বর্তমান বাজারে ধাতব মুদ্রা একটাকা, দুইটাকা আর পাঁচটাকা কয়েনের বোঁজার ভার কমানোর জন্য এক অভিনব কৌশল অবলম্বন করে ফেলেছে কিছু-কিছু দোকানদাররা । কী কৌশল? কেমন কৌশল? তার বিবরণ নিম্নে লিখে জানাচ্ছি । আগে আমার ছোটবেলা একপয়সা, দুইপসা, পাঁচপয়সা, একআনা, দুইআনা জমানোর স্মৃতিচারণগুলো সবাইকে জানিয়ে রাখি । কারণ এই কয়েন বা পয়সার সাথে আমার একটা মধূর সম্পর্ক আছে, যা এখনো আমি সেই সম্পর্ক ছিহ্ন করতে পারিনা । সেই সম্পর্কের টানে এখনো আমি ভাংতি পয়সা বা কয়েন পেলে জমা করে রাখতে মন চায়, তাই জমাও করেছি অনেক, এগুলি এখন চালানো বড় দায় ।

ছোটবেলায় বড়দের দেখাদেখি আমিও ঘরের বাঁশেরখুঁটি কেটে সেই খুঁটিতে ভাংতি পয়সা জমা করে রাখতাম, পূজা-পার্বণে আর মেলায় খরচ করার জন্য ।  কোনো পূজা পার্বণ আসলে জমানো পয়সা বাঁশেরখুঁটি কেটে, পয়সা বাহির করে পূজা পার্বণের মেলা থেকে নিজের মনমতো নানারকম পছন্দের জিনিস কিনে আনতাম । সেই দিন আর এখন নাই, এখন পয়সা জমানোর জন্য বহু রকম আধুনিক জিনিস পাওয়া যায় । এখন অনেক ডিজাইন করা মাটির ব্যাংক, প্লাস্টিকের ব্যাংক পাওয়া যায় সচরাচর যেখানে সেখানে । এই পয়সা জমা করার কাজটি করে থাকে হিসেবি গৃহিণীরা, আর কিছু দোকানদার, আবার কিছু কৃপণ টাইপের মানুষেরা, যাতে নিদানকালে এই জমানো পয়সা দিয়ে কিছু দুরাবস্থা দূর করা যায়, সেই আশায় । সেই আশায় যদি ছাই পড়ে তখন? তখন মাথায় আর কপালে হাত দেয়া ছাড়া আর কিছুই খাকে না । বর্তমানে আমাদের এই বঙ্গদেশে এই কয়েনের ভারে অনেক সাধারণ মানুষ আর দোকানদারের কোমর বাঁকা হয়ে গেছে, সেই কোমড় সহসা সোজা করতে পারছে না । এখন আর গৃহহিনীরা বা দোকানদাররা বাঁশখুঁটিতে পয়সা (বর্তমান কয়েন) জমায় না ভয়ে, কারণ একটাই, তাহলো এই কয়েন একসাথে কেউ একশ টাকার কয়েন নিতে চায় না । তাই কয়েক মাস গত হলেই একজন দোকানদারের কাছে শতশত কয়েন জমা হয়ে যায়, সেই কয়েন কেউ নিতে চায় না বিধায় প্রভাব পড়ে দোকানের চালানের উপর ।

