প্রতিবারের মতো এবারও সারাদেশে পালিত হচ্ছে আমাদের  হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় দুর্গোৎসব। শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে সোনেলা পরিবার-সহ দেশের সকল ধর্মাবলম্বীদের আমার পক্ষ থেকে শারদীয় শুভেচ্ছা জানিয়ে শুরু করছি, দেবী দূর্গার আবির্ভাব ও বিজয়া দশমী নিয়ে সংক্ষিপ্ত কিছু আলোচনা। আশা করি সবাই সাথে থাকবেন।

আমাদের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এই ধর্মীয় উৎসবটি প্রতিবছর মহালয়ার পার্বণ শ্রাদ্ধের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়। এ-বছর ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ শনিবার মহালয়ার মধ্যদিয়ে শুরু হয়েছিল শ্রীশ্রী দূর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা। এরপর মহা-পঞ্চমী, মহাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহা-অষ্টমী, মহানবমী। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামীকাল অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিজয়াদশমী। এবার ২১ আশ্বিন (৮অক্টোবর ২০১৯) দিবাগত রাতে বিজয়া দশমীর মধ্য দিয়ে শেষ হবে এই বর্ণিল উৎসবটি।

দূর্গাপূজার আগমন ঘটলেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ব্যস্ততা শুরু হয়। ব্যস্ততা শুধু বাঙালি হিন্দুদের মাঝেই নয়, গোটা ভারতবর্ষের হিন্দুদের মাঝেই এই ব্যস্ততা লক্ষনীয়। সারাবিশ্বের বাঙালি হিন্দুদের সবচাইতে বড় উৎসব। এই উৎসবটির স্থায়িত্ব হয় প্রায় সপ্তাহব্যাপী। ছোট-বড় সবাই মেতে ওঠে মনের আনন্দে। শারদীয় উৎসবটি হাসি গানে জাগিয়ে তুলে সারাবিশ্বের হিন্দু সমাজকে। কিন্তু আমরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষেরা ক’জনে জানি এর মর্মকথা? হাতে গোনা কিছুসংখ্যক পণ্ডিতগণ ছাড়া খুব কম মানুষেই জানি দূর্গাদেবীর আবির্ভাব তথ্য। আর পূজার বিজয়া দশমীর কাহিনী।

বিজয়া দশমী সম্পর্কে শুধু জানি দেবী দূর্গার প্রতিমা বিসর্জন বা প্রতিমা জলে ভাসিয়ে দেওয়া। এছাড়া হয়তো এর বেশিকিছু অনেকেই জানে না। অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী জানতে চায়ও না, কোন বিজয়? কার বিজয়? কেন-ই-বা দশমী বলা হয়? অনেকেই জানি না এর মূলকথা। তা হলে জেনে রাখা ভাল যে, কিসের বিজয়, কার বিজয় আর কিসের-ই-বা দশমী? এসব না জানার কারণেই অনেক সময় আমাদের অনেকের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। তাই আজকে আমার এই লেখা শুধু দূর্গাপূজার বিজয়া দশমী নিয়ে। কিন্তু দশমীর আগে তো দেবী দুর্গার মর্ত্যে আগমন, তারপর পূজারম্ভ হয়। কাজেই দূর্গাদেবীর আবির্ভাব নিয়ে আগে কিছু লিখতে হয়।

শ্রীশ্রীচণ্ডী ২য় ও ৩২ খণ্ড থেকে সংক্ষেপে বর্ণনা।
জানা যায় পূর্বকালে একসময় মহিষাসুর অসুরদের রাজা ছিলেন। তখন প্রায় একশ বৎসর দেবতা ও অসুরদের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধে অসুরগণ দেবসৈন্যসমূহকে পরাজিত করে অধিপতি হয়। এরপর পরাজিত দেবতারা উপায়ান্তর না দেখে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব- এর শরণাপন্ন হয়। দেবগণ তাদের পরাজিত কাহিনী ও মহিষাসুরের দৌরাত্ম্যে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব’র এর কাছে গিয়ে বললেন, ‘হে প্রভু মহিষাসুরের শক্তি দেখে বুঝা যায় যে, সূর্য, ইন্দ্র, অগ্নি, বায়ু, চন্দ্র, যম, বরুণ-সহ সব দেবতাদের ক্ষমতা তাদের মধ্যে অধিষ্ঠিত হয়েছে। তাদের অত্যাচারে আমরা এখন আর দেবকুলে থাকতে পারছি না। তাই আমারা নিরুপায় হয়ে দেবকুল ছেড়ে পৃথিবীতে বিচরণ করছি। অসুরদের এই সমস্ত দৌরাত্ম্য আপনাদের কাছে জানালাম, আপনারা এর একটা বিহিত করুণ।’

ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব দেবতাদের মুখে এসব কথা শুনে খুবই রাগ  হলেন। রাগে তখন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব’র শরীর থেকে মহাতেজ নির্গত হতে লাগল। তাদের সাথে অন্যান্য দেবতাদের শরীর থেকে তেজ নির্গত হতে শুরু করলো। এভাবে সব দেবতাদের তেজে এক নারী দেবী মূর্তি ধারণ করলো। এরপর দেবতারা অসুরদের নিধন করার জন্য দেবীকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সজ্জিত করলেন। দিলেন তাকে বহন করার জন্য বাহনও, যা দিয়েছে হিমালয়। দেবীর বাহন সিংহ। তখন দেবীর গর্জনে সমগ্র আকাশ পরিপূর্ণ হলো এবং চারদিকে ভীষণ প্রতিধ্বনি উঠতে লাগলো। তা দেখে উপস্থিত দেবগণ আনন্দে সিংহ বাহিনীর জয় ধ্বনি করতে লাগলেন,  অতঃপর দেবতারা তাকে ‘জয়া’ নাম প্রদান করে ভক্তিভরে নতদেহ হয়ে দেবীকে ভক্তি করলেন। এরপর থেকে শুরু হয় দেবী দূর্গার অসুর বধ করা, আর এই ধরাধামে পালিত হয় দেবী দূর্গার পূজা।   

মর্ত্যে একসময় লঙ্কার রাবণ নিজের দুর্গতি নাশ হওয়ার জন্য দূর্গা নামে দূর্গাপূজা প্রথম করেছে। উদ্দেশ্য ছিল মনোবাসনা পূর্ণ হওয়া ও দুর্গতি দূর হওয়ার জন্য। তাই অনেকে দেবীদুর্গা কে দুর্গতিনাশিনী বলেও ডাকে। আবার শ্রী রামচন্দ্র ও করেছে দূর্গাদেবীর পূজা, তাও মনোবাসনা পূর্ণের জন্যই করা। সেই থেকেই ধারাবাহিকভাবে আমাদের মর্তলোকে দেবী দূর্গার পূজা হয়ে আসছে। অনেক দেশে এই দুর্গতিনাশিনী বা দূর্গাদেবীর পূজা লগ্নে এক কুমারী মেয়েকেও মাতৃরূপে পূজা করেন। সেই পূজাকে বলে থেকে কুমারীপূজা। এই পূজাটি দূর্গাপূজার অষ্টমী তিথিতে হয়ে থাকে।

বিজয়া দশমী কী এবং কেন?
দূর্গা পূজার অন্ত চিহ্নিত হয় বিজয়া দশমীর মাধ্যম। পঞ্চমী থেকে নবমী পর্যন্ত মূল পূজা, দশমীতে বিজয়া দশমী। ভারত ও নেপালের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দিনটি নানাভাবে পালিত হয়ে থাকে। সে সাথে আমাদের বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাশহরের আনাচে কানাচেও পালিত হয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই দিনটিকে ‘বিজয়া দশমী’ বলা হয় কেন? কোন ‘বিজয়’-কেই বা চিহ্নিত করে দিনটি?

পুরাণে মহিষাসুর-বধ সংক্রান্ত কাহিনীতে বলা হয়েছে, মহিষাসুরের সঙ্গে ৯ দিন ৯ রাত্রি যুদ্ধ করার পরে দশম দিনে তার বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেন দেবী দুর্গা। শ্রীশ্রীচণ্ডীর কাহিনী অনুসারে, আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে দেবী আবির্ভূত হন, এবং শুক্লা দশমীতে মহিষাসুর-বধ করেন। বিজয়া দশমী সেই বিজয়কেই চিহ্নিত করে। সেই থেকেই আমরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী সবাই জাঁকজমক ভাবে অতি আনন্দে বিজয়াদশমী উদযাপন করি।

মা’দূর্গাকে প্রণাম করার মন্ত্র”

“সর্ব মঙ্গলমঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ

রণ্যে ত্রাস্বকে গৌরী নারায়ণী

নমোহস্তুতে নমোঃ”

“দূর্গাপূজায় পুষ্পঅঞ্জলী দেয়ার মন্ত্র”

“ঔঁ জয়ন্তি মঙ্গলা কালী, ভদ্র কালী, কপালিনী

দূর্গা শিতা ক্ষমা ধত্রী, স্বাহা স্বধা নমস্তুতেঃ
এস-স্ব-চন্দন পুষ্প বিল্ব প্রত্রাঞ্জলী নম
ভগবতী দূর্গা দেবী নমহঃ”

“মা’দূর্গা’কে স্মরণ করা বা জাগ্রত করার মন্ত্র”
“ইয়া দেবী সর্বভূতেষু মাতৃ রূপেন সংস্থিতা
ইয়া দেবী সর্বভূতেষু শক্তি রূপেন সংস্থিতা
ইয়া দেবী সর্বভূতেষু বুদ্ধি রূপেন সংস্থিতা
নমোস্তেসৌঃ নমোস্তেসৌঃ নমোস্তেসৌঃ
নমোঃ নমোঃ”

পরিশেষে: 
জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।
ঔঁ শান্তি, ঔঁ শান্তি, ঔঁ শান্তি।।

0 Shares

২৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