দুমুখো সাপ

রোকসানা খন্দকার রুকু ১১ এপ্রিল ২০২১, রবিবার, ০১:১৯:১০পূর্বাহ্ন গল্প ২১ মন্তব্য

কথিত গ্রামীণ গল্প-

পাশাপাশি দুজন মানুষের বসবাস। একজন গরীব কৃষক আলাল মিয়া আর তার তিন সন্তান। আর অন্যজন শিক্ষিত , জ্ঞানী, মান্যবর ব্যাক্তি। যাঁর যে কোন নাম হলেই চলে; কিংবা দরকার হয়না। সবাই মান্যবর হিসেবেই মানে।

সকাল বিকাল মান্যবরের বাসায় অনেক ভীর। লোকজন নানা জ্ঞান নিতে আসে উপঢৌকনসহ। বলেনও তিনি ‘মাশাআল্লাহ্’ অক্ষরে অক্ষরে।

আলাল মিয়া মান্যবরের ফুট ফরমায়েস খাটে। দুবেলা তার পরিবারের ঠিকমত খাওয়া হয় না। তারা তাতেই খুশি কারন আল্লাহকে খুশি করবার মত তার কিছু নেই, আল্লাহ তাকে আর কি দেবে। যা দেয় তাই বেশি। দিনের বেলা দুরে অন্যের বাড়িতে কাজে গেলে আল্লাহর কাজ তো করতে পারে না। তাই আশাও কম, অভিযোগও নেই।

বর্ষার প্রথম বৃষ্টিতেই পাশের ছোট্ট নদীটুকুতে কোমর পানি বাঁধে। দুরে কাজে যেতে কষ্ট, পানি পাড় হয়ে যেতে হয়। সেদিন আলাল মিয়া কাজ থেকে ফিরেছে। লুঙ্গি মালকোচা করে কোমরে লেংটি করা। মান্যবর বাইরেই ছিলেন। সান্ধ হাওয়ায় গা জুরাচ্ছেন। আলাল মিয়াকে এমন দেখে বললেন , ‘কি সর্বনাশ; কি সর্বনাশ করেছ? লুঙ্গি নামিয়ে পড়। হাঁটুর  উপর লুঙ্গি তোলা হারাম। হারাম হল আল্লাহকে অমান্য করা। আল্লাহকে অমান্য মানে জাহান্নাম।’

আলাল মিয়া জানত না, লজ্জায় মাথা নত করে তওবা করল। সেই থেকে আলাল মিয়া লুঙ্গি মালকোচা করে না। সন্ধ্যায় ভেজা লুঙ্গি নিয়েই বাড়িতে আসে। বৌ চিল্লায়, গরীব মানুষ সন্ধ্যায় লুঙ্গি ভিজলে সারারাত ভেজা থাকে,পঁচে যায়। ছিঁড়ে গেলে কিনতে টাকা পাবে কই?

বৌয়ের কথায় আর লুঙ্গির মহব্বতে আলাল মিয়া বুদ্ধি বের করল। সেদিন মালকোচা না করে পানিতে নেমে লুঙ্গি আস্তে আস্তে উপরে তুলে নিল। পানিতে তো কেউ দেখছে না। পার হবে আর যেমন আস্তে আস্তে তুলেছিল তেমনি আস্তে আস্তে নামিয়ে দেবে। বিপত্তি হল অন্য জায়গায়। ছোট্ট নদীতে হাল্কা স্রোত বইছিল। অবলা চিংড়ি মাছ দল বেঁধে যাচ্ছিল কোথাও। আটকা পড়ল আলাল মিয়ার বিশেষ জায়গার বা*লে( চুলে)।

বেশ অনেকগুলোই, রান্না করলে সেবেলা সবার খাওয়া হয়ে যাবে। আলাল মিয়া খুশিমনে বাড়ি নিয়ে এল। বৌ রান্নাও করল। খেতে গিয়ে মনে হল, মান্যবরের কাছে একবার জানা দরকার বা*লের মাছ খাওয়া যাবে কিনা।

মান্যবর বললেন ‘নাউযুবিল্লাহ’ মোটেও না। কড়াই শুদ্দ টাটকা লাল মাছের তরকারী ফেলে দিয়ে তারা নুন ঢলে ভাত খেল। বাচ্চারা কাঁদল । কিন্তু আলাল মিয়া শুনল না।

পরদিন মান্যবর আলালকে ডেকে পাঠিয়েছেন। বিশদ ভাবে শুনে নিলেন, কেমনে কোন দিক দিয়ে গেলে বা ফেরত আসলে মাছ আটকায়। এরপর মান্যবর প্রায়ই চিংড়ি মাছের দোপেয়াজা খেতে থাকলেন।

আলাল মিয়ার সন্দেহ হল, পরক্ষনেই ছি! ছি! তিনিই তাকে কত কিছু শেখান। এমন কাজ করতেই পারেন না। অসম্ভব! এবং ভেবেই নিল, তার তো টাকা- পয়সা আছে অবশ্যই বাজার থেকে কিনেছেন।

