দ্য লিটল ড্রাগন (ব্রুস লি)

সৌবর্ণ বাঁধন ৩ নভেম্বর ২০২২, বৃহস্পতিবার, ০৩:১০:৫৭অপরাহ্ন খ্যাতনামা ব্যক্তি ২ মন্তব্য

ব্রুস লি ছিলেন আমেরিকান মার্শাল আর্টের একজন কিংবদন্তী পুরুষ। বিভিন্ন ধরনের কুস্তিবিদ্যার সমন্বয় ঘটিয়ে আধুনিক মিক্সড মার্শাল আর্টের সুচনা করেছিলেন তিনি। আমেরিকান চলচ্চিত্রে তার উপস্থিতি প্রাচ্য সম্পর্কে পশ্চিমাদের ধারণাকেই পালটে দিয়েছিল। প্রাচ্য ও পশ্চিমের সংস্কৃতির নতুন মেলবন্ধনের সূচনা হয়েছিল। একই সাথে শুরু হয়েছিল হংকং কেন্দ্রিক একশন মুভির নতুন জামানা। ১৯৪০ সালের ২৭ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকো শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। চীনা পঞ্জিকা অনুসারে ঐ বছরটি ছিল ‘ড্রাগনের’ বছর। চীনা সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করা হয় ড্রাগন বছরের ঐ দিনক্ষণে জন্ম নেয়া শিশুরা সাহস, উচ্চাকংখা এবং নেতৃত্বের গুণাবলি সম্পন্ন হয়!

জন্মের কয়েকমাস পর বাবা মা তাকে নিয়ে হংকং এ ফেরত চলে যান। সেখানে শিশুশিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রে হাতেখড়ি হয়েছিল। স্কুলে রেজাল্ট ভালো হচ্ছিল না। বারবার স্ট্রিট ফাইটের ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তেন। ছোটবেলার পরিবেশ খুবই প্রতিকূল ছিল। আর এই প্রতিকূলতার সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন হিংস্র ও আগ্রাসী স্বভাবের। ছোটবেলায় অতিচঞ্চল ছিলেন। মা বাবার ভাষায় – ‘never sit still’। শুধু শরীর নয় মন ও ছিল অতি সক্রিয়। সবসময় নতুন দক্ষতা ও জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি নতুন ধারণাও তৈরি করতেন। আন্দাজ করা কঠিন্ নয় যে ক্ষিপ্রগতিতে মারামারি করার সময় প্রথার বাইরে গিয়ে যে নতুন মুভ নিতে পারতেন তার পিছনের কারিগর ছিল অতি সক্রিয় মন। পাশাপাশি এটাও সত্য অনেকের মতে মার্সাল আর্ট অতি-চঞ্চলতা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। হয়ত ব্রুস লির ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। অতিচঞ্চলতার পাশাপাশি ইমপালসিভ আচরণ করার প্রবণতা ছিল। সহপাঠী, স্কুল গ্যাং, স্ট্রিট গ্যাং এর সাথে মারামারিতে জড়িয়ে পড়তেন হরহামেশাই। রাগের মাথায় তীব্রভাবে আঘাত করতেন। মার্সাল আর্ট হয়ত পরবর্তী জীবনে এইসব লক্ষণকে, আগ্রাসী মনোভাবকে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য উপায়ে প্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছিল। একাডেমিক পড়াশোনায় অমনযোগিতা থাকলেও ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে কমিক পড়তেন। এই শখ তার কল্পনা শক্তিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। নিজেকে হিরো হিসেবে কল্পনা করতে পারতেন। পাশাপাশি পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা তার শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে বেড়ে উঠায় সাহায্য করেছিল। এ বিষয়গুলি এতো বেশি প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও তার বুদ্ধিমত্তাকে বিকশিত করেছিল।

বাবা-মা নিজ থেকেই সন্তানকে মার্সাল আর্টে প্রশিক্ষিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যদিও প্রথমে গ্রান্ডমাস্টার আইপিম্যান তাকে শেখাতে রাজী ছিলেন না। এর কারণ তখনকার দিনে চীনা ব্যাতীত অন্য কাউকে এটা শেখানোর নিয়ম ছিলনা। আর ব্রুস লির মা ছিলেন জার্মান। পরবর্তীতে সেখানে শেখার সুযোগ হলেও অন্যরা সহজে বিষয়টি  মেনে নিচ্ছিল না! তবু হংকং এ বেড়ে উঠার সময়ই মার্সাল আর্টের বিভিন্ন ধারা যেমন বক্সিং, তাই চাই, স্ট্রিট ফাইট বেশ ভালোমতো রপ্ত করে নিয়েছিলেন। স্ট্রিট ফাইট তখনকার দিনের হংকং এ নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা ছিল। কথিত আছে সেখানের এক গ্যাংস্টারের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লে তারা প্রতিশোধ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পুলিশ মারফৎ এই খবর জানতে পেরে বাবা মা তাকে আমেরিকায় পাঠিয়ে দেন। উনিশ বছর বয়সে আমেরিকা ফেরত যাওয়ার সময় অন্তত বিশটির কাছাকাছি চলচ্চিত্রে অভিনয় ও করে ফেলেছিলেন। আমেরিকায় ফিরে যাওয়ার পরেও পড়াশুনা বেশিদূর আগায়নি। সেখানে তিনি মার্সাল আর্ট শেখানো শুরু করলে আমেরিকায় বসবাসরত চীনা গোষ্ঠী গুলো তার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিল। তারা তাকে সরাসরি দ্বন্দযুদ্ধে আহ্বান জানিয়েছিল। শর্ত ছিল যদি হেরে যান তো শ্বেতাঙ্গদের মার্সাল আর্ট শেখানো বন্ধ করতে হবে। ব্রুস লির ব্যাক্তিত্বে সবসসময়ই সহজে উত্তেজিত হওয়ার প্রবণতা ছিল। তিনি আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন। এটা নিশ্চিত নয় যে তিনি জিতেছিলেন কিনা! তবে শ্বেতাঙ্গদের মার্সালআর্ট শেখানো চালু রেখেছিলেন।

