল এই নিউইয়র্ক শহরে একটি বাসা ভাড়া নেবার সামর্থ্য তাঁর ছিল না। তাই রুম খোঁজা। পত্রিকায় রুম ভাড়ার বিজ্ঞাপন দেখে এখানে ওখানে ফোন করে অবশেষে দেখতে গেলাম। আমি আর সেই ছোটভাই ড্রয়িং রুমে অপেক্ষা করছি কখন রুম দেখাবেন গৃহকর্তা। অতঃপর যা জানলাম, যারপরনাই বিস্মিত হলাম। ছোট ড্রয়িং রুমটির একপাশে দোতলা বেড। বেডটির নীচতলায় একজন ব্যাচেলর থাকেন। উপরের তলা আরেকজন ব্যাচেলরকে ভাড়া দিবেন চার'শ ডলারের বিনিময়ে।
কয়েক বছর বাদে আবারো রুম খুঁজছিলাম।
যেসব বাংলাদেশী আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহন করেছেন, তাঁরা প্রায় সকলেই তাঁদের ভাইবোনদের এদেশে আনবার জন্যে আবেদন করে থাকেন। ২০০২/২০০৩ সালে যারা আবেদন করেছেন, এখন এই ১০১৬ সালে তাঁদের ভাইবোনেরা পরিবারসহ আসছে পর্যায়ক্রমে। এমনই একটি পরিবারের জন্যে রুম খুঁজতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি, তা মোটেও সুখকর ছিল না। ফ্লাশিং মেইন স্ট্রীটে এক এপার্টমেন্ট বিল্ডিং এ গিয়েছিলাম। দুই বেডরুমের বাসাটির একটি রুমে স্বামী-স্ত্রী, তাঁদের ১৭ বছরের ছেলে আর ১৫ বছরের মেয়ে, মোট চারজন থাকেন ! অন্য রুমটি ভাড়া দিবেন ছোট পরিবারের কাছে।
উড সাইড এরিয়ায় আরেকটি প্রাইভেট হাউজের একটি রুম ভাড়া হবে। আকারে এতটাই ছোট যে, কোনরকম একটি বেড রাখা যাবে হয়তো। বাকি রুমে বাড়ির অন্য বাসিন্দা'রা থাকেন। যেখানে পরিবারটির শিশুরা আছে। আছে দেশ থেকে আসা বৃদ্ধ বাবা-মা ও। ভীষণ অস্বাস্থ্যকর আর অমানবিক যাপিত এক জীবন ! রুমটির ভাড়া এক হাজার ডলার। বাংলাদেশী টাকায় প্রায় আটাত্তর হাজার টাকা ! বলা বাহুল্য, প্রতিটি বাড়িতেই সকলের জন্যে একটি মাত্র বাথরুম।
এস্টোরিয়া এরিয়ায় অন্য একটি নাম্বারে ফোন করে জানলাম তাঁদের রুমটি ভাড়া দিবেন মাত্র তিন মাসের জন্যে। পরিবারটি হজ্জ এ যাচ্ছে, তাই। কেউ কেউ দিবেন দুই মাসের জন্যে। কেননা সামার ভেকেশনে অনেকেই দেশে বেড়াতে যাচ্ছেন। ব্যয়বহুল এই শহরে দু'মাসের জন্যেই বা রুমটি খালি থাকবে কেন !
