আরফান আর আমার কর্মক্ষেত্র ভিন্ন হলেও লাঞ্চব্রেকে স্টারবাক্স এ কফি খাওয়া হয় একসাথে প্রায়ই। খেতে খেতে কথা হয় অনেক। দু'টি ভিন্ন দেশ, ভিন্ন কালচার, ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে উঠার গল্প। অভিন্ন শুধু আমাদের ধর্ম।
আফ্রিকা থেকে আসা কুচকুচে কালো আরফানকে প্রায়ই মজা করে বলি, কম আলোয় তোমাকে তো দেখাই যায় না, কেবল ঝকঝকে দাঁত ছাড়া। রসিক আরফানও মজা করে বলে, "তোমার আলোয় আলোকিত হই, মন্দ কি ?" এমনি করে কখন যে আমরা ভাল বন্ধু হয়ে উঠি ! একদিন নিজ হাতে রান্না করা খাবার নিয়ে আসে আমার জন্যে। ওদের দেশের জনপ্রিয় খাবার কিনা ! সত্যি বলতে কি, খাবার দেখে কিছুতেই রুচি হয়নি তা খাওয়ার। এমনকি খাবারের গন্ধটাও ছিল বিদঘুটে। আরফান খানিকটা মনঃকষ্ট নিয়ে নিজেই খেতে থাকে। আর ক্রমাগত বলতে থাকে, আমি কি তোমার বন্ধু নই... আমি কি দূরের কেউ...। সবচাইতে বেশি ভাল লাগতো, গল্প করতে করতে পকেটে থাকা পেন্সিল বের করে একটুকরো কাগজে কেমন সুন্দর করে মুহূর্তেই আমাকে এঁকে ফেলতো। কখনো চুল বাঁধা, কখনো খোলা চুলে__ যেদিন যেভাবে থাকি। অবিকল আমি !
যদিও তখন আমাদের টোনা-টুনি'র সংসার ছিল। তবুও কাজ শেষে হন্তদন্ত হয়ে ট্রেন স্টেশনের দিকে ছুটতাম। লন্ড্রি করা, বাড়ি পরিস্কার করা সহ কত কাজ জমে থাকে ! সবশেষে ফ্রেশ হয়ে নিজের রুমে একাকি গান শুনা এসব আমাকে লোভাতুর করে রাখতো। ঘরে ফেরা, যেন শান্তির নীড়ে ফেরা। নিজের একান্ত কিছু সময়ে ফেরা।
মাঝে মাঝে ভর দুপুরের সেই কফি'র সময়টাতে গল্পচ্ছলে বলি, "আরফান, সকাল-সন্ধ্যা কাজ... বাড়ি ফিরে রান্না, খাওয়া, ঘুমানো... রাত পোহালে আবার কাজ__ এটা কোন জীবন নয়। দেশে তোমার বাবা-মা'র কাছে ফিরে যাও। বিয়ে, সংসার, সন্তান__ সবমিলে সবার সান্নিধ্যে অন্য এক জীবন হবে।" আরফান মজা করে বলে, "তুমি যদি সাথে যেতে রাজি হও, কালই উড়াল দিবো, অনেক ভাল রাখবো, যাবে ?" আমি হো হো করে হাসি। বলি, "আমি তো ভালই আছি, ঢের ভাল, নিজের চিন্তা করো গে। "
একদিন ফ্যাকাসে হয়ে থাকা অভিব্যক্তিতে জানায়, তাঁর মা চিঠি লিখেছে। দেশে তাঁদের পারিবারিক ব্যবসায় কিছু সমস্যা চলছে। তাঁকে ফিরতে হবে। আমি খুশি হই। সাত বছর বাদে আমার এই ভিনদেশী বন্ধুটি বাবা-মা'র সাথে মিলিত হবে। তাঁর জন্যে পাত্রীও ঠিক করা হয়েছে। আনন্দের সাথে আমি আমার পছন্দের বেশ কিছু কস্মেটিকস্ কিনি। সুন্দর কস্মেটিকস্ ব্যাগে সাজিয়ে শেষ দিন তাঁকে দেই হবু বউ এর জন্যে।
