কোনভাবে যদি প্রমান করা যায় যে ধর্ষণ মামলার বাদীর 'চারিত্রিক দূর্বলতা' আছে তাহলে মামলাটি একেবারেই দূর্বল হয়ে যায়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে করা সেই আইন এখনো বলবৎ আছে এবং এই আইনের প্রয়োগের ফলে অনেক ধর্ষণ মামলা খারিজ হয়ে যাওয়ার নজির আছে।

অদ্ভুত হলেও সত্য,  দুইবার বিয়ে হইছে এমন ভিক্টিমকে দূর্বল চরিত্র বলা হয়েছে। আরো ভয়ংকর হল কিশোরী ভিকটিম কোন একদিন গাছে উঠেছিল। ফলে বিজ্ঞ আদালত অই কিশোরীকে 'লঘু সম্ভ্রম' এর নারী হিসেবে সাব্যস্ত করে।

এই বিষয়ে ২০১৫ সালে প্রথম আলো পত্রিকায় একটা ফিচার করা হয়েছিল। তার একটা অংশ তুলে ধরলাম।

খুবই ইন্টারেস্টিং।  পড়ে দেখুন এবং আপনার মূল্যবান মতামত জানান!!!

------------

সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারায় ‘চরিত্র বিশ্লেষণ’ বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘একটি ধর্ষণ মামলার বাদী যদি সাধারণভাবেই একজন অনৈতিক চরিত্রের অধিকারিণী হন, তাহলে তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাঁর ধর্ষণকারীর বা হরণকারীর পক্ষে আদালতে ব্যবহার করা যাবে’, অন্যভাবে বলা যায়, ওই বিধানে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে বিচারকার্যে অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। ওই বিধান অনুযায়ী ‘বিচারকার্যকে’ অভিযোগকারিণীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

উচ্চ আদালতে ‘চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য’ প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে কি না, তা শনাক্ত করতে সম্প্রতি বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) একটি গবেষণা করেছে। ঢাকা ল রিপোর্টস এবং বাংলাদেশ লিগ্যাল ডিসিশনে গত ১০ বছরে (২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত) প্রকাশিত সব সিদ্ধান্ত পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বৈবাহিক অবস্থান থেকে শুরু করে একজন ধর্ষিতার অতীত সম্পর্কের ইতিহাস আসামি দ্বারা নিজকে রক্ষায় ব্যবহৃত হয়েছে এবং সেসব বিবৃতি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

আবদুল মজিদ বনাম রাষ্ট্র [১৩ বিএলসি ২০০৮[ মামলায় একজন তালাকপ্রাপ্ত মা, যিনি তাঁর শিশুসহ তাঁর কুঁড়েঘরে ঘুমন্ত থাকা অবস্থায় ধর্ষিত হওয়ার অভিযোগ করেছিলেন। পালানোর সময় অভিযুক্ত ধর্ষক গ্রামবাসীর কাছে ধরা পড়েন এবং অপরাধ স্বীকার করেন। আদালতে অভিযোগকারীর বৈবাহিক অবস্থা এবং যৌন সম্পর্কের ইতিহাসকে তাঁর ‘চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য’ বিবেচনায় তাঁকে ‘যৌন কার্যকলাপে অভ্যস্ত’ বলে উল্লেখ করা হয় এবং বলা হয়, ‘...ধর্ষিতা একজন হালকা নৈতিক চরিত্রের অধিকারিণী এবং তিনি অসামাজিক ও অনৈতিক কার্যক্রমে জড়িত রয়েছেন...।’

রাষ্ট্র বনাম শাহীন এবং অন্যান্য [২৮ বিএলডি (হাইকোর্ট ডিভিশন) ২০০৮ মামলায় ধর্ষণের অভিযোগকারীর দুবার বিয়ে হয়েছিল। তাঁকে তাঁর নানির কাছ থেকে ছিনিয়ে একটি হোটেলের কক্ষে সদলবলে ধর্ষণ করা হয়। এ ক্ষেত্রেও আদালতের রায়ে বলা হয় যে ‘এটি এমন একজন নারীর ধর্ষণের মামলা, যার আগে দুবার বিয়ে হয়েছিল...’ এবং ‘এই মামলাটি এমন একটি উদাহরণ, যেখানে উল্লিখিত কারণে বাদীর একার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না...’।

