বাংলাদেশীয় চলচ্চিত্রে একজন কালজয়ী অভিনেতা যাকে আমরা নায়ক রাজ রাজ্জাক নামে চিনি।এ দেশের চলচ্চিত্র নিয়ে প্রকাশিত একটি পত্রিকা চিত্রালীর সম্পাদক আহমদ জামান চৌধুরী তাকে নায়করাজ প্রথম উপাধি দিয়েছিলেন সেই থেকেই আব্দুর রাজ্জাক কোটি দর্শকের মনে গেথে আছে নায়ক রাজ হিসাবে।তার জন্ম স্থান মুলত কলকাতায় হলেও জীবনের অধিকাংশ সময় বাংলাদেশে কাটিয়েছেন।তিনি যখন সপ্তম শ্রেণীতে অধ্যয়ন রত সে সময় কলকাতায় এক মঞ্চ নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে তার অভিনয় জীবন শুরু করেন।এর পর ১৯৬৪ সালে আলে দাঙ্গার উত্তাল সময়ে নতুন জীবন গড়তে এক জন সাধারন মানুষ হিসাবে আবদুর রাজ্জাক পরিবার সহ ঢাকায় চলে আসেন তখন তিনি ছিলেন প্রায় অসহায় অবস্থায়।কঠোর পরিশ্রম আর জীবনের প্রতিটি মহুর্তের সাথে সংগ্রাম করে উপাধি পেয়েছেন আজকের এই নায়ক রাজ নাজ্জাক।তবে তিনি তৎকালীন(পাক) সময়েও দর্শকের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন।আর এই জন প্রিয়তা অর্জন করেছেন পাকিস্তান টেলিভিলশনে ঘরোয়া নামের ধারাবাহিক নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে।জীবনে নানা সংগ্রামের পথ অতিক্রম করে তিনি।তার পর আব্দুল জব্বার খানের সহযোগিতায় তিনি একবাল ফিল্মে কাজ করার সুযোগ লাভ করেন।তিনি উজালা ছবিতে কাজ শুরু করেন পরিচালক কামাল আহমেদের সহকারী হিসাবে।এর পর সালাউদ্দিন প্রোডাকশন্সের তেরো নাম্বার ফেকু অস্তাগড় লেন চলচ্চিত্রে ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করে সবার কাছে নিজ মেধার পরিচয় দেন তিনি।পরবর্তীতে ‌কার বউ,ডাক বাবু, আখেরী স্টেশন সহ আরও বেশ কটি ছবিতে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করে তিনি এবং ১৯৬৬ সালে জহির রায়হানের বেহুলা চলচ্চিত্রে নায়ক হিসেবে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশী চলচ্চিত্রে তার অভিষেক ঘটে।
মহান এই নায়কের পুরো নাম আব্দুর রাজ্জাক।ডাক নাম ছিলো রাজু, রাজ্জাক, রাজা।তিনি ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি কলিকাতার টালি গঞ্জের নাগ তলায় জম্ম গ্রহন করেন।তার পিতার নাম আকবর হোসেন এবং মাতার নাম নিসারুন নেস।তার তিন ভাই তিন বোন তাদের মধ্যে তিনিই ছোট।তিনি সর্ব প্রথম কলকাতার শিলা লিপি নামে একটি ছবিতে অভিনয় করেন।তিনি ১৯৬২ সালে খায়রুন নেসাকে (লক্ষ্মী) বিয়ে করেন।তিন পুত্র (বাপ্পারাজ, বাপ্পি, সম্রাট) দুই কন্যা (শম্পা, ময়না) এবং স্ত্রী খায়রুন নেসাকে নিয়ে কলমাপুর বসতি স্থাপন করেন।তিনি নায়ক হিসাবে প্রথম বেহুলা ছবিতে অভিনয় করেন।তার সর্ব প্রথম প্রযোজিত ছবি আকাঙাক্ষা এবং পরিচালক হিসাবে প্রথম ছবি অনন্ত প্রেম।তার জীবনের সেরা প্রাপ্তি ইউনিসেফের শুভেচ্ছা দূত হওয়া।