স্বপ্নের শহরে ক'দিন বাদে দেশ থেকে নতুন যে পরিবারটি আসবে, রুমটি দেখে তাঁদের তীব্র মন খারাপ হবে, জানি। হয়তো মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন শুরুতে। অতঃপর ধীরে ধীরে মানিয়ে নিবে। একদিন ভালোও বেসে ফেলবে এই শহরকে। নিরাপদ জীবন যাপনের এই শহরকে ভাল না বেসে উপায় নেই। কেননা, ভাল অবস্থানে থাকা, সুন্দর মানবিক পরিবেশে জীবন যাপন করাও খুব কঠিন কিছু নয়, যদি না তাঁর পিছুটান থাকে। আবার নিজে কষ্ট করে মানবেতর জীবন যাপনের মাঝেও কেউ কেউ সুখ খুঁজে পান। কারন অর্থ সাশ্রয় করে দেশে পরিবারকে পাঠানোর মাঝেও তো কম সুখ নয়। তাঁরা কষ্ট দিয়ে দেশে রেখে আসা পরিবারের জন্যে সুখ কিনেন।
এখানে ওখানে বাড়ি/রুম দেখবার সময়ে খাঁখাঁ রৌদ্রের ভর দুপুরটাতে আচমকা আকাশ কালো আঁধার করে ঝুম বৃষ্টি নামে এই শহরে। শহর ধোয়া বৃষ্টি। "প্রিন্স চার্লস" নামের এপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে ফ্রাঙ্কলিন এভিনিউ এ এসে যখন দাঁড়াই, ততক্ষনে বাইরের প্রকৃতি শান্ত, নির্মল, সতেজ। আকাশ আঁধার করে বৃষ্টি শেষে এমন নির্মল সতেজ ধরণী দেখবার জন্যেই তো আমরা বেঁচে থাকি।
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
Thumbnails managed by ThumbPress
২৫টি মন্তব্য
শুন্য শুন্যালয়
আপু এই জীবনযাত্রার কিছু সামনে থেকে দেখতে হয়নি, কিছুটা ভাগ্যবানই মানছি নিজেকে। পায়ে ফোস্কা ফেলে বাড়ি দেখতে যাওয়া লাগেনি আমার, কিংবা কএকদিন পরে ভাত খেতে পাবার সে আনন্দ!! আমি গ্রেটফুল আমার হাজব্যান্ডের কাছে।
হ্যাঁ আপু, এত কষ্টের পরেও কিছু টাকা পাঠাতে পারার আনন্দ, সে আনন্দ আকাশসম। এত সুন্দর করে সিম্পল ভাবনাগুলো কিভাবে লেখায় ফুঁটিয়ে তোলেন!! আমার মাথায় কেন আসেনা!!
রিমি রুম্মান
আমার প্রথমদিকের দিনগুলো কিছুটা কষ্টের ছিল যদিও। কিন্তু এমন অমানবিক নয়। একজনের জন্যে রুম খুঁজতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি… সেটি অস্বস্তিকর। মনে হল, আরেকটু ভালো তো চাইলেই থাকা যায়।
নাসির সারওয়ার
নতুন করে নতুন দেশে শুরু করা জীবন একটু কঠিনই হবার কথা। তবে কারো যদি উপরে ওঠার অদম্য ইচ্ছাশক্তি থাকে, ঐ দেশে তা হয় বলে আমি মনে করি। আমি নিজে তেমনই দেখেছি।
আপনার লেখায় প্রান জেগে থাক সবসময়ের মত।
রিমি রুম্মান
আপনার সাথে শতভাগ একমত। চাইলে অনেক ভালোও থাকা যায়। যা আমাদের দেশেও সম্ভব নয়।
শামীম আনোয়ার আল- বেপারী
কারন অর্থ সাশ্রয় করে দেশে পরিবারকে পাঠানোর মাঝেও তো কম সুখ নয়।
সত্যি এটাতে অনেক শান্তি
রিমি রুম্মান
এখানে যে সর্বনিম্ন আয় করে, সে ও তা দিয়ে সুন্দর ভাবেই জীবন যাপন করতে পারে। কিন্তু ঐযে বললাম, পিছুটানের কথা ! দেশে পরিবারকে ভাল রাখতে গিয়ে নিজেরা কোনরকম জীবন যাপন করে যায়।