বিদায়ের সময়টায় আরফানকে খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল। সেই সময় তাঁকে নিদারুন এক মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাওয়া মানুষ মনে হচ্ছিলো। কালো মুখখানা আরও অন্ধকার দেখাচ্ছিল। এদিকে আকাশ কালো আঁধার করে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হল। এক পৃথিবী নিরবতা ভেঙ্গে আমি হাতের ছাতাটি তাঁকে দিয়ে বললাম, "আমি তো এখানেই ট্রেন স্টেশনে ঢুকে যাবো... এটি তোমার কাজে লাগবে"। আরফান কোন কথা বলল না। ছাতাটি নিলো। ভাঁজ করা একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো ফিফ্থ এভিনিউ ধরে। আমি একরাশ কৌতূহলে সেটি খুলেই পড়তে শুরু করলাম।
মাত্র তিনটি লাইন।
" প্রিয় রিমি, এ পর্যন্ত আমার দেখা পৃথিবীতে তুমি চমৎকার একজন যত্নশীল মানুষ।
যতদিন জ্ঞান থাকবে, নিঃশ্বাস থাকবে মনে থাকবে তোমায়।
ভালোবাসি অনেক।" ___ আরফান।"
সামনে তাকাই। ছাতা মাথায় হেঁটে যাচ্ছে আরফান নামের ছয়ফুট উচ্চতার এক যুবক। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি দৃষ্টিসীমায় মিলিয়ে না যাওয়া অবধি। ততক্ষনে শহর ধোয়া ঝুম বৃষ্টি। বলতে দ্বিধা নেই__ কখনো কখনো বৃষ্টি ভালো, কেননা তা বেসামাল অশ্রুজল ধুয়ে নিয়ে যায় সকলের অগোচরে...
চলার পথে এমন করে কতজনে হৃদয়ে দাগ রেখে যায়, হেঁটে যাওয়া পথের পদচিহ্নের মতন। ভাল থাকুক সেইসব মানুষেরা। ভাল থাকুক সকলে।
Thumbnails managed by ThumbPress
৩৮টি মন্তব্য
ইমন
ভালো থাকোক আরফান। ভালো থাকুন আপু আপনিও 🙂
রিমি রুম্মান
শুভকামনা নিরন্তর… ভাল থাকুন আপনিও।
অরণ্য
ভাল লাগলো। আরফান আমার মনে হয় ভাল আছে। এবং ভাল থাকার কথা রিমিটা তাকে যদি তখন ঠিক বাটনটা দিয়ে থাকে। আর সময়ে ও প্রতিবেশে মানুষ ঠিক সামলে নেয় যদি সার্কিট ঠিক থাকে।
ভাল থাকবেন।
রিমি রুম্মান
শুভকামনা রইল। ভাল থাকুক পৃথিবীর সকল মানুষেরা…
অরুনি মায়া
“তোমার আলোয় আলোকিত হই, মন্দ কি ?”
আরফানের এই কথা টি তুমি কখনোই ভুলতে পারবেনা আপু |
আসলে জীবন চলার পথে হঠাৎ ই কেউ কেউ সামনে চলে আসে আর প্রত্যাশার অতিরিক্ত ভালবাসা দিয়ে যায় | বিনিময়ে আমরা কিছুই দিতে পারিনা যতটুকু তার প্রাপ্য |
অনেক ভাল লাগল আপু তোমার জীবনের এই অভিজ্ঞতা |
ভাল থাকুক আরফান,,,
রিমি রুম্মান
আমার একটা বাজে ধারনা ছিল আফ্রিকার কালো মানুষদের ব্যাপারে। কেননা চলতিপথে ওদের ব্যাবহারগুলো খুব কাছ থেকে দেখেছি। আরফানকে জানার পর আমার সেইসব ধারনা পাল্টে গেছে। একজন মানুষের ভালটুকু দিয়ে আমরা পুরো একটি জাতিকে ভাল বলে মূল্যায়ন করি__ বিষয়টি চমৎকার নয় কি ?