তার দক্ষতা খুব দ্রুত হলিউডের প্রযোজকদের নজর কেড়েছিল। তবে মূল ভুমিকায় অভিনয়ের সুযোগ পাচ্ছিলেন না। বন্ধুদের উপদেশে হংকং ফিরে গিয়েছিলেন যাতে করে সেখানে অভিনয়ের কারিশমা দেখিয়ে হলিউডের টনক নড়িয়ে দিতে পারেন। সেখানে প্রথম মুভি ‘দ্য বিগ বস’ বক্স অফিসে সাফল্যের জোয়ার নিয়ে এসেছিল। এরপর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ‘অন দ্য ওয়ে অফ ড্রাগন’ মুভিতে মার্সাল আর্টের যে প্রদর্শনী দেখিয়েছিলেন তাকে ফিল্মের ইতিহাসে অন্যতম সেরা বলা হয়ে থাকে। এছাড়াও গেম অফ ডেথ, ইন্টার দ্য ড্রাগন, ফিস্ট অফ দ্য ইউনিকর্নের মতো অসংখ্য জনপ্রিয় মুভিতে অভিনয় করেছিলেন। অভিনয়ে সহজাত দক্ষতা ছিল। তবে চরিত্র যদি তার সাথে খাপ খেয়ে নিত তখনই অভিনয় ভালো হতো। মার্সাল আর্টের হিরো কিংবা গুরু, অভিবাসী চরিত্র যে দূরদেশে দুষ্ট লোকদের সাথে যুদ্ধ করছে এসব তার জন্য উপযোগী হতো। মুভিগুলোতে সচরাচর থাকত মারামারি ও হিংস্রতা। তিনি ছিলেন প্রচন্ড ক্ষিপ্র, অভিনয়ে অতিনাটকীয়তাও ছিল, আর ছিলেন প্রচন্ড শক্তিশালী। মুভিগুলোর স্ক্রিপ্ট লিখতেন নিজ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে। সেসব বিশ্লেষণ করলে তার মনোস্তত্বের কিছুটা আভাস মিলে। এশিয়ান বংশোদ্ভূত হওয়ার ব্যাপারটায় গর্ববোধ ছিল। পক্ষান্তরে কোন কতৃত্বপরায়ণতা মেনে নিতে পারতেন না।

ব্যাক্তিত্ব বিশ্লেষণে অনুমিত হয় যে তিনি ‘ইনটারটেইনার’ ধরনের মানুষ যিনি সবসময় স্পটলাইটে বা কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে ভালবাসতেন, নিজের দক্ষতা প্রদর্শনের মাধ্যমে অন্যদের বিনোদন দিতে চাইতেন। শৈশব থেকে অভিনয় জগতে থাকার সুবাদে স্বপ্ন ছিল বিখ্যাত হওয়া, হলিউডে সুপার স্টার হওয়া। অভিনয়ের পাশাপাশি পারফর্ম করায় অনবদ্য ছিলেন। মঞ্চে যখন মারামারির কৌশল দেখাতেন দর্শকেরা চোখ ফেরাতে পারতোনা; মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখতো। ব্রুস লি বহির্মুখী মানুষ ছিলেন, নিজের চিন্তা পছন্দের কথা সবার সামনে দৃড়তার সাথে প্রকাশ করতেন। চাইতেন সবসময় সবার মনোযোগ তার দিকে থাক। সেটা না হলে অসস্বস্তিতে ভুগতেন। কিন্ত তাকে পুরো আত্মকেন্দ্রিক মানুষ ও বলা যায়না। অন্যদের সুখী দেখতে চাইতেন। হাসি তামাশার মধ্যে দিয়ে আশেপাশের মানুষদের মন ভালো করে দিতে চাইতেন। চরিত্রে উদ্দীপনা ছিল যা তাকে অন্যের কাছে আদরের পাত্র করে তুলেছিল। ব্রুস লির ব্যাক্তিত্বে আরেকটি দিক হচ্ছে দুঃসাহসিকতা। গতানুগতিক ধারার বাইরে এসে নতুন কৌশল প্রয়োগ বেশি পছন্দ ছিল। অনুসারীদের অনুপ্রাণিত করতে পারার ক্ষমতা থাকায় এইসব নতুন কলাকৌশলের প্রয়োগ তাদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতেন। ফলশ্রুতিতে মার্সাল আর্টের নতুন ঘরানার জন্ম দিতে পেরেছিলেন। বর্তমান জীবনের সুখভোগ নিয়ে বেশি মনোযোগী থাকায় অনেক সময় আবেগের তাড়নায় বা ইমপালসিভলি অনেক কিছুই করে বসতেন। হাতে টাকা না থাকা সত্ত্বেও ধার কর্জ করে বড় ধরনের কেনাকাটা করতেন যা পরবর্তীতে তাকে আর্থিক সমস্যায় ফেলে দিত। তার ব্যাক্তিত্বে আরেকটি দিক ছিল অতিমাত্রায় স্পর্শকাতরতা। প্রত্যাখ্যান মেনে নিতে পারতেন না। আত্মসমালোচনায় মগ্ন হয়ে থাকতেন তখন। তিনি চাইতেন সব মানুষই তার অভিনীত চলচ্চিত্রের প্রশংসা করুক। সামান্য সমালোচনাতেই মাত্রা ছাড়া পরিশ্রম করতেন যাতে করে কাজগুলি আরো নিঃখুত হয়।

