
পর পর ফোনে রিংটোন বেঁজেই যাচ্ছে,,,,
কিছু কিছু ফোন ইচ্ছে করেই একটু দেরীতে রিসিভ করলেই ভালো লাগে এটা অবশ্য অয়নার ধারনা।
কয়েকবার মিসড কল দেখেই অয়না ব্যাক করল,
ও পাশ থেকে,
ঐ শয়তানী কল ধরিস না ক্যান রে???
কই ছিলি এতক্ষন?
অয়না ঃ চুপ থাক, অত কৈফয়ত দিতে পারব না, কি বলবি বল???
এই হলো অয়না আর সোহাগের সম্পর্কের ধরন। এদের এই সম্পর্ক কে পুরো বুঝতে গেলে চলে যেতে হবে পুরনো ফিল্ম স্ট্রিপের রোলের দিকে,,,,,,,
অয়না আর সোহাগ দুজনেই নার্সারী থেকে একই ক্লাসে পড়ে, বাসা ও পাশাপাশি। অয়নার মা জব করার কারনে সোহাগের মা ই বেশির ভাগ সময় ওদের স্কুল থেকে নিয়ে যায়, মাঝে মাঝে অয়নার দাদা, দাদী, চাচা যে যখন পায় তাদের আনা নেওয়া করে। অয়না পরিবারের এবং বংশের একাই মেয়ে তাই আদরে আদরে দিন দিন বাদর হয়ে যাচ্ছিল, বাড়িতে অয়নার কথাই শুনতে হবে, যেহেতু বাড়ির সবাই জব করে তাই সারাদিন অয়নার কাটাতে হত বাসার এক পরিচারিকা আন্টির কাছে। তাই ছোট বেলা থেকেই অয়না জেদী স্বভাবের, একা একা থাকতে থাকতে তার ভিতর ভিতর এক ধরনের ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্খা সবসময় কাজ করত। দুষ্টুও ছিল ভিষন,ক্লাসে সোহাগের কান এত জোড়ে টেনে দিত শেষমেষ দুজনকেই টিচার দাঁড় করিয়ে রাখত। সোহাগের পুরো খাতা আকিবুকি করে নষ্ট করে দিত।
অপরদিকে সোহাগ অনেকটা চুপচাপ, শান্ত,ভদ্র স্বভাবের তবে খানিক মিনমিনে প্রকৃতির। সবার সামনে ইনোসেন্ট ভাব থাকলেও ভিতর ভিতর সোহাগ ও ছিল দুষ্ট। অয়না খেলতে গেলে সে তার আনা টিফিন খেয়ে কাগজ দিয়ে ভরিয়ে রাখত,অয়নার মুখে চক পাউডার লাগিয়ে দিত, চুলে চুইঙ্গাম লাগিয়ে দিত। এভাবেই অয়না আর সোহাগের সম্পর্কের গাটছড়া চলতেই থাকল,দেখতে দেখতে তারা ক্লাস এইটে উঠে গেল, অয়না, সোহাগের সাথে আরও যোগ হল অদিতি, বৈশাখী, মিজু, । রংপুর ক্যান্টের সবাই তাদের ৫ স্টার গ্যাং বলে ডাকত, যতসব কালচারাল প্রোগ্রাম,খেলাধুলা,ডিবেট,দুষ্টুমি, পড়াশুনা সবজায়গায় তাদের পদচারনা চলতেই থাকল৷ কখনো ক্যান্টিনের সামনে কখনো ড্যাসিং অর্থনীতি নুসরাত ম্যাডামের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকা,কখনো ক্যান্টের পিছন দিকে স্কুল পালিয়ে নির্ঝর পার্কে যাওয়া, কখনো পাবলিকের বার্গার আর কফি সহ সারা রংপুর শহর চষে বেড়ানোই তাদের কাজ ছিল।
এর মাঝেই ক্লাস নাইনে নতুন স্কুল থেকে ভাবনার আগমন, চোখ দুটি মায়ায় ভড়া, হালকা কোকড়ানো চুল আর গায়ের রং শ্যামলা,আর একটু শান্ত, চুপচাপ স্বভাবের। এমন মেয়ে একবার দেখলে মনে হয় আরেকবার তাকাই। অয়নার সাথে ভাবনার ভালোই ভাব হয়ে গেল। চলতে চলতে ভাবনার জিলা স্কুলের রাজীবের সাথে প্রেম হয়ে গেল, তাদের ঘোরাফেরা, প্রেম ভালোই চলছিল। অপরদিকে অয়না সোহাগ সহ সবাই এস এস সি পরীক্ষার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেল। একটা