আগেই বলে রাখা ভালো, ক'মাস আগে আমি বিডিনিউজ ব্লগে কয়েন নিয়ে একটা লেখা লেখেছিলাম, লেখার শিরোনাম ছিল 'দুইটাকা পাঁচটাকার কয়েন কি পানিতে ফেলে দিবো মাননীয় অর্থমন্ত্রী? । আজকে আবার সেই কয়েন নিয়েই কিছু লেখতে চাই, প্রিয় সোনেলা ব্লগে । কারণ; এই কয়েন নিয়ে নিজেও সময়-সময় ঝামেলায় পড়ে যাই, যখন একজন দোকানদার একসাথে ১০টা পাঁচটাকার কয়েন নিতে না চায়, তখনই বাঁধে তর্ক-বিতর্ক । আবার রিকশায় চড়ে কোথাও গেলে রিকশাওয়ালাকে দুচারটা কয়েন দিতে চাইলেও রিকশাওয়ালাও কয়েন নিতে চায় না, তাহলে উপায়? উপায় মনে হয় একটাই, তাহলো কয়েন ধুয়ে পানি পান করা । আমি নিজেও দোকানদারদের মতো একজন আমদানিকারক, প্রতিনিদ দোকান-দোকানে গিয়ে আমাদের সমিতির ঋন দেওয়া টাকা আদায় করি । সমিতির পাওনা আদায় করতে গেলে নিজের কাছেও অনেক কয়েন জমা হয়ে যায়, সেই কয়েন আর আমার অফিসে গ্রহণ করেনা, তা আমার কাছেই থেকে যায় । বর্তমানে আমার কাছেও বহু কয়েন জমা হয়ে আছে তা আর একসাথে কাউকে দিতে পারছি না, ভাবছি এই কয়েন দিয়ে কী করবো? এই কয়েন নিয়ে ভাবতে ভাবতে একদিন চোখে পড়ল এক অন্যরকম দৃশ্য । দেখলাম, এই কয়েনের বোঁজা ছোট করার জন্য দোকানদাররা বুদ্ধি করে বাহির করেছে অভিনব কৌশল ।

যা দেখলাম,

একদিন বেলা ১১টায় আমি আমার অফিস থেকে বাহির হয়ে একটা দোকানে আসলাম চা' পান করতে, পাশের একটা স্টেশনারি দোকানের সামনে দেখছি ছোটছোট ছেলে-মেয়েদের ভিড় । কিসের এত ভিড়? জানতে চাইলাম এক লোকের কাছে, লোকটি বললেন আইসক্রিমের জন্য ভিড়, আমি জিজ্ঞেস করলাম কেন? লোকটি জবাব দিলেন, আইসক্রিমের ভিতরে একটাকার কয়েন পাওয়া  যায়, তাই এত ভিড় । আমি তাড়াতাড়ি করে চা' পান করে দৌড়ে গিয়ে দেখি স্কুলের ছেলে-মেয়ে আইসক্রিমের ফ্রীজের উপর হুমড়ি খেয়ে পরছে আইসক্রিমের জন্য ।  আইসক্রিমের দাম দুইটাকা আর চারটাকা, আইসক্রিমের ভেতরে আছে একটাকা আর দুইটাকার কয়েন ।  তাহলে একটা আইসক্রিমের দাম পড়লো মাত্র একটাকা আর দুইটাকা, একটাকা দামের আইসক্রিমের ভেতরে আছে একটাকার কয়েন, আর চারটাকা দামের আইসক্রিমের ভেতরে আছে দুইটাকার কয়েন । দুইটাকা দামেয় আইসক্রিমটা দেখতে একটু ছোট আর চারটাকা দামের আইসক্রিমটা একটু বড় এবং মোটা । ছেলে-মেয়েরা এই কয়েনের লোভে একটা আইসক্রিম নিয়ে, তাড়াতাড়ি করে খেয়ে, আইসক্রিমের ভিতর থেকে ওই কয়েন বাহির করে আবার একটা আইসক্রিম কিনছে । আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি আর ছেলেপেলেদের সাথে মজাও করছি এই কয়েন নিয়ে, এরপর আমি নিজেও একটা আইসক্রিম কিনলাম ওই দোকান থেকে কয়েনটা দেখার জন্য । হাঁ দেখছি, খুব সুন্দর করে আইসক্রিমের নিচের মোটা জায়গায় ঠিক ভাবে একটাকা আর দুইটাকার কয়েনটা বসিয়ে দিয়েছে, যা খেতেখেতে শেষ পর্যায়ে আসলেই সেই কয়েনটা বাহির হয় ।

