
দুষ্ট প্রকৃতির শিশু-কিশোরদের কাজই হচ্ছে খেলার ছলে নিজেদের মাঝে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়া। কিন্তু তারা নিজেরাই বুঝে না তাদের খেলার আনন্দ কারো জীবনাবসানের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। জুন মাসের ৮ তারিখে গিয়েছিলাম নীললেজ সুঁইচোরা পাখির ছবি তোলার জন্য ময়মনসিংহের বরুরা গ্রামে। সেখানে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ মোড় থেকে কিছুটা পথ নৌকায় যেতে হয়।
নৌকায় বসেই দেখতে পেলাম নীললেজ সুঁইচোরা ব্রহ্মপুত্র নদীর পাড় ধরে কলোরব আর চেঁচামেচি করে যাচ্ছে। নদীর ধারে মাটিতে গর্ত করে তাদের বাচ্চাদের মুখে খাবার দেয়ার জন্য উড়োউড়ি করছে। প্রতিটি বাবা-মা’র মুখে খাবার হিসেবে রয়েছে পতঙ্গ। বরুরা গ্রামের নৌকাঘাটে পৌঁছে কিছুটা পথ হাঁটতে হলো। হাঁটার পথেই দেখলাম নদীর ধারে যেখানে সুঁইচোরা বাসা করেছে সেই বাসার মুখ থেকে প্রায় ৫/৬ ফুট দূরে মাটি গর্ত করা। গর্ত দেখে বুঝতে অসুবিধে হলো না কিশোর বাচ্চারা সুঁইচোরা পাখির বাচ্চা মাটি খুঁড়ে বের করে নিয়ে গেছে।
বর্তমানে প্রকৃতির বাধার বাইরেও এই দুষ্ট প্রকৃতির শিশু-কিশোররাই পাখিগুলোর বেঁচে থাকার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদের শিক্ষামূলক উপদেশ দিয়ে যদি এপথ থেকে ফেরানো না যায় তাহলে একদিন এই পাখিগুলি বংশবৃদ্ধিতে বাধাগ্রস্থ হয়ে হারিয়ে যাবে। প্রকৃতি হারাবে তার সৌন্দর্য, আর আমরা হারাবো এই আবাসিক পাখি।
নীললেজ সুঁইচোরা Meropidae পরিবারের পতঙ্গভুক পাখি। এই পরিবারের প্রায় ২৬ প্রজাতির সুঁইচোরা পাখি বিশ্বে দেখা যায়। বাংলাদেশে আছে ৪ প্রজাতির। এরা ২৭ থেকে ৩১সে.মি. দৈর্ঘ্যে লম্বা লেজওয়ালা উজ্জ্বল সবুজ বর্ণের পাখি। এদের কোমড়, লেজ, লেজতলের ঢাকনি নীল বর্ণের হয়ে থাকে। বুকে অনেকটা নীলের আমেজ পাওয়া যায়। হলুদ বর্ণের থুতনি ও তামাটে গলা ছাড়া পুরা দেহটাই সবুজ বর্ণের হয়ে থাকে। এদের কপাল সবুজ। চোখে কালো লাইন ও সরু নীল বর্ণে ঘেরা থাকে। ঠোঁট কালচে বর্ণের ও লম্বা। চোখের চারপাশ রক্তের মতো লাল টকটকে ও মাঝে কালো বিন্দু। এদের পা ও পায়ের পাতা মেটে ফিকে বর্ণের ও কালচে বাদামী রঙের। পুরুষ ও মেয়ে পাখির চেহারায় পার্থক্য নেই। শুধুমাত্র মেয়ে পাখির লেজ লম্বা হয় না। তাছাড়া দেহের অন্যান্য রঙে কোনো তারতম্য নেই। বাচ্চা পাখিগুলো বয়স্ক পাখি থেকে অনুজ্জ্বল রঙের হয়।