ছাইরাছ হেলাল
বিভুঁইয়ে প্রথমদিকের কঠিন দিক গুলো ঠিকঠাক তুলে ধরেছেন।
রিমি রুম্মান
এটি বিদেশের প্রথম দিকের চিত্র হবার কথা। কিন্তু অনেকেই আছেন বছরের পর বছর এমন জীবন যাপন করছেন। তাঁদের অবস্থার কোন উন্নতি হয় না। তবুও তাঁরা সুখি। নিরাপদ জীবন যাপন করছেন।
আবু খায়ের আনিছ
এত দেখি আমাদের দেশের চেয়ে করুণ অবস্থা, এখানে পনের বিশ হাজার টাকার মধ্যে ভালো ফ্ল্যাট পাওয়া যায়, আর ৫/৭ হাজার টাকার মধ্যে ভালো রুম পাওয়া যায়। দেশ ছেড়ে যাওয়ার কোন ইচ্ছা ছিল না, তবু যদি কখনো মনের মাঝে কোন কারণে উকিঁ দেয় তবে সাবধান আগে থেকেই।
রিমি রুম্মান
আমাদের দেশে অনেক সময় চাইলেও ভাল থাকা যায় না, উপরে উঠা যায় না। কিন্তু এখানে তো চাইলেই, চেষ্টা করলেই মানুষ সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু কিছুটা নিজেদের স্বভাব, আর কিছুটা দেশে পরিবারের অভাব__ দুই এ মিলে এই দশা। তবে নিউইয়র্কের বাইরের অবস্থা ভিন্ন। অল্প টাকায় প্রাসাদোপম বাড়ি পাওয়া যায়। সেখানে ছিমছাম, নিরিবিলি পরিবেশ।
আবু খায়ের আনিছ
তা অবশ্য ঠিক, একেক জায়গায় একেক রকম অবস্থা। বাংলাদেশেও তাই হয়।
প্রবাসী এই সব মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
জিসান শা ইকরাম
বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে সুন্দর, এবং মানিয়ে নেয়া।
রিমি রুম্মান
এখানে যে যেমন আছে, সেটি তাঁর বা তাদের চয়েজ।
যার যার মত করে সবাই সুখি।
ভাল থাকুক সকলে।
নীলাঞ্জনা নীলা
আমিও শুনেছি নিউইয়র্কের ভাড়া বাসা সম্পর্কে। শুনে সত্যি অবাক হয়েছি। আমার কুমকুম আপা দুই রুমের বাসা নিয়ে থাকে।
কানাডায় এমন শুনেছি ভ্যাঙ্কুভার, ক্যালগরি ওদিকে। টরেন্টোতেও অনেক তবে নিউইয়র্কের মতো না। হ্যামিল্টনে সহনশীল। আমরা দুই বেড, লিভিং কাম ডায়েনিং, কিচেন, ওয়াশরুম আর ব্যালকনি। শুধু ব্যালকনির জন্যই ভাড়াটা বেশী $১০০০। তবে এখন যারা এসব বাসায় উঠছে তাদেরকে প্রায় ১২০০-১৫০০ করে দিতে হচ্ছে।
বাসা নিয়ে এভাবে ভোগান্তি পোহাতে হয়নি সেভাবে। তবে বেলজিয়ামে প্রায় ছয় মাস বেসমেন্টে ছিলাম। সেই জীবন এতোটাই কষ্টের ছিলো।
আপু তোমার লেখার কথা কি আর বলবো! -{@ (3
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক এর কিছু এলাকা এমন। কিন্তু সব জায়গা না। তবে অনেকটা ঢাকার মতন। ঢাকায় যেমন অনেকেই গাদাগাদি করে থাকে। ঢাকার বাইরে বড় জায়গা নিয়ে খোলামেলা পরিবেশে বড় বড় বাড়ি … বিষয়টি ঠিক তেমন।
তবে নতুন আসা মানুষগুলোর ভোগান্তি বেশি।
ভাল থেকো, অনেক।
নীলাঞ্জনা নীলা
তুমিও ভালো রেখো। -{@
মেহেরী তাজ
একটা নতুন শহরে রুম/ বাসা মূলত থাকার একটা জায়গা খুঁজতে যাওয়া যে কি কষ্টকর তা খুব বুঝেছি ঢাকায় থাকতে গিয়ে!