একটু পর দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম ঘটনাটা কী? আইসক্রিমের ভেতরে কয়েন? দোকানদার বললেন, আমরা অনেক দোকানদার মিলে শলাপরামর্শ করে একটা বুদ্ধি করেছি ভাই । জানতে চাইলাম, বুদ্ধিটা কী? বুদ্ধিটা হলো প্রতিদিন যেহারে এই কয়েন আমাদের কাছে পড়ে, সেই কয়েনগুলি আমরা সহজে চালাতে পারিনা । তাই আমরা আইসক্রিম ব্যবসায়ীকে বলেছি আমারা একটাকার কয়েন আর দুইটাকার দিবো, তোমরা আমাদের যেটা একটাকা দামের আর যেটা দুইটাকা দামের আইসক্রিম দাও সেই আইসক্রিমের ভেতরে এই একটাকার কয়েন আর  দুইটাকার কয়েন ঢুকাইয়ে দিবে । এতে তোমাদের ন্যায্য দাম ঠিকই পাবে, আইসক্রিমও ভালো চলবে আমরাও কয়েনের ঝামেলা থেকে একটু মুক্ত হবো । আমি দোকানদারকে বললাম, বুদ্ধিটা তো বেশ হয়েছে!  তবে দাদা যেই লাউ সেই  কদু । দোকানদার সাহেব আমাকে জিজ্ঞেস করলো, দাদা, আমি ঠিক বুজতে পারলাম না আপনার কথা! যেই লাউ সেই কদু কী? আমি দোকানিকে বললাম, তা আপনার বুঝার দরকার নাই । তো আপনার কাছে কতগুলি কয়েন জমা আছে? দোকানদার আমাকে যা দেখালেন তাতে বুঝলাম সেখানে প্রায় ৪/৫ হাজার টাকা হবে । আমি ভাবলাম, একটা মুদিদোকানে ৪/৫ হাজার ধাতব মুদ্রার কয়েন তো অনেক কিছু, তাহলে ছোট একটা দোকানে তার নিজের চালান থাকে কত? দোকানদার আরো বললেন, এগুলি তো দোকানে, বারিতে তো আরো আছে, কেউ তো একশ টাকার কয়েন একসাথে নিতে চায় না, তো এগুলি চালাবো কোথায়? দুইটাকার কাগজের নোট আর পাঁটাকার কাগজের নোট থাকতে আবার এই ধাতব মুদ্রার কয়েন কেন? দুইটাকার কাগজের নোট-ই তো একসাথে অনেকগুলো কেউ নিতে চায় না, তাহলে এই কয়েন আবার নিবে কে? দোকানদারের কথা শুনে আমার কোনো জবাব নাই ।

আরেক দোকানদারের  সাথে তো একদিন আমার ঝগড়াই হয়ে গেল এই কয়েন নিয়ে, সেটা ছিল পাঁচটাকার কয়েন । এক কাপ চা' পান করে পাঁচটাকার দিতে গিয়েই বাঁধলো ঝগড়া, দোকানদার এই পাঁটাকার ধাতব মুদ্রার কয়েন নেবে না, আমিও আর কাগজের নোট দোকানদারকে দিচ্ছি না । এই নিয়ে ঘটে গেল এক তুমুলকাণ্ড, শেষমেশ আমার প্রতিরোধের মুখে দোকানদার এই কয়েন নিতে বাধ্য হয় । কিন্তু আমার নিজের কাছে খুবই খারাপ লাগছিল দোকানদারের সাথে ঝগড়া করছিলাম তার জন্য, কেন না, আমি নিজেও তো একজন কয়েন রুগি তাই । এখন আমরা সাধারণ মানুষ কার কাছে দাবি জানাতে পারি যে, মহোদয় আপনি এই দেশে দুইটাকা আর পাঁটাকার কাগজের নোট থাকতে আর কোনো ধাতব মুদ্রা (কয়েন) বাজারে ছাড়বেন না । যেগুলি আছে, সেগুলি থেকেও কিছু পরিমাণ ধাতব মুদ্রা (কয়েন) উঠিয়ে নিন, দোকানদার সহ সাধারণ ব্যবসায়ী বাঁচান, সাধারাণ মানুষের ঝামেয়া মুক্ত করুণ । দাবি জানাই কার কাছে? কে শুনবে আমাদের কথা?

 

 

 

 

0 Shares

৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