নীললেজ সুঁইচোরা সাধারণত জোড়ায় ও মাঝারি আকারে ঝাঁক বেঁধে চলাফেরা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এরা নদীর পানির সামান্য উপর দিয়ে খুব ঘুরাফেরা করে। বাকি সময় গাছের ডালে বসে থাকে। মাঝে মাঝে নদীর পানিতে গা ভিজিয়ে দেহের পালক চুলকাতে খুব পছন্দ করে। এরা গাছের উঁচু ডালে শিকারের জন্য ওঁৎ পেতে থাকে। শিকার পাওয়া মাত্রই বিদ্যুৎ গতিতে ছোঁ মেরে খাবার ধরে ফেলে। উড়ন্ত পোকা-মাকড়, কীট-পতঙ্গ, ফড়িং, বোলতা, মৌমাছি, মথ ও গুবরে পোকা এদের পছন্দনীয় খাবারের তালিকায় আছে। অন্যান্য ফ্লাইক্যাচার পাখির মতই এরা উড়ন্ত অবস্থায় শিকারের মাধ্যমে খাদ্য গ্রহণ করে। এদের গলার স্বর কর্কশ ও উচ্চ স্বরে ডাকে।
নীললেজ সুঁইচোরা পাখি মুক্ত বালিময় এলাকায় নদীর ধারে বৃক্ষপূর্ণ জায়গা ও সুন্দরবনে বিচরণ করে। প্রজনন সময় মার্চ থেকে জুন মাস। এরা এদের কলোনীতে প্রজনন করে। নদীর খাঁড়া তীর, বালুময় পাহাড়ের ধারে বা সমতল বালু তীরে এরা ৫/৬ফুট সুড়ঙ্গ করে নিজেরাই বাসা বানায়। নিজেদের বানানো বাসায় স্ত্রী নীললেজ সুঁইচোরা পাখি ৫-৮টি সাদা বর্ণের ডিম দেয়। স্ত্রী ও পুরুষ পাখি উভয়েই ডিমে তা দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে বাচ্চা ফোটায়। ডিম থেকে বাচ্চা বের হবার পর মা ও বাবাপাখি সন্তানদের বড় ও লালন-পালন করার জন্য দিন রাত পরিশ্রম করে। পালাক্রমে খাদ্যের জোগান দেয়।
নীললেজ সুঁইচোরা বাংলাদেশের সুলভ আবাসিক পাখি। বাংলাদেশের গ্রামে,নদীর পাড়ে ও বনভূমিতে সহজেই দেখতে পাওয়া যায়। তবে রাজশাহী, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ, গোপালগঞ্জসহ প্রায় সব জেলাতেই দেখা যায়। এ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তন, নেপাল, ইন্দোনেশিয়াসহ বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণের দেশগুলোতে এদের বিচরণ বিস্তৃতি রয়েছে।
বাংলা নাম: নীললেজ সুঁইচোরা
ইংরেজি নাম: Blue tailed be eater
বৈজ্ঞানিক নাম: Merops Philippinus
ছবিগুলো ময়মনসিংহের বরুরা গ্রাম থেকে তুলা।
৩১টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া। পাখিটির পরিপূর্ণ তথ্য উপাত্ত উপহার দেবার জন্য। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন শুভকামনা রইলো
শামীম চৌধুরী
আপনিও ভালো থাকুন সুস্থ্য থাকুন দিদি।
সাবিনা ইয়াসমিন
