দুই টাকার দীর্ঘ-শ্বাস

আকবর হোসেন রবিন ১৫ অক্টোবর ২০১৯, মঙ্গলবার, ০১:৩৩:০৮অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ১৮ মন্তব্য
  • দক্ষিণ সন্দ্বীপে সবচেয়ে বড় কোরবানির গরুর বাজার বসতো সাউথ সন্দ্বীপ হাই স্কুলের মাঠে।অনেক দূরদূরান্ত থেকে মানুষ গরু, ছাগল. ভেড়া বেচতে কিনতে আসতো এখানে। আমিও যেতাম, বাজারের বড় বড় গরু গুলো কে কিনে, কত দাম দিয়ে কিনে এবং ক্রেতা-বিক্রেতার দরদাম করার যে অন্যরকম মজার একটা মুহুর্ত তৈরি হতো তা দেখতে।

বিকেল হলেই পকেটে পাঁচ-দশ টাকা নিয়ে মাঠে চলে যেতাম।আমার পকেট কখনও খালি থাকতো না। সকালে আম্মা বাজার করতে দিলে তা থেকে প্রয়োজন মতো টাকা মারতাম। তখন বিকালে গরু বাজারে বুট, বাদাম খাওয়ার জন্য পাঁচ-দশ টাকা হলেই চলে, তাই আমি বাজার থেকে পাঁচ-দশ টাকাই মারতাম। ওই টাকা পকেটে নিয়ে প্রথমে পুরো মাঠ এক চক্কর ঘুরে দেখা হতো। তারপর বুট বা বাদাম কিনে আরেক চক্কর ঘুরতাম। গরু বাজারে মাইকে লতা মঙ্গেশকর, উদিত নারায়ণ, অলকা ইয়াগনিক, কুমার শানুদের হিন্দি গান বাজতো।আমি বাদামের খোসা ছাড়তে ছাড়তে ঠোঁট মিলাতাম।গান গুলো তখন মুখস্ত ছিলো। কারণ, এই মাঠে ক্রিকেট, ফুটবল ট্রুনামেন্ট হলেও একই গান বাজে। আবার কারো গায়ে হলুদ, খৎনা কিংবা নাক কান ফুটো করার অনুষ্ঠানেও এই গান গুলো বাজিয়ে সবাই নাচে। মেয়েরা বলতো হিন্দি গান ছাড়া নাকি তাদের নাচের তাল উঠে না।

সে যাই হোক, এই দিকে মাইকে হঠাৎ করে গান বন্ধ করে গরু বিক্রির ঘোষণা আসতো।সাথে সাথে আমি ছুঁটে যেতাম যেখানে ইজারাদার হাসিল আদায় করে সেখানে। কোন গরু বিক্রি হলো, কে কিনলো, কত দিয়ে কিনলো; এসব দেখতে। তো এইভাবে যেতে যেতে একদিন খেয়াল করলাম মাঠের দক্ষিণ পাশে ঝোপঝাড়ের ভেতর কিছু মানুষের ভীড়।কৌতুহলবশত গিয়ে দেখি ঝোপের ভিতরে “ডাব্বা” খেলার আসর বসছে। এটা এক প্রকার জুয়া খেলা, আবার এটাকে গরীবের ক্যাসিনোও বলা যেতে পারে । এই খেলায় ছক্কার গুটির মতো বড় বড় দুইটা কাঠের তৈরি গুটি থাকে। ছক্কার গুটির মধ্যে যেমন এক থেকে ছয় পর্যন্ত সংখ্যা থাকে, ডাব্বা খেলার গুটির মধ্যে তেমন করে থাকে চাঁদ, তারা, ইস্কা, রুইতন, পানপাতা আর ভালোবাসা (লাভ চিহ্ন)।

ছক্কার বোর্ডের মতো এখানে মাটিতে একটা কাপড় পেতে রাখা হয়, তাতে গুটির ছয়টা প্রতীক বড় বড় করে আঁকা। দুইটা গুটি ভালো করে নাড়ানোর পর যে দুইটা প্রতীক উঠবে, সে ঘরে যারা টাকা রেখেছে তারা দ্বিগুণ টাকা পাবে।

খেলাটা দেখে আমার খুব লোভ হলো। আমিও একটা ঘরে দুই টাকা রাখলাম। দুই টাকা তখন আমার জন্য অনেক কিছু, তাইতো টাকা গুলো ঘরে রেখে দুই চোখ বন্ধ করে দোয়া দরূদ পড়তে শুরু করলাম, যেন আমার ঘরের প্রতীক গুলো উঠে। একটুপর চোখ খুলে দেখি একটা গুটিতে আমার ঘরের প্রতীক! কী সৌভাগ্য আমার! জীবনের প্রথম জুয়া খেলায় জিতে গেলাম! আমার দুই টাকা হয়ে গেল চার টাকা। এতে করে লোভ বেড়ে গেলো। এইবার দুই টাকা দুই টাকা করে চার টাকা রাখলাম দুইটা ঘরে। যদি দুইটা গুটিতে আমার দুইটা ঘর উঠে, তাহলে আমার চার টাকা হয়ে যাবে আট টাকা! আবার চো্খ বন্ধ করে দোয়া দরুদ পড়তে শুরু করলাম। কিন্তু, এইবার আমাকে চরম হতাশ হতে হলো। গুটিতে আমার টাকা রাখা একটা ঘরের প্রতীকও ওঠেনি।কি আর করার! সেদিন হতাশ হয়ে খালি হাতে বাড়িতে চলে আসি।

পরদিন বাজার থেকে আরও বেশি টাকা মেরে খেলতে গেলাম।কিন্তু গিয়ে দেখি, যেখানে ডাব্বা খেলার আসর বসে ওই জায়গায় কিছু কাঁটা গাছের ডাল পড়ে আছে। পরে জানতে পারলাম, পুলিশ ও চৌকিদার এসে জুয়ার আসর থেকে কয়েকজনকে ধরে নিয়ে গেছে। এটা শোনার পর, আমি দুই টাকার জন্য একটা দীর্ঘ-শ্বাস ছেড়ে পুনরায় গরু দেখাতে মনোনিবেশ করলাম।

*এটা ছিলো আমার প্রথম জুয়া খেলার স্মৃতি*

*ছবি অনলাইন থেকে সংগৃহীত*

0 Shares

১৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