দাগ রেখে যাওয়া মানুষেরা

রিমি রুম্মান ৬ নভেম্বর ২০১৫, শুক্রবার, ০১:৪৫:৩৬অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ৩৮ মন্তব্য

আরফান আর আমার কর্মক্ষেত্র ভিন্ন হলেও লাঞ্চব্রেকে স্টারবাক্‌স এ কফি খাওয়া হয় একসাথে প্রায়ই। খেতে খেতে কথা হয় অনেক। দু'টি ভিন্ন দেশ, ভিন্ন কালচার, ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে উঠার গল্প। অভিন্ন শুধু আমাদের ধর্ম।
আফ্রিকা থেকে আসা কুচকুচে কালো আরফানকে প্রায়ই মজা করে বলি, কম আলোয় তোমাকে তো দেখাই যায় না, কেবল ঝকঝকে দাঁত ছাড়া। রসিক আরফানও মজা করে বলে, "তোমার আলোয় আলোকিত হই, মন্দ কি ?" এমনি করে কখন যে আমরা ভাল বন্ধু হয়ে উঠি ! একদিন নিজ হাতে রান্না করা খাবার নিয়ে আসে আমার জন্যে। ওদের দেশের জনপ্রিয় খাবার কিনা ! সত্যি বলতে কি, খাবার দেখে কিছুতেই রুচি হয়নি তা খাওয়ার। এমনকি খাবারের গন্ধটাও ছিল বিদঘুটে। আরফান খানিকটা মনঃকষ্ট নিয়ে নিজেই খেতে থাকে। আর ক্রমাগত বলতে থাকে, আমি কি তোমার বন্ধু নই... আমি কি দূরের কেউ...। সবচাইতে বেশি ভাল লাগতো, গল্প করতে করতে পকেটে থাকা পেন্সিল বের করে একটুকরো কাগজে কেমন সুন্দর করে মুহূর্তেই আমাকে এঁকে ফেলতো। কখনো চুল বাঁধা, কখনো খোলা চুলে__ যেদিন যেভাবে থাকি। অবিকল আমি !

 

যদিও তখন আমাদের টোনা-টুনি'র সংসার ছিল। তবুও কাজ শেষে হন্তদন্ত হয়ে ট্রেন স্টেশনের দিকে ছুটতাম। লন্ড্রি করা, বাড়ি পরিস্কার করা সহ কত কাজ জমে থাকে ! সবশেষে ফ্রেশ হয়ে নিজের রুমে একাকি গান শুনা এসব আমাকে লোভাতুর করে রাখতো। ঘরে ফেরা, যেন শান্তির নীড়ে ফেরা। নিজের একান্ত কিছু সময়ে ফেরা।

 

মাঝে মাঝে ভর দুপুরের সেই কফি'র সময়টাতে গল্পচ্ছলে বলি, "আরফান, সকাল-সন্ধ্যা কাজ... বাড়ি ফিরে রান্না, খাওয়া, ঘুমানো... রাত পোহালে আবার কাজ__ এটা কোন জীবন নয়। দেশে তোমার বাবা-মা'র কাছে ফিরে যাও। বিয়ে, সংসার, সন্তান__ সবমিলে সবার সান্নিধ্যে অন্য এক জীবন হবে।" আরফান মজা করে বলে, "তুমি যদি সাথে যেতে রাজি হও, কালই উড়াল দিবো, অনেক ভাল রাখবো, যাবে ?" আমি হো হো করে হাসি। বলি, "আমি তো ভালই আছি, ঢের ভাল, নিজের চিন্তা করো গে। "

 

একদিন ফ্যাকাসে হয়ে থাকা অভিব্যক্তিতে জানায়, তাঁর মা চিঠি লিখেছে। দেশে তাঁদের পারিবারিক ব্যবসায় কিছু সমস্যা চলছে। তাঁকে ফিরতে হবে। আমি খুশি হই। সাত বছর বাদে আমার এই ভিনদেশী বন্ধুটি বাবা-মা'র সাথে মিলিত হবে। তাঁর জন্যে পাত্রীও ঠিক করা হয়েছে। আনন্দের সাথে আমি আমার পছন্দের বেশ কিছু কস্‌মেটিকস্‌ কিনি। সুন্দর কস্‌মেটিকস্‌ ব্যাগে সাজিয়ে শেষ দিন তাঁকে দেই হবু বউ এর জন্যে।

 

বিদায়ের সময়টায় আরফানকে খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল। সেই সময় তাঁকে নিদারুন এক মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাওয়া মানুষ মনে হচ্ছিলো। কালো মুখখানা আরও অন্ধকার দেখাচ্ছিল। এদিকে আকাশ কালো আঁধার করে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হল। এক পৃথিবী নিরবতা ভেঙ্গে আমি হাতের ছাতাটি তাঁকে দিয়ে বললাম, "আমি তো এখানেই ট্রেন স্টেশনে ঢুকে যাবো... এটি তোমার কাজে লাগবে"। আরফান কোন কথা বলল না। ছাতাটি নিলো। ভাঁজ করা একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো ফিফ্‌থ এভিনিউ ধরে। আমি একরাশ কৌতূহলে সেটি খুলেই পড়তে শুরু করলাম।

মাত্র তিনটি লাইন।
" প্রিয় রিমি, এ পর্যন্ত আমার দেখা পৃথিবীতে তুমি চমৎকার একজন যত্নশীল মানুষ।
যতদিন জ্ঞান থাকবে, নিঃশ্বাস থাকবে মনে থাকবে তোমায়।
ভালোবাসি অনেক।" ___ আরফান।"

সামনে তাকাই। ছাতা মাথায় হেঁটে যাচ্ছে আরফান নামের ছয়ফুট উচ্চতার এক যুবক। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি দৃষ্টিসীমায় মিলিয়ে না যাওয়া অবধি। ততক্ষনে শহর ধোয়া ঝুম বৃষ্টি। বলতে দ্বিধা নেই__ কখনো কখনো বৃষ্টি ভালো, কেননা তা বেসামাল অশ্রুজল ধুয়ে নিয়ে যায় সকলের অগোচরে...

চলার পথে এমন করে কতজনে হৃদয়ে দাগ রেখে যায়, হেঁটে যাওয়া পথের পদচিহ্নের মতন। ভাল থাকুক সেইসব মানুষেরা। ভাল থাকুক সকলে।

0 Shares

৩৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ

Thumbnails managed by ThumbPress