সৃষ্টির অন্যান্য জীব এবং পাখিদের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন কিভাবে করতে হবে সেটা পরিবার থেকেই শিক্ষা দিতে হবে। নয়তো শুধু পাখি নয় আরও অনেক কিছুই বিলুপ্ত হয়ে যাবে প্রাকৃতিক জগৎ থেকে।
ছবি সহ পাখি পরিচিতি পোস্ট পড়ে ভালো লাগলো শামীম ভাই। ইদানীং ব্লগে খুব দেখি আপনাকে। ব্যাস্ততম সময় পার করে আমাদের মাঝেও আসুন প্লিজ।
ভালো থাকুন,
শুভ কামনা 🌹🌹
শামীম চৌধুরী
সাবিনা আপু
ব্লগে আছি। মাঝখানে বেশ কিছু লেখা পোষ্ট করতে যেয়ে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছিলাম। পড়ে অবশ্য সেটা ঠিক হয়েছে। আছি আপু আপনাদের সাথে এবং থাকবো সবাইকে নিয়ে। নিয়মিত হতে পারলে নিজের কাছেই ভালো লাগতো। তবে চেষ্টা চালিযে যাচ্ছি অবিরাম। দোয়া করবেন।
সঞ্জয় মালাকার
দাদ,ছবি সহ পাখি পরিচিতি পোস্ট পড়ে ভালো লাগলো।
ভালো থাকবেন সবসময় শুভ কামনা রইলো।
শামীম চৌধুরী
আপনিও ভালো থাকুন দাদাভাই।
ফয়জুল মহী
প্রকৃতি আর লেখা সবই চমৎকার
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ মহী ভাই। ভালো থাকুন সবসময়।
প্রদীপ চক্রবর্তী
অনেকদিন পর আপনার এমন লেখা পেয়ে আমি মুগ্ধ।
ছবি সহ পাখি পরিচিতি পোস্ট পড়ে খুবি ভালো লাগলো দাদা।
এমন পোস্ট আরও চাই অনেক অনেক।
সাধুবাদ দাদা।
শামীম চৌধুরী
কৃতার্থ দাদাভাই। যাণপরণাই চেষ্টা করে যাবো।
কামাল উদ্দিন
এই পাখিগুলো অনেক সুন্দর, এদের ছবি তোলা অপেক্ষাকৃত সহজ, আমি এদের অনেক ছবি তুলেছি……..সুই চোরা পাখির সাত কাহন জেনে নিলাম আপনার পোষ্ট থেকে, ধন্যবাদ।
শামীম চৌধুরী
জেনে খুব খুশী হলাম কামাল ভাই আপনিও একজন পক্ষী ফটোগ্রাফার। একবার চলুন এক সাথে বের হই পাখির ছবির জন্য।
কামাল উদ্দিন
একবার আপনার মতো গুরু ফটোগ্রাফেরের সাথে বের হওয়ার ইচ্ছেটা রাখলাম ভাইজান।
ইঞ্জা
জিওগ্রাফি চ্যানেলে এদের নিয়ে একটা এপিসোড দেখেছিলাম বলেই এদেরকে চিনি, আজ জানলাম এদের জীবন আচরণ, খুব ভালো লাগলো ভাই।
ধন্যবাদ আমাদেরকে সুন্দর লেখাটি উপহার দেওয়ার জন্য।
শামীম চৌধুরী
বরাবরের মতন এবারও কৃতার্থ ভাইজান।
ইঞ্জা
শুভেচ্ছা ভাই।
সুপায়ন বড়ুয়া
ছবি সহ পাখি পরিচিতি পোস্ট পড়ে ভালো লাগলো শামীম ভাই।
শুভ কামনা।
শামীম চৌধুরী
দাদা শুভেচ্ছা জানবেন ও ভালো থাকবেন।
ছাইরাছ হেলাল
পাখি-পুখি দেখতে ভালবাসি, লিখতে ও। নাম ধাম না জানলেও আমাদের সমস্যা হয় না।
ভালোবাসাটুকুই সব, আপনি যেমন ভালোবেসে প্রান্তরময় চষে/ছুটে বেড়াচ্ছেন।
এ পাখিটি কিন্তু চিনছি!
আপনি কৈ কৈ যে থাকেন!!
