নিঃস্বঙ্গ প্রেম (১ম পর্ব)

আর্বনীল ১৬ এপ্রিল ২০১৪, বুধবার, ১১:২৯:২৩পূর্বাহ্ন গল্প ৭ মন্তব্য

সারাদিনের আড্ডা শেষে অর্ক ঘরে ফিরছে। অর্ক’র বাবা ছাড়াও তার জন্য অপেক্ষা করার মত আরো একজন আছে। তিনি হলেন আফরোজা বেগম। অর্ক’র ফুফু। তিনি স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে চার বছর হল এখানেই আছে। অর্ক’র মা নেই। মা থাকলে হয়তো ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন করে বলত, বাবা তুই কোথায়? সারাদিন নাওয়া-খাওয়া নেই। কই যে ঘুরে বেড়াচ্ছিস? বাসায় আসবি কখন? ইত্যাদি… ইত্যাদি…। তার মা নেই বলেই এমন করে কথাগুলো কারো মুখ থেকে শুনা হয়না। তবে তার বাবা আনিসুর রহমান। তিনিও যে ফোন করেন না তা কিন্তু না। তিনি প্রতিদিন দুপুরে একই সময়ে (১টা ৪৫ মিনিটে) ছেলেকে ফোন করেন। ফোন করে বলবে সময় মত খেয়ে নিস। খাওয়া নিয়ে মোটেও অবহেলা করবি না। আমাকে দেখ এই বয়সেও আমি কত স্ট্রং। আর শুন সারাদিন রোদে ঘুরাঘুরি করিস না। বাবা আজও ফোন করে তাই বলছিলেন। রোজ রোজ একই কথা শুনতে অর্ক’র ভালো লাগে না। আবার না শুনলেও খারাপ লাগে। আজ বাবার সাথে অর্ক অনেকক্ষন কথা বলল। কিন্তু আসল কথাটাই বলা হয়নি। সে আজ রাস্তা থেকে একটা মেয়েকে সঙ্গে করে বাসায় এনে তুলেছে। মেয়েটার নাম নায়লা। অত্যান্ত রুপবতী। যাকে বলে দুধে-আলতা গায়ের রঙ। নায়লার গায়ের রঙ ঠিক তেমনই। এখনকার মেয়েরা মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত ঘরের হলেও ফ্যাশনের দিক দিয়ে তারা অনেকটায় এগিয়ে গেছে। তারা নিজেদের সুন্দর থেকে আরো সুন্দর রাখতে চায়। এজন্য বিউটি পার্লার, মেক-আপ এসব নিয়েই ব্যাস্ত থাকে। কিন্তু নায়লা হল সেই মেয়ে যে তার প্রকৃত সুন্দর্য নিয়েই সন্তুষ্ঠ। সে নিজেকে অতিরিক্ত সুন্দর করার জন্য মেক-আপ এর সাহায্য নেয়নি। নায়লার মাথার চুলগুলোও বেশ লম্বা। সব মিলিয়ে সাধারন মেয়েদের মাঝে নায়লাকে অসাধারন বলা যায়। অর্ক এখন কি বাবাকে আবার ফোন করে সব বলবে? না থাক। এখন বলতে ইচ্ছে করছে না। যে কথা বলতে ইচ্ছে করে না সে কথা গুছিয়ে বলা যায় না।

 

রিক্সা বাসার সামনে এসে থামল। অর্ক’র মাথার ভেতর টেনশনের পোকা কামড় দিতে শুরু করে দিয়েছে। বাবাকে নায়লার কথাটা তখন বলে দেয়াই উচিত ছিল। কেন যে বলতে ইচ্ছে করেনি সে ভেবে পাচ্ছে না। আনিসুর রহমান এমনিতে ঠান্ডা মাথার মানুষ। সহজে তিনি রাগ করেন না। তবে যদি কোন কারনে রাগ উঠে যায়। তখন সেটা চরম বারাবারি পর্যায়ে চলে যায়। তখন তিনি কি করেন না করেন নিজেও জানেন না। তখন মনে হয় উনাকে অন্য কেউ নিয়ন্ত্রন করছেন। অর্ক বাবার এই অভ্যাসটাকে একেবারেই পছন্দ করে না। তার ধারনা এটা তার বাবার জটিল কোন রোগ ছাড়া আর কিছুই না। এবং অতিসত্বর এই রোগের চিকিৎসা হওয়া প্রয়োজন।

