দুধরাজ/শাহ বুলবুল/ সাহেব বুলবুল

শামীম চৌধুরী ২৩ এপ্রিল ২০১৯, মঙ্গলবার, ০৩:২৬:০২অপরাহ্ন ছবিব্লগ ৩১ মন্তব্য

অনেকের ধারনা যে,এই পাখিটি পরিযায়ী পাখি। তাদের ধরনাটা স্বাভাবিক। কারন এই পাখিটিকে লোকালয়ে দেখা যায় একটি নির্দিষ্ট ঋতুতে বা সময়ে অন্যান্য পরিযায়ী পাখির মতন। আমাদে দেশে পরিযায়ী পাখির সমাগম হয় মূলত শীত মৌসুমে। আবার কিছু পাখি দেখা যায় গ্রীষ্মে। মোট কথা শীত ও গ্রীষ্মে মূলত পরিযায়ী পাখির বিচরন আমাদের দেশে। পরিযায়ী পাখিগুলি আসে মূলত খাবারের জন্য। যে পাখিগুলি শীতে আসে তারা তিন থেকে চার মাস পর্যাপ্ত খাবারের মাধ্যমে ক্যালরী গ্রহন করে নিজ নিজ আবাসস্থলে চলে যায়। তারা আমাদের দেশে প্রজনন করে না।

অথচ এই পাখিটি আমাদের দেশীয় পাখি এবং তারা আমাদের দেশেই প্রজনন করে থাকে। তাদের প্রজনন সময় হচ্ছে এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত। এই তিন মাস লোকালয়ে এই পাখিগুলিকে দেখা যায়। তাই অনেকের ধারনা এটি পরিযায়ী পাখি। প্রজননেন পর ডিম থেকে বাচ্চা ফুঁটিয়ে তার লোকালয় থেকে চলে যায়। এখন প্রশ্ন থাকতেই পারে তারা কোথায় যায়?
এই পাখির মূল খাবার হচ্ছে প্রজাপতি,ফড়িং সহ উড়ন্ত কীট-পতঙ্গ। এরা নিজেরাও উড়ন্ত অবস্থায় তাদের আহারের জন্য শিকার ধরে থাকে বলে তাদের নাম ফ্লাইক্যাচার। প্রজননেনর পর বাকি সময়গুলি তারা উচু বাঁশ ঝাড়ে অবস্থান করে। সব গাছের পাতা একটি নির্দিষ্ট ঋতুতে ক্রমান্বয়ে ঝরে যায়। আবার নতুন পাতা গঁজায়। একমাত্র বাঁশ পাতা ঝরে না। প্রজাপতি ও অন্যান্য কীট পতঙ্গ বাঁশ পাতায় বাসা বুনে ও বংশ বৃদ্ধি করে। আর এই সুযোগটাই এই পাখিরা নেয় বলে তাদের খাবারের জন্য লোকালয়ে আসার প্রয়োজন হয় না।

