আমার প্রথম সন্তান রিয়াসাত জন্মালো যখন, আমাদের উচ্ছ্বাসের সীমা নেই। তাঁর ছবি তোলার জন্যে ডিজিটাল ক্যামেরা কেনা হলো। স্বাস্থ্যকর আর সুস্বাদু "বেবী ফুড" খাওয়ানো হল। বছরখানেক কেনা পানি পান করানো হল। নিউইয়র্ক এবং বাংলাদেশে একাধিকবার জমজমাট জন্মদিন পালন করা হলো। বাড়িতে গানের আসর হলো রাতভর। যাকে নিয়ে এতোসব আয়োজন, সম্ভবত সে এসবের কিছুই বুঝেনি। কেননা এ নিয়ে তাঁর কোন উচ্ছ্বাস, অনুভূতি চোখে পড়েনি কখনো।
...
দ্বিতীয়জন রিহান। জন্মের পর অযথা কান্নাকাটি নেই। হাত পা ছুঁড়ে হাসে। খাবার দিলে খায়, না দিলে ঝামেলা করে না। তাঁকে কেনা পানি খাওয়ানো হয়নি। পরিবারের অন্য সদস্যদের মতই রেগুলার খাবার খেয়ে বেড়ে উঠছে। তাঁর জন্ম জুলাই'তে, ওই সময়ে নিউইয়র্কের স্কুলগুলোতে গ্রীষ্মের ছুটি থাকে প্রতি বছর। বিধায় স্কুলে কখনোই কেউ তাঁকে জন্মদিন উইশ করেনি এবং করবেও না। কিন্তু প্রায়ই স্কুলে কারো না কারো "বার্থডে পার্টি" হয়। তখন বাড়ি ফিরে ভীষণ উচ্ছ্বাসে আমায় বলে, " আম্মু, তুমি জানো, টুমরো ইজ মাই বার্থডে ? "। রিহানের ধারনা, যেহেতু স্কুলে একে একে সবাইকে ঘিরে জন্মদিনের পার্টি হচ্ছে, নিশ্চয়ই আগামীকাল তাঁকে ঘিরে হবে। কিন্তু সেই আগামীকাল আর আসে না। জুনের শেষ সপ্তাহে স্কুলগুলোয় দু'মাসের জন্যে গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হয়ে যায়।
ভীষণ সুখি সুখি উচ্ছলতায় সে যখন মাঝে মাঝেই আমায় বলে, " আম্মু, তুমি জানো, টুমরো ইজ মাই বার্থডে ?" আমরা সবাই হোহো করে হাসি। বলি, ধুর্ বোকা, প্রতিদিন কি কারো বার্থডে হয় নাকি ! এতে সে খানিক লজ্জা পায়। কিন্তু জন্মাবধি কেউ তো কখনো তাঁর চারিপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে একযোগে "হ্যাপি বার্থডে গান" গেয়ে উঠেনি। কিংবা হাততালি দিয়ে কেক কাটেনি। তাই হয়তোবা রিহানের শিশুমন প্রতিদিনই "বার্থডে বয়" হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
এখন রিহান দিন, মাস বুঝে। অনেকদিন পর গত সপ্তাহে রাতে ঘুমোতে যাবার আগে আচ্মকা আমায় বলে, " আম্মু, তুমি জানো, টুমরো ইজ মাই বার্থডে ?" আমি চম্কে উঠি। তাই তো ! অতঃপর সে সারা বাড়ি হেঁটে হেঁটে তাঁর দাদু, ভাইয়া, চাচ্চু সকলকেই বলতে থাকে__ তুমি জানো, টুমরো ইজ মাই বার্থডে ? এবার আর আমরা হোহো করে হেসে উঠি না। তাঁকে জড়িয়ে ধরি। আগাম উইশ করি। ছোট্ট মানুষটি আকাশছোঁয়া আনন্দ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমন্ত রিহানকে দেখে আমার ভেতরের টুকরো টুকরো অনুভূতিগুলো নাড়া দিয়ে উঠে। কোন কারন ছাড়াই তাঁর মুখখানা বিষণ্ণ মনে হয়। বাতি নিভিয়ে ছোট্ট মানুষটির গালের সাথে গাল লাগিয়ে শুয়ে থাকি। বুকের ভেতরে এক চিন্চিনে সূক্ষ্ম ব্যথা বোধ করি। চার দেয়াল বেয়ে গাঢ় অন্ধকার নেমে আসে। সেই অন্ধকারে জানালার পর্দার ওপাশে লুকিয়ে থাকে ভীষণ এক নির্জনতা...
পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান ভাব প্রকাশের অদ্ভুত এক ক্ষমতা দিয়ে সকলের মন জয় করে নেয় যদিও, কিন্তু তবুও তাঁরা প্রথম সন্তানের মত মনোযোগ পায় না। কি অবলীলায় এইসব ছোট ছোট অবহেলাগুলো আমাদের মনোযোগ এড়িয়ে যায় ! হায় ! ক'দিন বাদে রিহান হয়তো ভাববে, তাঁকে কেউ ভালোবাসে না। জীবনের অনেকটা সময় আমি নিজেও " আমাকে কেউ ভালোবাসে না " __ এমন একটি ধারনা নিয়ে বেড়ে উঠেছি। কেননা, আমি নিজেও যে "দ্বিতীয়জন" ছিলাম !
ভালোবাসায় ভালো থাকুক পরিবারের সকল "দ্বিতীয়জন"...
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
Thumbnails managed by ThumbPress
২৩টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
সূক্ষ কিন্তু জরুরী দিক গুলো তুলে ধরতে আপনি খুবই পারঙ্গম যা নিজের অজান্তে
ছুঁয়ে যায় অদেখা জায়গা গুলোতে।
রিমি রুম্মান
আপনি লেখার গভীরে যান বলেই এমন ছুঁয়ে যায় আপনাকে।
শুভকামনা জানবেন।
মৌনতা রিতু
সত্যি কি তাই হয় ! সত্যি আমার রিয়ান কখনো আমাকে খাওয়া নিয়ে, কোনো প্রকার জালাতন করেনি। তবে আল্লাদ ছিল খুবই। মেমন জালিয়েছে খাওয়া নিয়ে।
প্রথম সন্তকনকে দেখার জন্য পরিবারের অন্যান্য সদস্যরক সামাজিক বন্ধন মতে এটা ওটা দামী গিফট নিয়ে লাইন ধরে। পরেরটায় বেলায় এমন হয় না। কেন ?
আমিও তো করেছি এমন। কিন্তু কেন ? নিজের অজান্তে, নাকি স্বাভাবিক জীবনের নিয়মে ?
রিমি রুম্মান
প্রথম সবকিছুতেই উচ্ছ্বাস থাকে। তাই বলে দ্বিতীয়জনকে যে কম ভালবাসি, তা কিন্তু নয়। মনের অজান্তেই হয়ত এমনটি হয়।
জিসান শা ইকরাম
এমন টি হয় মনে হয়, খুবই সুক্ষ্ম, তবে হয়।
আপনার পর্যবেক্ষন সত্যিই অসাধারন।
ভাল থাকুক পরিবারের দ্বিতীয় জন সহ সবাই।
রিমি রুম্মান
এবার রিহানের জন্মদিন পালন করার ব্যপারে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলাম। বন্ধুদের সাথে দিন তারিখ নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। কেউ কেউ বলল গরমের দিনে ইনডোর প্রোগ্রাম না করে বরং আউটডোর প্রোগ্রাম করতে। সে অনুযায়ী এগোচ্ছিলাম। কিন্তু বিধিবাম ! যাঁদের গাড়ি নেই, তাঁদের অনেকেই দূরের সেই স্পটে যেতে চায়নি। এমন করেই রিহানের আশাভঙ্গ হল। 🙁
জিসান শা ইকরাম
আহারে, বাচ্চার এতে খুব আশাহত হয়।
ইকরাম মাহমুদ