কথা না বললেই নয় অন্য জেলার এক সিনিয়র বড় ভাই অয়নাকে খুব পছন্দ করতেন,তাকে চিঠিও লিখতেন। তারা দূর সম্পর্কের আত্নীয়তা থেকেই পরিচিত ছিল। যাইহোক এভাবেই তাদের এস এস সি শেষ। পরে জানা গেল রাজীবের হঠাৎ কিডনী অপারেশনের জন্য সে আর এক্সাম দিতে পারে নি। পরীক্ষার পর সবার মাঝে কিছুদিন যোগাযোগ কমে গেল । এরই মাঝে অয়নার ও প্রেম হয়ে গেল সেই সিনিয়র ভাইয়ের সাথে, আর অন্যদিকে ভাবনার ব্রেক আপ হয়ে গেল রাজীবের সাথে।
কিছুদিন পর কলেজে ভর্তির পর সোহাগ কোন কারন ছাড়াই অয়নার সাথে কম যোগাযোগ শুরু করে দিল কিন্তু অয়না কিছুই বুঝতেছিল না, একা একা কষ্ট পাচ্ছিল। এভাবে আর কিছুদিনপর অয়না জানতে পারল যে সোহাগের সাথে ভাবনার একটা সম্পর্ক হয়েছে যদিও সোহাগ কিছুই বলে নি। অয়না খুশি হয়েছিল যে তার বন্ধু কোথাও ইংগেজ হয়ে যাক তবে ভাবনার সাথে অয়নার সম্পর্ক টিকবে কিনা তাই নিয়ে অয়না খুবই সন্ধিহান ছিল কেননা অয়না ভাবনার অতীত জানত তবুও অয়না সোহাগকে কিছু না বলে নিরবে তাদের থেকে খানিক দূরে সরে গেল। সোহাগ আর অয়না বাহ্যিক দিক থেকে ভাবনার কারনে কিছুটা দূরে সরে গেল। এরপর থেকে অয়না পড়াশুনায় আবার ভালোভাবে মন দিল, ভালো রেজাল্ট ও হলো,সোহাগেরও ভালো রেজাল্ট হলো,ভাবনা একটু খারাপ করল। অয়নার সাথে সোহাগের যোগাযোগটা তখনও ছিল খুব কম আর প্রয়োজনে।
নিয়তির কি পরিহাস!!! অয়না আর সোহাগ দুজনেই ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পেল তবে সাবজেক্ট আলাদা,আর ভাবনা ময়মনসিংহ কাজী নজরুল ভার্সিটিতে সঙ্গীতে চান্স পেল। কি যে অদ্ভুত কিছুদিন পর সোহাগের দুরাবস্থা শুরু হলো যার আশংকা অয়না আগে থেকেই করেছিল। ভাবনা ছেড়ে গেল সোহাগকে। সোহাগ হয়ে গেল নিথর,নিশ্চুপ আর বাকরুদ্ধ, ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষাও দিল না। অয়না তাকে মানসিক সাপোর্ট দিতে দিতে তার মুখে হাসি ফিরিয়ে আনার জন্য নানা কাজ করতে থাকল। অবশেষে সোহাগ আবার ফিরে এলো জীবনে, পড়াশুনা কমপ্লিট করল তারা দুজনেই। ঢাকায় অহনার বাজার করে দেয়া,টেবিল কিনে দেয়া, সন্ধ্যায় দুজনে চা খেয়ে কলাভবনে বসে স্টাডি করা, ফুলার রোড হয়ে বি ডি আর ২ নং গেইটে ফুসকা খাওয়া,টি এস সিতে মোক্তার ভাইয়ের দোকানে চা খাওয়া,চারুকলায় চিকেন চপ খাওয়া,পাবলিক লাইব্রেরিতে বসে থাকা, রাতে মৈত্রী হলে অয়নাকে পৌছায় দেয়া থেকে সব কাজ করত সোহাগ। এভাবেই দুজন দুজন কে সব ক্ষেত্রে আগলে রাখত। তবে তাদের জীবনেও অনেক থার্ড পারসন এসে তাদের বন্ধুত্ব নষ্ট করার চেষ্টা করেছে কিন্তু তারা দুজনেই দুজনকে চেনে তাই কোনকিছুই তাদের বশ করতে পারে নি।। তাদের ছিল একটাই গান,,,
পুরো পৃথিবী একদিকে আর আমি অন্যদিক,সবাই বলে করছো ভুল আর তুই বলিস ঠিক
তুই ছিলি, তুই আছিস,জানি তুইইইই থাকবি,
বন্ধু বোঝে আমাকে,,,
বন্ধু আছে,,,আর কি লাগে?????