আমি গত দুই বছর টানা ৫ মাস ময়মনসিংহ ও রাজশাহী জেলায় এই পাখি নিয়ে কাজ করেছি ও ছবি তুলেছি। (বাসা বুঁনা থেকে শুরু করে বাচ্চা উড়ানো পর্যন্ত) কাজ করার সময় আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে দেখা যায় এই পাখিগুলি প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে। যেমনঃ এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত আমাদের দেশে ঝড়-বাদল,কালবৈশাখী সহ নানান ধরনের প্রকৃতির বিরূপ আচরন দেখা যায়। আর এই সময়টাই হচ্ছে এদের প্রজনন সময়।
এরা দু’বার ডিম দেবার ক্ষমতা রাখে। সে জন্য প্রথমবার যদি কোন কারনে তাদের ডিম প্রকৃতির বিরূপ আচরনে বা অন্য কারনে নষ্ট হয়ে যায় তবে তারা আবার প্রজননের মাধ্যমে ডিম পাড়ে। সে ক্ষেত্রে কোন কোন পাখির লোকালয়ে অবস্থান জুলাই পর্যন্ত দেখা যায়।
এদের অদ্ভুত একটি চরিত্র লক্ষ্য করেছি। এরা একের অধিক বাসা বুঁনে। আবার অনেক সময় পুরাতন বাসায় এমন ভাবে বসে থাকে যেন মনে হয় ডিমে তা’ দিচ্ছে। কোন বাসায় তারা ডিম দিবে তা বুঝা মুশকিল। আর এই অভিনয়টা করে থাকে মূলত শত্রুদের আক্রমন থেকে রক্ষা পাাবার জন্য।
এরা নীচুতে বাসা বুঁনে। মাটি থেকে আনুমানিক প্রায় ১০-১৫ ফুট উঁচুতে তিন ডালের সংযোগ স্থলে বাসা বুনে। জনপথের পাশে আম,কাঠাল,পেয়ারা বা অশোক গাছের ডালে বাসা বাঁধে। লোকজনের চলাচলের পথের ধারে বাসা বাঁধার কারন অন্যান্য শত্রু পাখি বা প্রাণী যেন তাদের আক্রমন করতে না পারে। তাদের বাসার ধারে জলাশয় থাকতে হবে। পুরুষ ও মেয়ে পাখি পালাক্রমে ডিমে তা’ দেয়। প্রতিদিনিই পুরুষ ও মেয়ে পাখি পানিতে গোসল করে। তাই জলাশয় বা পানির আধারের আশে পাশে তাদের বাসা বুঁনানোর আরেকটি কারন।

বাসার সামনে বড় বড় পাখি যেমন কাক,চিল বাজ পাখিদের দেখা মাত্রই তাড়া করে বেড়ায়। কোন পাখি তাদের বাসার সামনে আসা পছন্দ করে না। প্রকৃতির বিরূপ আচরন ও শত্রুদের মোকাবিলা করে এরা বংশ বৃদ্ধি করে ও বেঁচে আছে।

আমি গত দুই বছরে সর্বমোট ১৬ জোড়া পাাখির বাসা দেখেছি বিভিন্ন জায়গায়। এই ১৬ জোড়া পাখি প্রত্যেকেই ডিম দেয় নিজ নিজ বাসায়। প্রতিটি বাসায় নুন্যতম ৪টি করে ডিম পাড়ে। সে হিসেবে যদি সবগুলি জোড়ার বাসা থেকে বাচ্চা ফুঁটে বের হতো তবে গত দুই বছরে ৩২ জোড়া বা ৬৪ টি বাচ্চা প্রকৃতির অলংকার হিসেবে শোভা পেত।
কিন্তু বিধি বাম।
মাত্র দুই বছরে দুটি বাসা থেকে সফল ভাবে বাচ্চা বড় করে উড়িয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে এই দুধরাজ পাখি।
একটি হলো ময়মনসিংহে আর একটি রাজশাহীতে।
এদের মূল শত্রু ঝড়,বৃষ্টি, বাদল, গুই সাপ, সাপ ও হাঁড়িচাচা পাখি। ঝড়ে গাছ ভেঙ্গে কিছু ডিম নষ্ট হয়। কিছু সাপ জাতীয় প্রানীরা খেয়ে ফেলে। আর কাক, হাঁড়িচাচা পাখি বাচ্চা খেয়ে ফেলে।

পাখি কুলের মাঝে সবচেয়ে প্রতিকুল অবস্থায় প্রকিৃতির সাথে যুদ্ধ করে এই দুধরাজ বা প্যারাডাইজ ফ্লাইক্যাচার পাাখি বেঁচে আছে।
তাই এই সময়টাতে দল বেঁধে দুধরাজ পাখির ছবি না তোলাই শ্রেয়ঃ। যদি ছবি তুলতে হয় তবে যেন নিজেকে হাইড করে এবং পাখিটিকে বিরক্ত না করে ছবি তোলার চেষ্টা করার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ রইলো।
সময় নিয়ে পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

0 Shares

৩১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