তবে রাতে যে মান্যবর পাশের নদীতে গোসলে যায়? যাবে না? যা গরম পড়েছে, নদীর পানি ঠান্ডা তাই হয়ত যায়।

পৃথিবীতে পাঠানোর আগে আল্লাহ আমাদের রুহুকে কিছু প্রশ্ন করেন। তার উত্তরের উপর নির্ভর করেই আমরা পৃথিবীতে কেউ গরীব, কেউ টাকাঅলা। আবার সেভাবে বিভিন্ন দায়িত্বও পেয়ে থাকি। আমরা সেদিন প্রতিশ্রতিও দেই, যার যতটুকু দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করব।

পৃথিবীতে আসার পর আমরা লালশায় নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য, নৈতিকতা বিসর্জন দেই। তারপর কি হয় আমরা ভুলেই যাই কথা দিয়েছিলাম। কিংবা আমি বা আমরা কারও আদর্শ। আদর্শ যখন বিচ্যুত হয় তখন হাজার হাজার মানুষ মন খারাপ করে। তারাও আদর্শচূত হয়ে পরে, বিপথগামী হয়। মনে করে, কর্নধারই যদি না মানেন, আমি কি করি মেনে?

কাল আমার এক বন্ধু বলল, ‘ বন্ধু এতদিন যা যা মেনে চলতাম, আর মানব না। কারন সবাই যদি অপরাধ করে ক্ষমা পায়। জেনা করে, ব্যাভিচার করে, মিথ্যা বলে, কোরআনের কথা অমান্য করেও বেহেস্ত যায় আমি কেন নয়?’

আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। ঈশার নামাজ আমারও কাজা হয়ে গেল। ভয় যেন কেটে গেছে। সে অপরাধী আমি তো সাধারন! আমার এমনিতেই তো কোনকালই নেই?

বন্ধুর উদ্দেশ্যে দুটি হাদিস খুঁজে পেলাম, আমি বিষেশ কেউ না ভুল হলে মাফ করবেন।

“এক শ্রেণীর আলেম হবে; যারা জাহান্নামের দরজায় দাঁড়িয়ে মানুষকে ডাকবে। যারা তার ডাকে সাড়া দেবে, তারাও তার সাথে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।

[বুখারীঃ ৩৬০৬, মুসলিমঃ ১৮৪৭, হবনে মাজাহঃ ১৯৭৯]

রাসূল (সঃ) বলেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে ৭৩ দল হবে।শুধু একদল জান্নাতে যাবে,বাকিরা জাহান্নামী। অথচ তাদের দাঁড়ি,টুপি,ঝুব্বা সবই থাকবে।’

আমি নিজেও একজন হিজাব পরিহিতা নারী। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করি। রোজা রাখি, কলেমা, দান খয়রাত করি, বাবা- মায়ের সেবা করি, পরিবার পরিজনের অন্যান্য দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি একজন শিক্ষক। শিক্ষকতা করতে গিয়ে অনেক কম বয়সী আবেগী ছাত্র প্রেমে পড়ে যায়। নানা উপঢৌকনসহ আমাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে একটু আধটু কথা বলি রাত জেগে। কোথাও বেড়াতে যাই।কিংবা এমনও হল, ম্যাম আপনি যথেষ্ঠ ইয়াং, সুন্দরী। শরীরটা ভোগের জিনিস, তাকে কেন অবহেলা করছেন? ব্যবহার করেন? জীবন উপভোগ করেন? আমি কি করতে পারি? মন তো চায়ই!

তাহলে? ভয় হচ্ছে আমরা কোন দিকে যাচ্ছি। কেন যাচ্ছি? কে নিয়ে যাচ্ছে? এবং তারপর কি হবে?

প্রেম- অন্ধপ্রেম, ভক্তি- অন্ধভক্তি, বিশ্বাস- অন্ধবিশ্বাস এই শব্দগুলোর আমাদের তফাত বুঝতে হবে। আমরা প্রিয় মানুষের অন্ধভক্তি, অন্ধবিশ্বাস, অন্ধপ্রেমে এবং অতি আবেগের বশীভূত হয়ে নিজেকে আত্নহত্যার মত জঘন্য কাজেও সামিল করে ফেলি। আসলে সেটা কতটুকু সঠিক বেঠিক তখন মাথায় থাকেই না।

“আবেগ বড় কঠিন জিনিস। কারন আবেগ আর বিবেক পরস্পর ব্যাস্তানুপাতিক। মানুষের মধ্যে আবেগ আর বিবেক কখনো একই তালে কাজ করতে পারে না।যখন একটি বাড়ে তখন অপরটি কমে।”

তবে অনুরোধ একটাই নৈতিকতা আমাদের নিজের, তাকে রক্ষার দায়িত্বও আমাদের। আমরা ভালোমন্দ বিচার করতে শিখব এবং সে অনুযায়ী পথ চলব।অযথা না জেনে না বুঝে, আবেগের বশীভূত হয়ে কারও কথায় বিপথগামী হব না।

ছবি- নেট থেকে।

0 Shares

২১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