আজ ২৩ জুলাই
নিঃসঙ্গ সারথী তাজউদ্দীন আহমেদের আহমদের আজ জন্ম দিন।
বঙ্গবন্ধু্র অন্যতম সহচর বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী
একজন সৎ ও নির্লোভ মানুষ।
একজন তাজউদ্দীন।

যার ছিল ক্ষুরধার কিন্ত বরফশীতল রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও মনন। মুলত ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করার পর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার পর প্রথমে আত্মরক্ষা তারপর প্রস্তুতি এবং সর্বশেষে পাল্টা আক্রমণ এই নীতিকে সামনে রেখে তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার জন্য কাজ শুরু করেন।
তাজউদ্দীনের ভাষায়, 'আমি সেদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বার্থে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তা হলো : একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার জন্য কাজ শুরু করা ।

তাজউদ্দীন আহমদ ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই গাজীপুর জেলার অন্তর্গত কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর পিতা মৌলভী মোঃ ইয়াসিন খান এবং মাতা মেহেরুননেসা খানম
৪ ভাই, ৬ বোনের মাঝে ৪র্থ তাজউদ্দীন আহমদ। তার পড়াশোনা শুরু বাবার কাছে আরবি শিক্ষার মাধ্যমে।
১ম শ্রেণীতে ভর্তি হন বাড়ির দুই কিলোমিটার দূরের ভূলেশ্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, পরবর্তীতে ৪র্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন কাপাসিয়া মাইনর ইংলিশ স্কুলে। এরপর পড়েছেন কালিগঞ্জ সেন্ট নিকোলাস ইনস্টিটিউশন, ঢাকার মুসলিম বয়েজ হাই স্কুল ও সেন্ট গ্রেগরিজ হাই স্কুলে ।

তাজউদ্দীন আহমদ শৈশব থেকেই দুর্দান্ত মেধাবী ছিলেন , পরবর্তীতে যার ছাপ ছিiলো তার কর্ম জীবনেও তিনি ম্যাট্রিক (১৯৪৪) ও ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় অবিভক্ত বাংলার সম্মিলিত মেধাতালিকায় যথাক্রমে দ্বাদশ ও চতুর্থ স্থান (ঢাকা বোর্ড ) অধিকার করেন, এবং ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে বি.এ (সম্মান) ডিগ্রী অর্জন করেন তাজউদ্দীন । জেল জুলুম কিছুই দমাতে পারেনি তাকে তার প্রমাণ ১৯৬৪ সালে রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে কারাগারে থাকা অবস্থায় এল.এল.বি. ডিগ্রীর জন্য পরীক্ষা দেন এবং কৃতিত্বের সাথে পাস করেন।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে নানান ধর্মঘট-কর্মসূচী ও বৈঠকে ছিলো তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান। ২৪ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সাথে বৈঠকেও গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতি ছিলো তার। উনপঞ্চাশের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন, ছিলেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য।

এই রাজনীতিবিদ ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত ঢাকা জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগের (পরিবর্তিত আওয়ামী লীগ) সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৪-এর নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী হিসেবে মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদককে পরাজিত করে পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১
৯৬৪ সালে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
৬৬ তে বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা দাবি উত্থাপন কালে তিনি লাহোরে সেই সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটিতে অন্যতম সদস্য ছিলেন , এবং ঐ বছরেরই ৮ মে তিনি দেশরক্ষা আইনে গ্রেফতার হন। ১৯৬৮ সালে জেলে থাকা অবস্থাতেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে পুণঃনির্বাচিত হন তাজউদ্দীন ৬৯’এর গণঅভ্যুত্থানের ফলশ্রুতিতে জেল থেকে মুক্তি পান এবং ৭০ সালে তৃতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন।এবং ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

প্রথমে আত্মরক্ষা তারপর প্রস্তুতি এবং সর্বশেষে পাল্টা আক্রমণ এই নীতিকে সাংগঠনিক পথে পরিচালনার জন্য সরকার তিনি সরকার গঠনের চিন্তা করতে থাকেন। তাই তাজউদ্দীন আহমদ আত্মগোপন করেন এবং যুদ্ধকে সংগঠিত করার জন্য সীমান্তের দিকে যাত্রা করেন।
এরই মধ্যে ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় তিনি ফরিদপুর কুষ্টিয়া পথে পশ্চিম বাংলার সীমান্তে পৌঁছান এবং মেহেরপুর সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পদার্পণ করেন।

সীমান্তে পৌঁছে তাজউদ্দিন দেখেন যে বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী সেনাদের সমর্থনে ভারত সরকার থেকে নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ভারতীয় সামরিক বাহিনী এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কিছুই কিচছু করতে পারছেনা।
এরপর তাজউদ্দীন দিল্লীতে গেলে ৪ঠা এপ্রিল দিল্লীতে ইন্দিরা গান্ধীরসঙ্গে তার আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়। ১০ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ ঘোষনা করা হয়, এবং ১১ এপ্রিল তিনি বেতারে ভাষণ দেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। তাজউদ্দীন আহমদ হন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। অস্থায়ী সরকার ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত তাজউদ্দীন আহমদ দৃঢ়তা ও নিষ্ঠার সাথে এতে নেতৃত্ব দেন।

তিনি নরমসরম মানুষ হলেও দেশের সম্মানের ব্যাপারে ব্যাপারে ছিলেন ইস্পাতদৃঢ় মানসিকতার। ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠনের পর তাজউদ্দিন আহমেদ ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে সাথে নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু ভারতের সীমান্তে পৌঁছে, তিনি বিনা প্রটোকলে ভারতে প্রবেশ করেননি।
তিনি ঐ সময় বলেন, একটি স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অন্য দেশে তিনি কোন প্রটোকল ও আমন্ত্রন ছাড়া প্রবেশ করতে পারেন না।
এটা করলেও তার দেশের জন্য অসম্মানজনক। অতঃপর ওপারের ভারতীয় বাহিনী তাকে গার্ড অফ অর্নার দিয়ে ভারতে নিয়ে যায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে আসলে তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান।
তিনি অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এবং ৭৩-এ ঢাকা-২২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন । এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় বাজেট পেশ করেন তিনি।

১৫ আগস্ট, ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করার পর হত্যাকারীদের নির্দেশে তাজউদ্দীন আহমদকে গৃহবন্দী করা হয়।
২৩ আগস্ট সামরিক আইনের অধীনে তাজউদ্দীন আহমদ-সহ ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়।
৩রা নভেম্বরে কারাগারের ভিতরে তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মোঃ মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকেনৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ।

তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন দুঃসময়ের কাণ্ডারি , বহুমুখী প্রতিভাধর মানুষ। তার হাত ধরেই তার সুযোগ্য পরিচালনায় রক্তস্নাত জন্ম নেয় বাংলাদেশ। দেশের জন্মের সাক্ষী এই নিঃসঙ্গ সারথীর আজ জন্মদিন ।
অন্তরের অন্তস্থল থেকে শ্রদ্ধা এবং শুভকামনা জানাই তাকে ,যেখানে আছেন খুব খুব ভালো থাকেন প্রিয় তাজউদ্দীন।

0 Shares

৩০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