ব্রুস লির শারীরিক শক্তি ও খিপ্রতাকে শুধু আগ্রাসন দিয়ে ব্যাখা করা যায়না। এর পিছনে দার্শনিক ভিত্তিও রয়েছে। যে দর্শনের প্রতি তার পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস ছিল। তিনি মার্সাল আর্টের প্রাচীন চীনা দর্শন ‘তাই’ কে বুঝতেন। এই দর্শনে বলা হয়, সব মানুষের ভিতরেই একজন যোদ্ধা থাকে। অন্য ভাষায় বললে, সব মানুষের মধ্যে প্রবাহমান শক্তির একটা উৎস থাকে, যাকে ‘তাই’ বলা হয়। এই শক্তিকে যদি পেশীতে প্রবাহিত করা যায় তবে তা মানুষকে দেয় প্রচন্ড শক্তি, যদি মস্তিষ্কে প্রবাহিত করা যায় তখন বোঝার ক্ষমতা ও অন্তঃর্দৃষ্টি তৈরি হয়। লি বিশ্বাস করতেন এই দর্শনে বিশ্বাস ও কঠোর পরিশ্রম তাকে সাফল্য এনে দিয়েছিল। তার ভাষ্যমতে, এই শক্তিকে ইতিবাচক চিন্তা করতে ব্যবহার করতেন। তাকে আমেরিকা ও হংকং দুইখানেই বর্ণবিদ্বেষের শিকার হতে হয়েছিল। তিনি নিজ মনোজগতের উপর আসা আঘাতগুলিকে নিরাময় করতে এই বিশ্বাসকে ব্যাবহার করেছিলেন।

১৯৭৩ সালের ১০ মে তারিখে হংকং এর ফিল্ম স্টুডিওতে কাজ করার সময় হঠাত মাথা ব্যাথা ও খিঁচুনি শুরু হয়। হাসপাতালে নেয়ার পর ধরা পড়ে সেরেব্রাল এডিমা বা মস্তিষ্ক আঘাতের ফলে ফুলে গিয়েছিল। এরপর খিঁচুনি ও মাথাব্যাথা বারবার হচ্ছিল। এই সমস্যা নিয়েও কাজ করে যাচ্ছিলেন। ২০ জুলাই একইরকম সমস্যা নিয়ে অজ্ঞান হয়ে যান। সেদিন সন্ধ্যায় মৃত্যুবরণ করেন মার্সাল আর্টের এই প্রবাদ প্রতিম চরিত্র। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র বত্রিশ। সেই অকালমৃত্যু নিয়ে মিডিয়ায় ছড়িয়েছিল অসংখ্য গুজব। অনেকে মনে করতো এটা তার পরিবারের উপর নেমে আসা কোন অভিশাপের ফল। আবার অনেকে ধারণা করেছিল ‘ট্রায়াড’ নামক চীনা কোন গুপ্তসংস্থা হয়ত দায়ী ছিল। ব্রুস লির জীবনী লেখক আর্থার পলি এ বিষয়ে ভিন্ন মত দিয়েছেন। তার মতে মৃত্যুর কিছুদিন আগে ব্রুসলির বগলের নীচের সমস্ত সোয়েট গ্ল্যান্ড বা ঘর্মগ্রন্তি অপসারণ করা হয়েছিল যাতে মুভিতে তাকে সুন্দর দেখায়। শরীরের প্রাকৃতিক ভাবে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কমে গিয়েছিল। প্রচন্ড গরমে অনুশীলন করার সময় হয়ত তিনি হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলেন।

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ইন্টারনেট

0 Shares

২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