সব শহরে কষ্টকরে টিকে থাকা সেই মানুষ গুলো একট ভালো থাকুক সেই প্রার্থনা করি।
আপু আমি যদি আপনার মত করে লিখতে পারতাম!
রিমি রুম্মান
ভিন দেশে, ভিন্ন ভাষার অচেনা শহরে এটি যে কি ভোগান্তির, তা কেবল ভুক্তভুগিই জানে।
তবুও তাঁরা শেষ পর্যন্ত ভাল থাকে, নিরাপদ থাকে এই বিদেশ বিভূঁইয়ে।
আমি তো আমার মত করে বলে যাই সহজভাবে। কঠিন কিছু তো নয়। যে কেউ চাইলে এমন লিখতে পারবে গো …
মৌনতা রিতু
আচ্ছা, দুই, তিনমাসের জন্য রুম ভাড়া দিলে তাদের জিনিসপত্র ঠিক থাকে ? প্রাইভেসি ?
আমার বান্ধবী মিতু ওর দুই ছেলে নিয়ে তিনবছর হল গেছে ওখানে। একবছর ওর ভাসুরের বাসায় ছিল। তারপর এখন নিজেদের বাসায় উঠেছে।
আমার ছোটবোনটা অবশ্য এপ্লিকেশন করে রাখছে। কিন্তু বিপ্লব যেতে চাচ্ছে না। ওর ভাসুরের নাকি একটা ফিস্ট ফুডের দোকান আছে।
কি অবস্থা ওখানে রুম পাওয়া ! তুমি না উপস্থাপন করলে তো জানতেই পারতাম না।
রিমি রুম্মান
যারা একটু গুছিয়ে নিয়েছে, তাদের আত্মীয়রা এলে সমস্যায় পড়তে হয় না।
যারা গুছিয়ে উঠতে পারেনি তাঁদের সমস্যা হয়। তবে আমি নিজেকে দিয়ে বুঝি, এ দেশে ভাল থাকা, সুন্দর থাকা কঠিন নয়। শুধু চেষ্টা থাকতে হয়। পিছুটান থাকলে অবশ্য ভিন্ন কথা।
ইঞ্জা
আপনার লেখাটি আমাকে আমার ছেলের কথা মনে করিয়ে দিলো কারণ সে রিসেন্টলি মালেশিয়া পড়তে গিয়েছে আর এই ধরণের সমস্যার সম্মুখীন সেও হয়েছে।
রিমি রুম্মান
নতুন শহরে কম বেশি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় প্রায় সবাইকে। এটি অবশ্য ভবিষ্যতে এগিয়ে যাবার পথে বড় ভুমিকা রাখা। অনেকটা সোনা পুড়ে খাঁটি হবার মতন।
ইঞ্জা
সহমত
ইলিয়াস মাসুদ
এত বছর এ দেশে আছি তারপরও নিউইয়র্ক আমার কাছে কেমন যেন অচেনা,মাঝে মাঝেই যাওয়া হয়,যত বারই যাই তত বারই যেন নতুন ……।
এই দিক থে আমি যার পর নেই ভাগ্যবান……।আমি নিরিবিরি পছন্দ করি….. তাই আল্লাহ যেন আমার ইচ্ছের মত করে বানিয়েছে আমার এই ছোট্ট শহর,পরিবার পরিজন নিয়ে দারুন কেটে যাচ্ছে,ইচ্ছে মত দেশে সবার কম বেশি চাহিদাও মিটিয়ে যাচ্ছি……..
আপনার লিখা আর আমার স্বচক্ষে দেখা কোন তফাৎ নেই। অনেক ভাল লাগল
রিমি রুম্মান
যারা একবার নিউইয়র্ক এসে উঠেছেন, তাঁরা অন্য শহরে থাকতে ভাল বোধ করেনা। শ্মশান মনে হয়।
আবার যারা নিউইয়র্কের বাইরের নিরিবিলি ছিমছাম শহরে উঠেছে শুরুতে, তাঁরা নিউইয়র্ক কোন ভাবেই পছন্দ করে না। বাজার মনে হয়। কোলাহল, হৈচৈ দিনরাত !