 

পকেট থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখল অর্ক। ৬টা ১০ বাজে। আনিসুর রহমান বিকেল ৫টা থেকে সাড়ে ৫টা’র মধ্যে বাসায় চলে আসে। এতক্ষনে নিশ্চয় চলে এসছে। নায়লা কি বাবার সামনে পরেছে? অর্ক ভাবছে। যদি এসে পরে তাহলে এই মুহুর্তে ভেতরের অবস্থা কি? সে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা আন্দাজ করার চেষ্টা করল। না ভেতরে তেমন কোনো সাড়া শব্দ শুনা যাচ্ছে না। তবুও তার ভয় ভয় লাগছে। সে ঘামতে শুরু করেছে।

 

অর্ক বেল চাপল। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার ফুফু এসে দরজা খুলে দিল। আনিসুর রহমান টিভিতে জিওগ্রাফী চ্যানেল দেখছিলেন। অথচ চোখে চশমা নেই। আশ্চর্য! চশমা ছাড়া তিনি কিছুই দেখতে পারেন না। সব কিছু নাকি ঝাপশা মনে হয়। কিন্তু এখন তিনি চশমা ছাড়া দিব্যি টিভি দেখে যাচ্ছেন। আড়াল থেকে ফুফু ফিস ফিস করে অর্ককে কি যেন বুঝাতে চাচ্ছে। কিন্তু অর্ক কিছুই বুঝতে পারছে না। সে তার ফুফুর ফিস ফিসানি উপেক্ষা করে বাবার কাছে এগিয়ে গেল। কেমন আছ বাবা? আনিস সাহেব ছেলের দিকে তাকালেন কিন্তু কোন উত্তর দিলেন না। মনে হল এমন প্রশ্নে তিনি বিরক্ত হয়েছেন। অর্ক আবারো বলল- বাবা তোমার মন ভালোতো ? তিনি এবারও কিছু বললেন না। মনে হয় উনার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আর না হয় তিনি কোন কারনে প্রচন্ড রেগে আছেন। ফুফু আবারো ফিস ফিস করে কিছু একটা বুঝাতে চাচ্ছে। কিন্তু অর্ক কোন পাত্তা দিচ্ছে না। সে তার বাবার পাশে একটা মোড়া টেনে বসল। বাবা তোমাকে সাদা পাঞ্জাবী’তে অনেক সুন্দর লাগছে। অনেক পবিত্র পবিত্র মনে হচ্ছে। আনিসুর রহমানের বোধহয় ছেলের এমন সস্তা রসিকতা পছন্দ হয়নি। তিনি অনেকক্ষন ধরে রাগ চেপে রেখেছিলেন। তিনি কোথায় যেন পড়েছিলেন অতিরিক্ত রাগের সময় হিংস্র প্রানীদের দেখলে নাকি রাগ কমে যায়। তিনি জিওগ্রাফী চ্যানেলে তাই দেখছিলেন। কিন্তু ছেলের এমন কথা বার্তায় রাগ আর সামলানো যাচ্ছে না। তিনি প্রচন্ড ক্ষ্যাপে গিয়ে বললেন, তুই পেয়েছিসটা কি? মা মরা ছেলে বলে তোকে শাসনের তুলনায় আদর দিয়েছি বেশী। এর মানে এই নয় যে, তোমার যখন যা ইচ্ছে করবে তুই তাই করবি। আর আমি সেটা হাসি মুখে মেনে নেব। বাবার রাগ উঠলে তুই না তুমি কি বলবে তিনি ঠিক করতে পারে না। এখনও একবার তুই একবার তুমি বলছে। মানে উনি এখন রেগে আছেন। অর্ককে এখন যথা সম্ভব গুছিয়ে কথা বলতে হবে। তা না হলে বাবার রাগ আউট অফ কন্টোল। মানে নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাবে। অর্ক বলল, বাবা তুমি একটু শান্ত হয়ে আমাকে বলবে আমি অন্যায়টা কি করেছি?