অরুনি মায়া
কালো মানুষরা উগ্র হয় স্বভাবে এটা আমিও জানি আপু | কিন্তু এর অতীত ইতিহাস টা বড়ই করুণ | তারা অবহেলিত ,তারা অত্যাচারিত আর তাই তাদের এত ক্ষোভ সাদা দের প্রতি | অবশ্যই আমরা পুরো জাতিকে ভাল বলে মূল্যায়ন করব, কেননা আল্লাহ্র কাছে তার সমস্ত সৃষ্টি মানুষ সমান | আমরা ভেদাভেদ সৃষ্টি করার কে,,,
রিমি রুম্মান
আমার আরেক কলিগ ছিল তৌফিক। সেও আফ্রিকার ঘানা থেকে এসেছে এদেশে। সে-ও মুসলিম। এতো ভাল ছেলে, যে আমি আজো তাঁকে মনে হলে কৃতজ্ঞতায় নত হই। তৌফিককে নিয়ে লিখবো অন্য আরেকদিন।
আবু খায়ের আনিছ
চলতি পথে এমন কিছু মানুষের সান্নিধ্য আমরা পেয়ে যাই যাদের চাইলেও ভুলে থাকা যায় না।
রিমি রুম্মান
এমন মানুষেরা আসে, আবার চলেও যায়। রেখে যায় তাঁদের ভালোবাসাটুকু।
আবু খায়ের আনিছ
ভালোবাসাটুকুই ত আমাদের পাওয়া।
জিসান শা ইকরাম
আপনার এধরনের লেখা গুলোর মাঝে এই লেখাটিই সবচেয়ে বেশী দাগ কেটে গেলো মনে হচ্ছে ……
লেখার ঘুনে, বিদায়ের সময় এর দৃশ্য একদম দেখতে পেলাম……
আপনি আসলেই মায়াবতী, আরফান যা বলেছেন।
ভালো থাকুক আপনার বন্ধু আরফান
ভালো থাকুন আপনি
শুভ কামনা।
রিমি রুম্মান
যদিও একযুগ পেরিয়ে গেছে, তবুও মনে হয় এইতো সেদিন। আরফান হেঁটে যাচ্ছে ফিফথ এভিনিউ… সিক্সথ এভিনিউ ধরে শহর ভেসে যাওয়া বৃষ্টির মাঝে। আর আমি দাঁড়িয়ে থাকি। ভিজতে থাকি। ভিজতে থাকে হাতে থাকা চিঠিখানি। সময় কত দ্রুত হারায়, হায় !
শুন্য শুন্যালয়
এমন তিনটি লাইন এক জীবনের জন্য অনেক অর্থ রাখে, যেখানে ভুলে যাওয়াটাই সচলতা।
রিমি আপুকে আজ অন্যরকম করে দেখলাম, শহর ধোঁয়া ঝুম বৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে।
অদ্ভূত লেখা।
রিমি রুম্মান
আরফানকে নিয়ে কখনো লিখবো ভাবিনি। কাল এই শহরে বৃষ্টি হল। ঝুম বৃষ্টি। ছাতা মাথায় হেঁটে যাওয়া এক যুবককে দেখে কেন যেন অনেকদিন বাদে আচমকা আরফানকে মনে পড়লো। বিদায়ের দিনটির কথা মনে পড়ে গেলো।
নীতেশ বড়ুয়া
রিমিপু, আপনার প্রায় প্রতিট আপোস্টেই আমি একটা করে -{@ রেখে যাই বেশি কিছু না বলে। কেন জানেন?
রিমি রুম্মান
না বললে জানবো কেমন করে ? তবে আশীর্বাদ ধরে নেই আর কি।
নীতেশ বড়ুয়া
আশীর্বাদ কেন হবে রিমিপু! আমার ফুলটি হচ্ছে সেই সব মানুষের জন্য যারা ভালবেসে এতো মধুর স্মৃতি দিয়ে যায় কারণে অকারণে ভাবায়, হাসায় আবার কাঁদায়। শুধু এই ভালবাসার প্রতীক হিসেবে এই -{@
রিমি রুম্মান
চমৎকার ভাবনা তো ! ভাললাগলো অভিনব এই ভালোবাসা সেই সব মানুষগুলোর প্রতি।
নীতেশ বড়ুয়া
😀
-{@
অরুণিমা
এমন দাগ কেটে যাওয়া মানুষের সংখ্যা খুব সামান্য দিদি।
রিমি রুম্মান
চলার পথে দাগ রেখে যায় যারা, তাঁরা এক ঝলক আসে, আবার হারিয়ে যায়।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
অসম্ভব সুন্দর করে লিখেছেন!
বন্ধু! হৃদয়ে দাগ রেখে যাওয়া বন্ধু!!
