নাটকীয়তা

জাকিয়া জেসমিন যূথী ১৯ এপ্রিল ২০২০, রবিবার, ০২:৩৭:২৩পূর্বাহ্ন গল্প ২২ মন্তব্য

(বাকী অংশ)

নাম্বার ডায়াল করতেই পরিচিত রিং টোনটা শোনা গেলো মায়ের ঘর থেকে। ছুটে গেলো মা মেয়ে। খাটের নিচে মোবাইলের লাইট জ্বলছে আর নিভছে। “আম্মু, ওই যে তোমার মোবাইল টা” বলেই উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে সেটা তুলে নিয়ে এসে মায়ের হাতে দিলো অবন্তী।

দিনের বেলায় অবন্তীদের বাসায় মানুষের ঢল নামলো। চাচা, ফুপা সহ সবাই চলে এসেছে। ফিরোজ ফুপা বলে গেলো, “রাতে বাথরুমের দরজা লাগিয়ে শুবেন, ভাবী। আজকাল বাথরুমের ছোট ফ্যান খুলে ডাকাতি হয়।“

সে রাতে শোবার সময় হলে সব জানালার লক আটকে দেয়া হলো। কদিন সব ঠিক। এরপরেই ওই নতুন ঝামেলা। দাদির বাসায় মাঝরাতে বেল দেয়া। একদিন হলে তাও কথা ছিলো। হচ্ছে কদিন পরপরই। মাঝরাতে বেলের শব্দ শুনে এখন দাদী পাশের ফ্ল্যাটে অবন্তীর মাকে ফোন দেয়, “এই যে এখনই বেল দিলো। বউমা দেখো তো একটু!” অত রাতে সিড়ি ঘরে কেউ আছে কিনা তা বের হয়ে দেখতে অবন্তীর আম্মুর ভয় লাগে, তার ঘরে তো পুরুষ মানুষ নেই। দোনমনো করে উপরতলায় থাকা অবন্তীর ছোট ফুপিকে ফোন দেয়। ছোট ফুপি আবার তার ভাইকে। এভাবে সারা বাড়ি জেগে ওঠে। কিন্তু কেউই মাঝ রাতের অতিথিকে বরণ করার সাহস করে না। দরজার কী-হোলে চেয়েই চোর ধরতে চায়।

ওদিকে প্রায় এক সপ্তাহ না ঘুমাতে না ঘুমাতে অবন্তী অতিষ্ট। ওর মতো এই বাসার চাচাতো-ফুপাতো ভাই-বোনও অস্থির। এর একটা বিহিত করতেই হবে। এভাবে আর চলছে না! ওরা নিজেরা ভয় না পেলেও প্রতি রাতেই যে একটা নাটক শুরু হয় সেটা বন্ধ না হলে তো আরামে ঘুমানো যাচ্ছে না। পড়াশুনারও ক্ষতি হচ্ছে। অবন্তীর চাচাতো-ফুপাতো সব ভাই বোন মিলিয়ে মোট আটজন- সায়েম, নায়েম, সুচি, ইশরাক, ইশমা, তুরীন, তামিম। এদের মধ্যে অবন্তীই বড়। বাকীরা সব ওর চেয়ে দু এক বছরের ছোট। আলোচনার বিষয়, “কে এই চোর? একা আসে নাকি কয়েকজন?” আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হলো, সন্দেহভাজনের উপরে নজর রাখতে হবে। দুই রাত পেরিয়ে গেলো তেমন কিছুই ঘটলো না। চোরের পাত্তা পাওয়া গেলো না। কেউ বেল দিলো না। কেউ সিড়ি ঘরে হাঁটলো না। তৃতীয় রাতে সন্ধ্যার দিকে সায়েম একবার গিয়ে পুনরায় চেক করে এসেছে।