আমিও দ্বিতীয়জন। আজ যেনো আমাকে খুঁজে পেলাম আপনার লেখাতে। আমি জানি, ভাইয়া ও রকির মতো আমাকেও আব্বু আম্মু অনেক ভালোবাসে তবু এ জানা টাও ভুল মনে হত মাঝেমাঝে।কোনো অবহেলা পেলেই ছোট্টবেলার ঐ গল্পটা মনে পড়ে, ২৫শে মার্চ কালোরাতে তিন সন্তানকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন বাবা মা। গুলাগুলির আওয়াজ শুনে বাবা বড় ছেলে আর মা ছোট ছেলে কে নিয়ে দৌড়ে পালাল। যখন বাবা মা বুঝতে পারলো তাদের আদরের দ্বিতীয়জনকে সাথে নিতে মনে নেই,ফিরে এসে দেখে সেই দ্বিতীয়জন আর নেই কোথাও। এ গল্পটা খুব সম্ভবত পড়েছিলাম ক্লাশ সিক্সে। তখন থেকেই মনের ভিতর ঢুকে গেছে। ঐ যে একটা কথা বললেন না,দ্বিতীয়রা অদ্ভুত এক ক্ষমতা দিয়ে সকলের মন জয় করে নেয়। কথাটা একদম ঠিক। আমি আমার আদর আদায় করে নিতে পেরেছি। যখন দেখি সকলেই তাদের বিপদের দিনে আমাকে স্মরণ করে, আমাকে প্রত্যাশা করে,এর চেয়ে বগ পাওয়া আর কি হহে পারে?
রিমি রুম্মান
আমি যখন দেশ ছেড়ে আসি, তখন আমার বাবা স্ট্রোক করে। সেই যে প্যারালাইজড হল, আর ভাল হল না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে লাঠি ভর করে হাঁটত । তখন বুঝি, দ্বিতীয়জন বলে ফেলনা ছিলাম না মোটেই। বরং আমার বিদায়ে দীর্ঘদিন পরিবারের অনেকগুলো মানুষ অশ্রুজলে ভেসেছেন, আমার প্রসঙ্গ এলেই।
ভাল থাকুন, অনেক ভাল।
ইকরাম মাহমুদ
দ্বিতীয়ের মাঝে এমন ভাবনা জন্ম হয় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই।আবার ভুল ভাবনাটা নিজে থেকেই প্রমাণের চেষ্টাও থাকে দ্বিতীয়ের মাঝেই। আপনার দ্বিতীয়ের জন্য দোয়া রইল,প্রথমের জন্যও।
ইকরাম মাহমুদ
বানান ভুলের জন্য দুঃখিত। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে? হবে।
রিমি রুম্মান
আমি বুঝে নিয়েছি এটি টাইপিং এর ভুল ছিল।
গাজী বুরহান
আসলে ছোট বাচ্ছারা এমনই হয়। আমরা যেখানে তুচ্ছ বিষয় বলে এড়িয়ে যাই, সেখানে তারা অনেক বড় কিছু ভেবে তালগুল পাকিয়ে দেয়।
রিমি রুম্মান
ছোটরা তাঁদের নিস্পাপ সরল মনে যা ভাবে, তা-ই আশা করে, স্বপ্ন দেখে।
ভাল থাকুন সবসময়।
আবু খায়ের আনিছ
অদ্ভুত যন্ত্রণায় ফেললেন দেখছি। আমি শুধু বাপ-মায়ের বড় নয়, পুরু বংশের বড়। তারপর আমার বোন, কখনো এভাবে ভেবে দেখিনি। আমি ছোটদের বড় বানিয়ে দিয়েছি।
আমি ভাবতাম, বড় হলে ঝামেলা বেশি, এখন দেখি ছোট হলেও সমস্যা।
এতদিন আমিও এমন করে এসেছি, হয়ত নিজের অজান্তেই করেছি। তবে আজকের পর থেকে এমন হবে না। শুভ কামনা আপু। আর বিশেষ ধন্যবাদ, এমন সুক্ষ্ম বিষয়টা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য।