বন্ধু আরফানের জন্য অফুরন্ত শুভকামনা রইলো এবং সেই সাথে বন্ধু রিমির জন্য ভালবাসা।
ভালো থাকুন সবসময়।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন আপনিও …
ভাল থাকুক সকলে…
শুভকামনা -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
রিমি আপু আপনি এমনই একজন মানুষ যাকে ভালো না বেসে পারা যায়না।
যারা সরাসরি বলতে এবং লিখতে পারে, তাদেরকে সহজে কেউ ভালবাসেনা। পালিয়ে যায়, নয়তো বদলে যায়।
কিন্তু যারা ভালোবাসে তারা কোনোদিন কোথাও যেতে পারেনা।
আরফানও যায়নি। আছে সে, ওই দেখুন সেও আপনাকেই ভাবছে। -{@
রিমি রুম্মান
অনেক কাজের ভিড়ে ডুবে থাকার পরও কোন এক বৃষ্টির দিনে স্মৃতিতে উঁকি দিয়ে যায় আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলের আরফান নামের মানবিক মনের একজন মানুষকে। সে-ও হয়তো বৃষ্টি দেখে বাংলাদেশের এক নারীর কথা স্মরণ করবে।
ভাল থাকুন আপু। -{@
লীলাবতী
এমন ভাবে দাগ রেখে যাওয়া মানুষ গুলো আমাদের মাঝে ভালোবাসা,প্রশান্তি,মায়া কে বাঁচিয়ে রাখে।কেমন করে এভাবে লিখেন আপনি আপু? যেন আমার মনের কথা।
রিমি রুম্মান
জীবন এগিয়ে যায় জীবনের নিয়মে। রেখে যায় কিছু স্মৃতি, কিছু মায়া। ভাল থাকবেন, লীলাপু। -{@
ছাইরাছ হেলাল
সত্যি ই তাই, কিছুই দাগ আমরা বহন করি ই,
গভীর গোপনে বা প্রকাশ্য গোপনে।
রিমি রুম্মান
সেই দাগগুলো কখনো কখনো গহীন থেকে উঠে আসে সকলের অগোচরে। আমি না হয় সেইসব কিছু সোনেলার বন্ধুদের সাথে প্রকাশ্যে শেয়ার করলাম। ভাল থাকবেন। শুভকামনা নিরন্তর। -{@
নাসির সারওয়ার
এমন দাগ থেকে এড়ানোর পথ নেই মনে। মাঝে মাঝে ঝাঁকি দিয়ে কি মনে করিয়ে দেয় কি জানি।
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন। এই মনে করার মাঝেও আনন্দ আছে এই ভেবে যে, চমৎকার এক অতীত পেছনে রেখে এসেছি। ভাল থাকুন, নিরাপদ থাকুন।
আজিম
পৃথিবীতে দেখা যায় অধিকাংশ সময়ই নীতিবানেরা মনে একরকম প্রশান্তি নিয়েই বেঁচে থাকে। কারন তারা লোভের কাছে কোনোরকম নতি স্বীকার করেনা। ওটার চেয়ে কর্তব্যকে বেশি প্রধান্য দেয় তারা। কোনোরকম দোটানা না থাকায় বাঁচেও বেশি এই মানুষগুলি। সফলও হয় তারা, এই যেমন আপনি লেখায় সফলতা অর্জন করে চলেছেন।
অনেক ভাল লিখেছেন, ধন্যবাদ।
রিমি রুম্মান
কোনরকম দোটানা না থাকায় আপনাদের সামনে লেখাটি দিতে পেরেছি। তবে হ্যাঁ, বলতে দ্বিধা নেই, সেই বৃষ্টির দিনে আমার মনের আকাশেও অঝোরে ঝরেছিল বৃষ্টি। ভাল থাকুন প্রিয়জনদের নিয়ে। শুভকামনা।
আজিম
এটা আপনার পোষ্টেই উল্লেখ আছে। তবে এটাও আপনার অসততার কারনে নয় বলে মনে করি।
কিছু মানুষ আসলে মনের মধ্যে কোনো অসততাকে কখনো প্রশ্রয় দেয়না। আপনার লেখাগুলি পড়ে আপনাকে সেরকমটাই মনে হয়।
রিমি রুম্মান
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। চলার পথে ঘটে যাওয়া অনুভূতিগুলো, ঘটনাগুলো ভুলে থাকা হয় না। কখনো না কখনো মনে পড়বেই… -{@
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
জীবনের ছন্দ কোথায় গিয়ে মিলে বলা মুশকিল তবে মাঝে মাঝে কিছু ঘটনা পরকেও বড় আপন মনে হয়।ভাল লাগল আপু অনুভুতিগুলো মনকে নাড়া দিয়ে গেল। -{@
রিমি রুম্মান
কিছু মানুষ একই সঙ্গে দূরের আবার কাছে, তাই না ?
ভাল থাকুন ভাইয়া সবসময়য়। -{@