ভাগ্যটা প্রসন্ন! সেদিন রাতেই ঘটলো কাণ্ডটা। সায়েম আর নায়েম তখন জেগে ছিলো। হঠাৎ ধুরুম শব্দে কিছু পরলো। প্রায় সাথে সাথেই পিছলে যাওয়ার শব্দ। পরতে পরতে এসে চারতলার বাইরের দরজার কাছেই ধুরুম করে পরলো। শব্দটা বেশ জোরেই হয়েছে। শব্দ পেয়ে সব ভাই-বোন সতর্ক হয়ে গেছে। বড়রাও জেগে উঠেছে। চারতলা ও তিন তলার বাসার দরজা এক সাথে খুলে গেলো। দরজা খোলার শব্দে দুদ্দাড় দৌঁড়াদৌঁড়ি শুরু হলো। পিছলে পরেছে যারা তাদের একজন গেলো নিচের দিকে। দোতলা পর্যন্ত যাওয়ার আগেই ইশরাক আর ওর বাবা গিয়ে ওটাকে আটকালো। কিছুক্ষণের মধ্যেই চারতলা থেকে ঘাড় ধরে আরও দুটো ছেলেকে টেনে নামালো আকমল চাচা। হিড় হিড় করে টেনে একেবারে নিচ তলার পূর্ব পাশের বাসার দরজার কাছে গিয়ে থামলো। যেখানে ভাড়াটিয়া মুহিদুল সাহেব থাকে। জুতার ব্যবসায়ী!

কিছুক্ষণ পরে থানা থেকে পুলিশ ডেকে আনা হলো। তিনটা ছেলেকেই থানায় নিয়ে যাওয়ার সময় থানার অফিসার এক তলার ভাড়াটিয়া মুহিদুল সাহেবকেও সাথে যেতে বললো। ভদ্রলোক বলে উঠলো-“আমাকে কেন?” পুলিশ অফিসার বললো-“আসুন। কিছু ফর্মালিটিস আছে!” অগত্যা তাকে সাথে যেতেই হলো। এ বাসা থেকে অবন্তীর আকমল চাচা আর আজাদ চাচাও সাথে গেলো।

সবাই মিলে থানায় চলে যাবার পরে বাসার অন্য সবাই মিলে অবন্তীদের ঘরে বসলো। আর কিছুক্ষণ পরেই ফজরের আজান দিবে। কিভাবে কি হলো ইশরাক, সায়েম, নায়েম, অবন্তীরা এক যোগে উত্তেজিত স্বরে বর্ণনা করতে লাগলো। বাড়ির অভিভাবকদের বললো-“তোমরা তো ছোটদের কথাকে পাত্তাই দিতে চাওনা। আমরা আগেই ধারণা করেছিলাম। এতদিন এই বাসায় কোন অঘটন ঘটেনি। এই ভাড়াটিয়া আসার পর থেকেই চোরের আনাগোনা। আগেই বুঝেছিলাম-এদের মধ্যেই কোন গন্ডগোল আছে! পরে টার্গেট করলাম! দেখলা তো কিভাবে খেল খতম করলাম!”

অবন্তীর মা সহ সব ফুপিরা এক যোগে বলে উঠলো, “তোরা আবার কী করেছিস?”

ইশমা আর তুরীন একসাথে উচ্চারণ করলো প্রায়, “এই তেমন কিছু না! এটা আমাদের জন্য অবন্তী আপার একটা এসাইনমেন্ট ছিলো। আর তাতেই নাটের গুরু ধরা পরে গেলো।“

ছোট ফুপি রেগে বললো, “কিসের এসাইনমেন্ট? কী বলছিস এসব?”

ইশরাক ওর মুরুব্বীয়ানা কণ্ঠে ভাষণ শুরু করলো, “শোন আম্মু, রাত জেগে থাকি বলে তো শুধু বকাঝকা করো। রাতে যে কত অসম্ভব কাজের সমাধা হয় তা তো জানো না। আচ্ছা যাক, আমরা সবাই মিলে চাঁদা তুলে দুই ক্যান তেল, আলকাতরা, আলপিন, সূচালো বোর্ড পিন, মারবেল কিনেছিলাম। আর রান্নাঘর থেকে অবন্তী আপু সরিয়েছে শুকনা মরিচের গুড়া।“ এই পর্যায়ে আসতেই অবন্তীর মায়ের মুখ খুলতে যাচ্ছিলো। কিন্তু বাচ্চাদের অসমসাহসিকতার গল্প শুনতে গিয়ে মুখ বন্ধই রাখলো। ইশরাক বলে চলেছে, “সেগুলো বাউণ্ডারীর উপরে, দুই বাড়ির মাঝের চিপাগলিতে, ছাদের সিড়ি আর দাদীর ঘরের দরজার সামনের সিড়ি ঘরের আশেপাশে প্রত্যেক রাতে ঘুমোবার আগে সাজিয়ে রেখেছি।“

বলিস কী? এতকিছু হয়ে গেছে! কই আমরা তো কিছু টের পেলাম না!” অবন্তির আম্মু বিস্ময়ে হতবাক।

এবার ক্লোজ আপ এর বিজ্ঞাপনের মত ঝকঝকে সাদা দাঁতের হাসিতে হেসে সূচি আর নায়েম বললো, “সিড়ি ঘরের মঞ্চ পরিবর্তনের দায়িত্বে ছিলাম আমরা দুজন। সকালে ময়লাওয়ালা ময়লা নিতে আসার আগেই সিড়িঘর ফকফকা!”