ভালোবাসলে এমনি হওয়া উচিৎ। তার দোষ,গুন সবটা নিয়েই ভালোবাসা উচিৎ শত বাঁধার পরেও একসাথে থাকা সেটা সবসময় কাছে থাকতে হবে এমন নয়, দূরে থেকেও অনেকদিন পর দেখা হলেও কথা হলেও একটিবারও মনে হবে না যে অনেকদিন পর দেখা /কথা। এ যেন এক আত্নার বাঁধন যা সবসময় অন্তঃনিহিতভাবেই থাকে।
এখন অয়না রংপুরে একটা করপোরেট অফিসে জব করে,অয়না তার সেই চিঠি আদান প্রদানের সেই ছেলেটিকে বিয়ে করেছে, অপরদিকে সোহাগ তার বাবার রিটায়ার্ড করার কারনে গ্রামের বাড়ি মেহেরপুরে চলে গেছে,সেখানে একটা প্রাইভেট ব্যাংকে জব করে। এখনো সে বিয়ে করে নি। বাবা মা আর বোন নিয়ে ভালোই আছে। অয়নার ঢাকা ছেড়ে আসার পর থেকে প্রায় ৮ বছর আর সোহাগের সাথে দেখা হয় নি,কিন্তু তাদের রুটিন বেঁধে তারা তাদের ব্যস্ততা রেখেও মেসেঞ্জারে হাই, হ্যালো করার পর ও প্রতি মাসে প্রায় এক ঘন্টা করে তারা তাদের সুখ দুঃখের আলাপনে মেতে থাকে,দৈনন্দীন জীবনের সব সমস্যা নিয়ে আজও তারা আলোচনা করে। যখন কোন সিদ্ধান্ত নিতে তারা দ্বিধাদন্দ্বে ভোগে তখন তারা দুজনেই দুজনকে এখনো আগের মতই আগলে রাখে…এরই নাম বন্ধুত্ব,,,,,,,
সবাই বলে ছেলে আর মেয়ে নাকি বন্ধু হওয়া যায় না, একসময় তা প্রেমে পরিনত হয়। কিন্তু অয়না আর সোহাগের এই ২৫ বছরের বন্ধুত্ব কখনো প্রেমে পরিনত হওয়ার সুযোগই পায় নি। তাদের এত বছর ঝগড়া খুঁনসুটি, অনেকদিন না দেখা হওয়া,প্রতিদিন না কথা হওয়া, তিলে তিলে দুজনের ভালোবাসার এই সম্পর্কের একটাই নাম “দুষ্টু মিষ্টি বন্ধুত্ব”।
ও পাশ থেকে হ্যালো হ্যালো শব্দে এতক্ষনে স্ক্রিন ফ্ল্যাশব্যাক থেকে বর্তমানে ফিরে এলেন অয়না।
সোহাগঃ কিরে কথা বলিস না কেন???আমি এত বক বক করছি, হু হ্যা কিছুই বলছিস না?কোথায় হারায় গেছিস???