রিমি রুম্মান
এমনটি তো আসলে বেখেয়ালে হয়। তবে ভালবাসা ছোটরা আদায় করে নেয় তাঁদের অদ্ভুত ক্ষমতা দিয়ে।
নীলাঞ্জনা নীলা
রিমি আপু বড়ো তো আমিও। অনেক আদর-ভালোবাসা যেমন পেয়েছি, তেমন অতিরিক্ত শাসনও।
কিন্তু আমার ছোট বোন শাসনের চেয়ে বেশী প্রশ্রয় পেয়েছে। 🙁
রিহান সোনার জন্য সত্যি খারাপ লাগছে স্কুলে ওর জন্মদিন কখনো পালন করা হবেনা বলে। তবে ওকে বলো আমার ছেলে নভোনীলের জন্মদিনও স্কুল ছুটির মাসে। মানে মার্চ ব্রেকে। তাই ওর জন্মদিনও কখনো স্কুলে পালিত হবে না। তবে জানো জাপানে একটা সুন্দর সিস্টেম আছে। স্কুল ছুটির মধ্যে যদি কারো জন্মদিন পড়ে, ছুটির আগের দিন সেসব ছাত্রদের জন্মদিন পালিত হয়।
রিহানের জন্ম তারিখটা তো দাও। ওর জন্মদিন নয় আগষ্টেই পালন করি।
রিমি রুম্মান
রিহান জন্মেছে জুলাই ২৮, ২০১০ এ।
এটা সত্যিই দুঃখজনক ছোট অবুঝ মানুষটির জন্যে। তাঁর চোখের সামনে প্রায়ই কাউকে না কাউকে ঘিরে উচ্ছ্বাস হচ্ছে, অথচ তাঁকে নিয়ে কোথাও কোন আয়োজন নেই ! 🙁
নীলাঞ্জনা নীলা
ইস রে! আসলেই অনেক কষ্টের।
ওর জন্মদিনে স্কুলের সব বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করো। দেখবে ভালো লাগবে রিহান বাবুর।
মিষ্টি জিন
আমি ও দ্বিতীয় । কিছুটা কষ্ট আছে মনে। তবে আমার দ্বিতীয় সন্তান জন্মের পর অনেক চেষ্টা করেছি এই দ্বিতীয়র কষ্ট যেন কখন ও বুঁঝতে না পারে।
কিন্তু কিঁছু একটা হয়ে যায় অত্যান্ত সুক্ষভাবে এবং অজান্তেই।
মেহেরী তাজ
আমি যেহেতু প্রথম সেহেতু আমার বেশি ভালোবাসা পাওয়া উচিৎ ছিলো! কিন্তু মাঝে মাঝে তো মনে হয় আমার চেয়ে ছোট জনই বেশি আদর পায়…..!
শুন্য শুন্যালয়
কী লিখবো বুঝতে পারছিনা, পুরো পোস্ট হয়ে যাবে যা মনে আসছে লিখতে গেলে, আমিও দ্বিতীয়জন।
আমার বোনটা ক্যাটস আই বিলেতি বেড়ালের মতো সুন্দর ছিলো, তাকে কিনে নেবার জন্যেও নাকি অনেকে ধন্যা দিয়েছিল, ট্রেনের এক যাত্রি বলেই বসেছিল, আমার সব জমিজিরাত দিয়ে দিচ্ছি, মেয়েটাকে আমাকে দিয়ে দিন।
এরপর আমার মতো কালো মেয়ে! আমাকে নাকি ছোটবেলায় কেউ পছন্দ করতো না, খুব কাঁদতাম।
রিহানের জন্মদিন এখন থাকি আমি মনে রাখবো, আমিও যে জুলাই। মনে থাকবে, ২৮ এ জুলাই, ২৮ এ জুলাই। দ্বিতীয়জনেরা স্পেশাল হয় রিহান কে বলবেন 🙂
ইঞ্জা
আপনার এই কষ্টটা আমি বুঝি কারণ আমি ঘরের ২য় সন্তান। 🙁