এই মহান নায়ক সম্পর্কে আমার প্রথম জানার সুভাগ্য হয় আমার দেখা জীবনের প্রথম বাংলাদেশী সাদা কালো ছবি রাজ্জাক/ববিতার "সূখে থেকো"।সেই থেকেই রাজ্জাকের ভক্ত আমি।আজকের সিনেমা দেখা যতটা সহজ হলে গিয়ে সিনেমা দেখাটা ততটা সহজ তখনকার আমলে ছিলো না।পারিবারিক শাসন বারণের কারনে অনেকটা পরিবারের চোখে ফাকি দিয়েই সিনেমা দেখতে হতো।সে সময় টিভিতে একটি বাংলা ছবি দেখতে অপেক্ষা করতে হতো মাসকে মাস।এ ছাড়া যে দিন বাংলা ছবি হবে সে দিনের জন্য বহু আগ থেকেই প্লানিং করতাম কোথায় কখন কিভাবে ছবিটি দেখতে যাবো কারন সে সময় আজকের মতো ঘরে ঘরে টিভি সেট ছিলো না।সারা পাড়ায় বা গ্রামে দু এক জনের ঘরে সাদা কালো টিভি ছিল।আর ছিলো পাড়া মহল্লার ্ক্লাবগুলোতে যেখানে আমার মতো পিচ্চিদের মাঝে মধ্যে টিভি দেখা নিষেধ ছিলো।এক বার তার "অশিক্ষিত" ছবি দেখতে গিয়ে রোড পারাপারে রিক্সার চাকায়ঁ পিষ্ট হয়ে আমার হাত হাটুতে বহু রক্ত ঝরেছিলো।
"আয়নাতে ঐ মুখ দেখবে যখন" টেলিফোনে গানটি যদি অজ্ঞ না হই তবে এটাই ছিলো সম্ভবত উপমহাদেশের কোন এক ছবিতে টেলিফোনে প্রথম গান।নায়কের বচন ভঙ্গি অভিনয় এতো সুন্দর করে উপস্থাপন করেছেন যে চির স্বরণীয় হয়ে রইলেন।সুদর্শন চেহারা আর অনবদ্য অভিনয় দিয়ে মন যুগিয়ে রেখেছিলেন সেই সত্তর দশক থেকে বাকি শতাব্দীর পুরোটাই।"নীল আকাশের নিচে আমি রাস্তা চলেছি একা..অশিক্ষিত ছবির মাষ্টার সাব আমি নাম দস্ত " ও চোখেঁ চোখ পড়েছে যখনি"..তুমি যে আমার কবিতা গানগুলো শুনলে আজও মানুষ চলন্ত পথে একটু হলেও থমকে দাড়ায়।ছুটির ঘন্টার অনুতপ্ত ময় অভিনয় দর্শকদের মাত করে দেন।

প্রিয় নায়ক রাজ রাজ্জাককে আজ থেকে প্রায় বিশ বছর পূর্বে সরাসরি দেখা ও কথা বলার সুযোগ হয়েছিলো আমাদের এলাকায়।আমাদের এলাকায় বোম্বের খালেক
সাহেবের বাড়ীর সামনে সুন্দর বড় একটি পুকুর ছিলো যা শীতলক্ষ্যার শাখা নদী কংস ভাগ হয়ে অবশিষ্ট পুকুর ছিলো এটি এখানেই প্রতি বছর রাজ্জাক বড়শিতে মাছ শিকারে আসতেন।সকাল সন্ধ্যা সে মাছ ধরতেন।সেখানে তার সাথে কথা হয়,খুব মিষ্টি ভাষা সম্পর্কিত এক অমায়িক ব্যাক্তিত্ব ছিল তার।