অয়না ঃ সোহাগ কে বুঝতে না দিয়ে হুম বল! তুই তো হু হা করার সুযোগই দিচ্ছিস না এত বক বক করিস🥰🥰🥰( আসলে অয়না নস্টালজিয়ায় হারিয়ে গিয়ে এতক্ষন কিছুই শোনে নি) বাদ দে এবার বউ আন আমার এইসব প্যাচাল আর ভালো লাগে না।।।।
সোহাগঃ হুম যে মেয়ে তোরে বুঝবে যে তোর মত একটা মানুষ আমার জীবনে আছে এবং বাকিজীবন ও থাকবে,এইসব মেনে নিয়ে গাটছড়া বাঁধতে চাইবে তারেই বিয়ে করব! এমন একটা মেয়ে খোঁজ যা এখন ভাগ।।।।
অয়নাঃ হয় আমার খায়য়া দেয়য়া কোন কাম নাই তো।।।তুই ভাগ।।।
সোহাগঃ রাখছি দোস্ত ভালো থাকিস।
অয়নাঃ হুম তুই ও ।।।।
এভাবেই চলছে অয়না আর সোহাগের দুষ্টু মিষ্টি সম্পর্ক যে সম্পর্কে ঝগড়া,রাগ, মান অভিমান আছেই তবুও আবার বার বার ফিরে আসার জায়গাও আছে, যে সম্পর্কে বেঈমানী আর প্রতারনার জায়গা নেই, যে সম্পর্কে আস্থা আর বিশ্বাস আছে।।।।আর আছে বিপদে আগলে রাখার মত একটা শক্ত হাত যে হাতে হাত রেখে বাকিজীবন নির্দ্বিধায় কাটানো যায়।।।।
বেঁচে থাকুক তাদের এই দুষ্টু মিষ্টি বন্ধুত্বের সম্পর্ক।।।।।।
ছবিঃ নিজের
৮টি মন্তব্য
রোকসানা খন্দকার রুকু
বন্ধুত্বের সম্পর্কই সেরা, যার ক্ষয় নেই। আপনার গল্প পড়ে ভীষন মিস করছি বন্ধুদের, কতোদিন দেখা হয়না,গালাগালী, মারামারী হয়না। হাসির ফেয়ারা ছোটে না। অনেক বেশী মন খারাপ থাকলে বন্ধুর ছোঁয়ায় মন ভালো হয়ে যায়।
বেঁচে থাকুক এই বন্ধুত্ব, অটুট বন্ধনে🥰
রেজওয়ানা কবির
হুম আর যাইহোক বন্ধুত্বই সবচেয়ে সেরা যেখানে সবকিছু থাকে আর যাই হোক তাদের স্মৃতিগুলোই ক্ষয় হতে দেয় না। অনেক বছর পর দেখা হলেও সেই সম্পর্ক একইরকম থাকে। ধন্যবাদ আর শুভকামনা।
হালিমা আক্তার
খুব ভালো লাগলো। বন্ধুত্বের বাঁধন চির অম্লান থাকে। সেখানে থাকে না কোন দেয়া নেয়ার হিসাব নিকাশ। অনেক বছর পর দেখা হলেও মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। শুভ কামনা রইলো।
রেজওয়ানা কবির
ধন্যবাদ আপু সত্যি এ এক অদ্ভুত বাঁধন যার মায়া থেকে যায় আজীবন। শুভকামনা আপু।
ছাইরাছ হেলাল
বন্ধুত্বের কোন বিকল্প নেই, ছিল ও না।
প্রকৃত বন্ধুত্বই বন্ধুত্ব।
রেজওয়ানা কবির
প্রকৃত বন্ধু পাওয়াই এখন মুশকিল ভাইয়া। কেননা সমাজে বেশিরভাগ মুখোশধারী মানুষরা বন্ধু সেজে ক্ষতি করে। তাই প্রকৃত বন্ধুই সেরা বন্ধু। শুভকামনা।
আলমগীর সরকার লিটন
স্মৃতিময় গল্প হাইস্কুলের কথা মনে পরে গেলো আপু
ভাল থাকবেন———
রেজওয়ানা কবির
স্মৃতিই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, ধন্যবাদ আর শুভকামনা ভাইয়া।