সোহেল রানা বনাম রাষ্ট্র ৫৭ ডিএলআর (এডি) (২০০৫) মামলায় আগের সম্পর্কের ইতিহাস টেনে আনা এবং ধর্ষিতার দ্বারা শারীরিক প্রতিরোধ প্রদর্শন করতে না পারার বিষয়ে দেওয়া অভিমতটি প্রণিধানযোগ্য। এ ক্ষেত্রে আদালত আসামিকে বেকসুর খালাস প্রদান করেন এবং অভিযোগকারীকে সম্মানের সঙ্গে এই বলেন যে ‘...যদি একজন নারী সহজেই একজন পুরুষের লালসার শিকার হন এবং নিজের সম্ভ্রম রক্ষায় সামান্যতম বাধাও না দেন, যা তাঁর কাছে তাঁর জীবনের থেকেও মূল্যবান, তবে তা ধর্ষণ নয়...।’ এ ক্ষেত্রে অভিযোগকারী তাঁরই নিজ বাসায় তাঁর প্রতিবেশী দ্বারা ধর্ষিত হন, যিনি তাঁর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁকে বিয়ে করার মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছিলেন।

শ্রী দিনটা পাল বনাম রাষ্ট্রের মামলায় ৩০ বিএলডি (এডি) ২০১০ দেখা যায় যে আদালত অভিযোগকারীর গাছ বেয়ে ওঠাকেই তাঁর ‘খারাপ চরিত্র বা দুশ্চরিত্র’ হিসেবে প্রমাণ করেন এবং তাঁর সাক্ষ্যকে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে ধরে নেন। অভিযোগকারী ছিলেন একজন অল্প বয়সী গৃহপরিচারিকা, যিনি তাঁর চাকরিদাতা দ্বারা ধর্ষিত হন। আদালত এ ক্ষেত্রে মন্তব্য করেন যে ‘...যেহেতু অভিযোগকারী অভিযুক্তের বাড়ির সদর দরজা বন্ধ থাকার সময় একটি পেঁপেগাছ বেয়ে উঠে ঢুকেছিলেন, এতে প্রমাণ হয় যে বাদী একজন হালকা সম্ভ্রমের নারী। তাই তাঁর দেওয়া প্রমাণ বিশ্বাসযোগ্য হবে না, যতক্ষণ না আরও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পেশ করা হবে...।’

অবশ্য আদালতের এমন রায়ও রয়েছে যেখানে একজন ধর্ষিতার সৎ চরিত্রের প্রমাণকেও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। ফাতেমা বেগম বনাম আমিনুর রহমান ২৫ বিএলডি (এডি) (২০০৫) মামলায় আদালত বলেছিলেন, ‘...বিজ্ঞ উকিল উপস্থাপন করেছেন যে মামলার বাদী একটি সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত পরিবারের একজন অবিবাহিতা কলেজপড়ুয়া ছাত্রী...এ ক্ষেত্রে প্রশ্নই ওঠে না যে বাদীর চরিত্র সন্দেহজনক হতে পারে।’

 

>‘চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য’ ধারণাটি আইনে আছে বলেই আদালত ধর্ষণের মামলাকারীর চরিত্র এবং তাঁর আগের যৌন সম্পর্কের ইতিহাসকে প্রাসঙ্গিক বলে ধরে নেন

 

এ পর্যন্ত যে মামলাগুলো উল্লিখিত হয়েছে তার মধ্যে সব মামলাতেই দণ্ডাদেশ উচ্চ আদালতে খারিজ করা হয়েছিল

শুধু একটি বাদে, যা ছিল ওই ফাতেমা বেগম বনাম আমিনুর রহমান মামলাটি। এখানে গণধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত আট পুরুষের মধ্যে পাঁচজনকেই সাজা দেওয়া হয়। তিনজনকে খালাস দেওয়া হয়; তদুপরি আদালত উপলব্ধি করেন যে অভিযোগকারী একজন সুচরিত্রের অধিকারিণী। ‘চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য’ ধারণাটি আইনে আছে বলেই আদালত ধর্ষণের মামলাকারীর চরিত্র এবং তাঁর আগের যৌন সম্পর্কের ইতিহাসকে প্রাসঙ্গিক বলে ধরে নেন।

0 Shares

১৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