 

ঘন্টাখানেক পরে চাচা আর ফুপা বাসায় ফিরলে শোনা গেলো আরও বড় খবর! নিচতলার ভাড়াটিয়া মুহিদুল নামের লোকটা সাধারণ ভাড়াটিয়া নয়। ওর নামে কতগুলা কেস আগে থেকেই ছিলো। অফিসার ওর চেহারা দেখেই ইচ্ছে করেই রুটিন চেক আপের কথা বলে থানায় নিয়ে যায়। ওর সাথে সাবলেট হিসেবে থাকা ছেলেগুলো মোটেও ছিচকে চোর বা হেরোইনসেবী নয়। অথচ অবন্তী সহ সব কাজিনরা মিলে শুধু এতটুকুই আন্দাজ করেছিলো। এদের ডাকাতির প্ল্যান ছিলো। বেশ কিছুদিন ধরেই এরা এই এলাকায় আস্তানা গাঁড়ে। খোঁজ নিয়ে জেনেছিলো এই একমাত্র এই বাসাটাতেই নিরাপত্তার জন্য তেমন কোন শক্ত ব্যবস্থা নেই। আর এ বাসার প্রতিটা ঘরেই মাত্র একজন শক্ত সমর্থ পুরুষ। তার উপরে দোতলায় পুরুষ মানুষ বলতে গেলে নেইই। ভাড়াটিয়া হিসেবে উঠলেও ওরা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো।

আগেই অবন্তীদের প্লান শুনে বড়রা টাসকি খেয়েছিলো! থানার খবরটা শুনে হার্ট ফেল করার অবস্থা! আল্লাহ জোর বাঁচা বাঁচিয়ে দিয়েছে! বাবারে বাবা! মুখ দেখে লোক চেনা যায়?

সমস্ত ঘটনা শুনে অবন্তীর দাদী বললো, “ব্যাচেলর ভাড়া দেয়ার সময় আমি কিন্তু মানা করছিলাম! আমার কথায় তো কান দেও নাই তখন! থাক! আর এ বাড়িতে ভাড়াটিয়া রাখতে হবে না। বরং কোচিং সেন্টারটাকে পূব পাশে দিয়ে দাও। আর রাস্তার পাশে একটা ফার্মেসী বানাও। ওখানে বাড়তি লোক রাখারও প্রয়োজন নেই। এ বাসার কলেজ পড়ুয়া নাতি-নাতনীরা সময় দিলেই হবে। বাড়ির ভেতর আর বাইরের লোক ঢুকাবা না! কার মনে কি আছে এতকিছু খুঁজে দেখার সময় কোথায়? যথেষ্ট শিক্ষা হইছে!”

অত বড় দূর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়ে বাড়ির সকলে মুরুব্বীর এই উপদেশ আর ফেলতে পারলো না। দেরীতে হলেও একটা শুভ বুদ্ধির উদয় হলো। এতদিনে সকলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

 

চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে! এতদিন ধরে এলাকায় থাকা কোনদিন যখন কোন অঘটন ঘটেনি তো আজ ঘটবে কেন? এরকম হালকা ভাবনা থেকেই এরকম কঠিন বিপদে পরতে যাচ্ছিলো আহমেদ ফ্যামিলির মানুষগুলো। এর পরে উপরের ছাদের মজবুত একটা গেট লাগানো হলো। প্রত্যেক ফ্লোরের প্রত্যেক জানালাকে রড দিয়ে মজবুত খাচা লাগিয়ে দেয়া হলো যাতে আর জানালা দিয়ে কেউ কিছু চুরি করতে বা জানালা ভাংতেও না পারে। বাইরের গেটের সাথে মূল ভবনের ভেতরে যেন আর কোনভাবেই চোর-ডাকাত আক্রমণ করতে না পারে সেই ব্যবস্থাও নেয়া হলো।

ক্লাব থেকে এবার ভুতেরগলির প্রত্যেক গলির জন্য একজন করে নাইট গার্ড নিয়োগ দেয়া হলো। এলাকায় শান্তি ফিরে এলো।

(সমাপ্ত)

আগের পর্ব

0 Shares

২২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