তার জীবনদ্দ্যোশায় তার প্রতিটি ছবি ছিলো জনপ্রিয়তার শীর্ষে।সে সময় এমন কোন বাংলাদেশী ছিলেন না যারা রাজ্জাক/শাবানা অথবা রাজ্জাক/ববিতার  ছবি দেখে চোখের জল ফেলেননি।সিনেমা শেষে হল থেকে বের হবার পথে চোখের জল মুছেননি।মনে দাগ লেগে থাকার মতো ছিলো তার অভিনয় কৌশল।মাটির ঘর,ময়না মতি,বেহুলা, আগুন নিয়ে খেলা, এতটুকু আশা, নীল আকাশের নীচে, জীবন থেকে নেয়া, ওরা ১১ জন, অবুঝ মন, রংবাজ, আলোর মিছিল, অশিক্ষিত, ছুটির ঘণ্টা এবং বড় ভালো লোক ছিল সহ মোট ৩০০টি বাংলা ও উর্দু ভাষার চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি ১৬টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন।নায়ক রাজ রাজ্জাক প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন ‘কি যে করি’ ছবিতে অভিনয় করে।এর পর ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকার সংস্কৃতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য তাকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।১৯৭৬,১৯৭৮,১৯৮২,১৯৮৪ ও ১৯৮৮ সালে তিনি মোট পাঁচ বার শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন যা বাংলা চলচ্চিত্রে বিরল।২০১৩ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তাকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার প্রদান করা হয়।এছাড়াও তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য বাচসাস পুরস্কার, মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার সহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন।
তিনি শুধু নায়কই নন তিনি ছিলেন একাদারে নায়ক প্রযোজক ও নির্মাতা বা পরিচালক।তার প্রযোজনা সংস্থা রাজলক্ষী প্রডাক্টশন।‘আয়না কাহিনী’ ছবিটি নির্মাণ করে বেশ বাহবা কামিয়েছেন চলচ্চিত্রাঙ্গণে।তিনিই প্রথম রংবাজ ছবির মাধ্যমে বাংলাদেশী সিনেমায় অ্যাকশান এনেছেন।এ ভাবে সকল সংস্কৃতি অঙ্গণে তার পদ চারণা হয়।তিনি সর্বশেষ অভিনয় করেছেন ছেলে বাপ্পারাজ পরিচালিত ‘কার্তুজ’ ছবিতে।তার দুই ছেলেই চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত।
বিভিন্ন গন মা্ধ্যমে নায়ক রাজের কিছু কথা দর্শকদের মনে গেথে রবে আজীবন।চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে কেউ যখন তখন ডাকলে তাতে সাড়া দিতেন তিনি অনায়াসে।তাকে বলতে শুনা যায়
‘আমি রাজ্জাক হয়তো অন্য কোনো চাকরি করতাম অথবা ঘুরে বেড়াতাম।কিন্তু ছোট বেলার অভিনয় প্রচেষ্টাকে আমি হারাতে দিতে চাইনি।আমি মুলত মঞ্চ নাটক থেকে চলচ্চিত্রে এসেছি।সবাই আমাকে চিনেছে।পেয়েছি সাফল্যও।বাংলার মানুষ জন আমাকে এক জন অভিনয় শিল্পী হিসেবেই দেখেন ও আমাকে ভালোবাসেন।আজকে আমার যা কিছু হয়েছে,সবই এই চলচ্চিত্র শিল্পের কল্যাণে।’তিনি এও বলেছিলেন,‘বাংলাদেশের ছোট একটি দেশ হতে পারে,তার পরও এই দেশের এক জন অভিনয় শিল্পী হিসেবে আমি গর্ববোধ করি।যাঁদের জন্য আমি রাজ্জাক হয়েছি,আমি সব সময় তাঁদের কাছা কাছি থাকতে চাই।’
২০১৬ সালে ৭৫তম জন্ম বার্ষিকীতে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষৎকারে রাজ্জাক বলেন,"আমি আমার জীবনের অতীত ভুলি না।আমি এই শহরে রিফিউজি হয়ে এসেছি।স্ট্রাগল করেছি।না খেয়ে থেকেছি।যার জন্য পয়সার প্রতি আমার কোন দিন কোন লোভও আসেনি।আর তা আসেনি বলেই আজকে আমি এতদূর শান্তিতে আসতে পেরেছি।"

২১ আগষ্ট ২০১৭ বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে হার্ট অ্যাটাক হওয়া অবস্থায় নায়ক রাজ্জাককে হাসপাতালে আনা হয় বেসরকারি ইউনাইটেড হাসপাতালে।হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সব ধরনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলে বিকাল ৬টা ১৩ মিনিটে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।আমারা এ মহান নায়কের স্রষ্টার দরবারে আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

কৃতজ্ঞ:
উইকিপিয়া ও অনলাইন মাধ্যম।

0 Shares

১৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