মনে হয় জিওগ্রাফী চ্যানেলের ব্যাপারটা মিথ্যা না। আনিসুর রহমানের রাগ কিছুটা কমে গেছে। তিনি গলার স্বর নিচু করে বললেন - বলার মত অবস্থা তুমি আর কিছুই রাখনি। এখন যা বলছি মন দিয়ে শোনো, তুমি যে অন্যায় করেছো তার শাস্তি তোমাকে অবশ্যই পেতে হবে। আর শাস্তিটা কি হবে আমি সেটাও ঠিক করে ফেলেছি। এখন বলো তুমি শাস্তিটা কি তা আগে শুনতে চাও? নাকি সরাসরি শাস্তি ভোগ করতে চাও? অর্ক বলল, বাবা শাস্তি ভোগ করার আগে জেনে নেয়াই ভালো। তখন আগে থেকেই শাস্তির জন্য মানুষিক ভাবে প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম।

‘তাহলে শুনো শাস্তিটা হল তুমি ঐ বেয়াদপ মেয়েটাকে নিয়ে এক্ষুনি আমার বাসা থেকে বেড়িয়ে যাবে। এই মেয়ে কে? কি করে? কোত্থেকে এসেছে তার কিছুই আমি জানতে চাই না। অর্ক মনে মনে বলল, ওহ! তারমানে নায়লাই হল বাবার রাগের কারন। এরপরও কি বাবাকে জিজ্ঞেস করা যায় বাবা আমার অন্যায়টা কি? যায় না। কিন্তু তারপরও অর্ক জিজ্ঞেস করল, বাবা তুমি কোন মেয়েটার কথা বলছো? আনিস সাহেব ছেলের দিকে এমন ভাবে তাকালেন যেন, সে অনেক কঠিন একটা প্রশ্ন করে ফেলেছে। তিনি টিভির দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, তুমি ভালো করেই জানো আমি কোন মেয়েটার কথা বলছি। তারপরও আবার বলছি শোন, সকালে যে মেয়েটাকে তুমি বাসায় নিয়ে এসেছো তার হাত ধরে এই মুহুর্তে বেড়িয়ে যাবে। কত বড় অসভ্য মেয়েছেলে আমার সামনে কি না লুঙ্গী-শার্ট পরে ঘুরে বেড়ায়! ছিঃ ! অর্ক’র কাছে নায়লার লুঙ্গি পরার ব্যাপারটা পরিস্কার না। তাই এই বিষয় নিয়ে কথা বলার কোন মানে হয় না। সে মোড়া ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আবার কি মনে করে যেন বসেও পরল।

আনিস সাহেব অর্ক’র দিকে তাকিয়ে প্রায় ধমকের মত বললেন আবার কি হল? বসে পরলি কেন? বাবা আমরা কি এক্ষুনি বাসা থেকে বেড়িয়ে যাব? না মানে…ইয়ে মানে...আ…আঁধা ঘন্টা সময় যদি দাও তাহলে……

তিনি ঘড়ি দেখলেন। এখন ৭টা বাজে। ৮টার মধ্যে অবশ্যই বের হয়ে যাবে। ১ ঘন্টা সময় দিলাম। ৬০ মিনিটে ১ ঘন্টা হয়। ১ঘন্টা কম সময় না। আর শুনো যাওয়ার সময় ভুলেও আমার সামনে পরবে না। এবং ভবিৎষতে আমার সামনে আসার চেষ্টাও করবে না। কথাটা যেন মনে থাকে।

বাবা আমি মনে রাখব। তুমি যে ১ঘন্টা সময় আমাকে দেবে তা আমার কল্পনাতেও ছিল না। থ্যাং ইয়্যু।

 

অর্ক তার শোবার ঘরে ডুকল। তার বাবা হাই পেশারের রুগী। যখন তখন উনি এই অসুকের সাথে গভীর প্রেমে বিছানায় লুটিয়ে পরেন। মাঝে মাঝে অবস্থা চরম পর্যায়ে চলে যায়। অর্ক’র উপর তার বাবার রাগ করার কারন হল নায়লা। চেনা জানা নেই একটা রুপবতি মেয়েকে এভাবে বাসায় নিয়ে আসাটা ঠিক হয়নি। তার বাবার রাগ করাটাই স্বাভাবিক। বাবার জায়গায় সে হলেও হয়তো একই কাজ করতো। কিন্তু নায়লা নামের মেয়েটাকেতো সে ইচ্ছে করে আনেনি। তার পেছনে একটা কারন আছে। কারনটা বলা যায়……

চলবে ...।

** গল্পটা  ৪পর্বে শেষ হবে।

#৩

0 Shares

৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