শামীম চৌধুরী
আমারও সবটুকু ভালোবাসা আপনাদের জড়িয়ে। আপনি আমার লেখার উৎসাহের যোগানদাতা। ভালো থাকবেন হেলাল ভাই।
সুরাইয়া পারভীন
আহারে! মা পাখি তার সন্তানের জন্য খাবার নিয়ে ঘুরছে আর দুষ্ট ছেলের দল বাচ্চা গুলোকে নিয়ে গেছে 😰এদের সুশিক্ষা দেওয়া উচিত
নীললেজ সুঁইচোরা পাখি সম্পর্কে বিস্তারিত জানানোর জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ দাদাভাই।
ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন সবসময়
শামীম চৌধুরী
সুরাইয়া আপু আপনিও ভালো থাকুন এই কামনা করি।
সুরাইয়া নার্গিস
ধন্যবাদ ভাইয়া পাখিসহ পরিচিত পর্ব দারুন সুন্দর একটা পোষ্ট।
সত্যি পড়ে মুগ্ধ হলাম, পাখি চিনলাম,পাখি সম্পর্কে জানলাম।
ভালো থাকবেন ভাইয়া।
শামীম চৌধুরী
আপনিও ভালো থাকুন নার্গিস আপু।
তৌহিদ
আপনার লেখা মানেই অন্যরকম কিছু। পড়তে ভালো লাগে আমার।
সুঁইচোড়া পাখির ঠোট আর গায়ের রঙ কিন্তু অসাধারণ। টিয়ে পাখির জাতের নাকি ভাইজান এই পাখি?
অনেকদিন পরে আপনার লেখা পেলাম। আশাকরি এই ছুটিতে নিয়মিত পাব আপনার লেখা। ভালো থাকবেন ভাই।
শামীম চৌধুরী
নাহ তৌহিদ টিয়া পাখি অন্য গোত্রের আর টিয়া অন্য পরিবারের।
জিসান শা ইকরাম
কত্ত সুন্দর একটি পাখি!
শিশুরা অনেক পাখির বাচ্চাই নস্ট করে। এদেরকে স্কুলে এ বিষয়ে জ্ঞান দিলে উপকার পাওয়া যেতে পারে।
নীললেজ সুঁইচোরা পাখি মাটির পাঁচ ছয়ফুট গভীরে বাসা বানিয়ে ডিম পারে! ভাবাই যায় না।
অনেক ভালো লেগেছে এই পাখির বর্ননা।
ধন্যবাদ আপনাকে।
মিস করি আপনাকে ব্লগে।
শুভ কামনা ভাই।
শামীম চৌধুরী
আমি মফস্বলের গ্রামে ছবি তুলতে যখন যাই তখন সরকারী প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সাথে দেখা করে পাখি নিয়ে শিশু বাচ্চাদের সাথে ছবি দেখানো সহ আলোচনা করার এক ঘন্টার একটি প্রোগ্রাম করে থাকি। গ্রামের স্কুলগুলি আমার বেশী পছন্দ কারন গ্রামের বাচ্চারাই পাখির বাসা নষ্ট করে ও বাচ্চা বাসা থেকে পেড়ে নিয়ে খাঁচায় পুষতে চায়। অথচ ওরা জানে তিন থেকে চারদিন পর পাখির ছানাগুলি মারা যাবে। এমন ভাবে অনেক স্কুলেই আমি বাচ্চাদের খাঁচায় পাখি পুষা থেকে নিরুৎসাহিত করেছি। পরবর্তীতে ঐ গ্রামে ছবি তুলতে না গেলেও ভিজিট করেছি। তারা অধিকাংশই একাজ থেকে বিরত থেকেছে এবং পাশাপাশি অন্যগ্রামে থাকা বন্ধুদেরও সচেতন করেছে।
মাছুম হাবিবী
দাদা ভাই আপনার লেখাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ি। অনেক অজানা তথ্য জানতে পারি আপনার লেখা পড়ে, বিশেষ করে পাখিদের সম্পর্কে বেশ ভালো তথ্য পাই আপনার কাছ থেকে। এসব পাখির নামই জানতাম নাহ, অথচ আজ জানলাম। আপনার ফটোগুলো দেখলে তাকিয়ে থাকি। সত্যি দাদা অসাধারণ বর্ণনা দিলেন পাখিগুলোর।
শামীম চৌধুরী
কৃতার্থ মাছুম ভাই। আপনাদের উৎসাহ আমার কাজের আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দেয়। ভালো থাকবেন। আমার জন্য দোয় করবেন।
হালিম নজরুল
Love you for this.