দহন যাত্রা

পারভীন সুলতানা ২৬ জানুয়ারি ২০১৬, মঙ্গলবার, ১১:০১:১৩অপরাহ্ন গল্প ১১ মন্তব্য

সাত বছর ! হ্যা সাত বছর পর আজ দেশে ফিরছে আবু সাইদ । সেই কবে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে দারিদ্রতার কারণে আর গ্রাজুয়েশনে ভর্তি হওয়া হল না, পেল না কোন চাকরী তখন সিদ্ধান্ত নিল বিদেশে যাবে তা সে যেভাবেই হউক, যে কাজই হউক । বন্ধুবান্ধবেরা বুদ্ধি দিল ড্রাইভিংটা শিখে নিতে । পাচ মাসে বেশ ভালোরকম রপ্ত হল ড্রাইভিং।
কিন্তু চাকরী কোথায়? কেবল ট্রেনিংপ্রাপ্তকে কেউ রাখতে চায় না।সদ্য ট্রেনিং পাওয়া ড্রাইভারের হাতে মুল্যবান গাড়ী কে ছেড়ে দেয় ?অনেক ঘোরাঘুরি করেও যখন কিছুই হল না । কি আর করা, একটি বাস কোম্পানিতে ড্রাইভারের সহকারী হিসাবে যোগ দিল । লাভ হল , ড্রাইভার সাহেবের ক্লান্তিময় মুহূর্তে গাড়ী চালানোর সুযোগটা পাওয়া গেল। অবশ্য ঝানু ড্রাইভার মফিজ শুরুতে বেশ কয়েকবার ওর পরীক্ষা নিয়েছিল।এরপর এমনটা হল, দুরপাল্লায় গাড়ী চালাতে চালাতে মফিজ ড্রাইভার যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ত তখন গাড়ী চালানোর ভারটা ওর ঘাড়েই পড়ত, সাইদ খুব খুশি মনে করত ।সাইদের ব্যাবহার , আচার আচরণে সন্তস্ট হয়ে মফিজ ড্রাইভার ওকে এক সাহেবের গাড়ী চালানোর কাজ জুটিয়ে দেয়। মুলতঃ মফিজের সুপারিশেই ওর চাকরীটা হয়ে গেল।
আসিফ সাহেব বিপত্নীক এবং একা মানুষ, দুই ছেলে বিদেশে থাকে । বনানীর বাসায় একা থাকেন। বাবুর্চি , কেয়ার টেকার, মালী ড্রাইভার ইত্যাদি নিয়েই ওনার সংসার। নিজ্ঝাট আসিফ সাহেবের কাজে সাইদের দুবছর কেটে গেল ।খাওয়া দাওয়া ফ্রি, বেতনের একটা অংশ বাড়িতে বাবামাকে পাঠায়। নিজের বিড়ি সিগারেট ফুকার কোন অভ্যাস নেই , কাজেই বাড়তি খরচ নেই একেবারেই । উপরন্তু মাঝেমধ্যে সাহেব বকশিস দেন । আর সাহেবের বিদেশ অবস্থান কালে প্রায়ই ছুটি নিয়ে বাড়ী আসে। অর্থাৎ ভালই ছিল সাইদ । কিন্তু তারপরেও মনের গহীনে স্বপ্ন উঁকি দেয় অবসরে । বিদেশ যাবে, যাবে ড্রাইভার হয়ে । কথা প্রসঙ্গে একদিন সাহেবের কাছে নিজের ইচ্ছার কথা বলেই ফেলল সাইদ। এমনিতেও সাইদের উপর সন্তস্ট ছিলেন আসিফ সাহেব। মুখে বললেন, আজকাল খুব কঠিন বাইরে কাজ পাওয়া কিন্তু মনে মনে ঠিক করলেন , ছেলেটাকে যতটা পারেন আন্তরিকভাবে সাহায্য করবেন। বড় ভাল ছেলেটা, সৎ এবং আন্তরিক।

হ্যা মাত্র কয়েকমাসেই আসিফ সাহেব তার এক বন্ধুর জনশক্তি রফতানি কোম্পানির মাধম্যে সৌদি আরবে ভারী যান চালানোর ড্রাইভারের কাজ পাইয়ে দিলেন। সে বড় আনন্দের দিন । গ্রামে ফিরে যেয়ে জ্ঞাতি গোষ্ঠীদের কাছে থেকে ধারবাকিতে যাওয়ার খরচটা জোগাড় করে ফেলল । তারপর একদিন সেই যে উড়াল দিল হাযার হাযার মেইল দূরে, আল্লাহর ঘরের দেশে , নবীজীর রওজার ঠিকানায় ।
তারপর অনেক জল গড়িয়ে গেছে বুড়িগঙ্গায়, কোথাও বা আটকে গেছে জল , পচে একসার হয়েছে কাদামাটি ।শেওলা জমেছে, দুর্গন্ধ জন্মেছে , কোথাও কোথাও থেমে গেছে জলের প্রবাহ । কিন্তু তারপরেও জীবন থেমে থাকেনি । যারা দেশে আছেন, তাদের জীবন সুখেদুঃখে একান্ত নিজস্ব বলয়ে দশজনের সাথে আপন প্রবাহে কেটে গেছে । কিন্তু যে তরুণ মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে সোনার ডিম পারা হাসের খোঁজে দেশ ছেড়েছিল, আজ সে বত্রিশের পরিনত যুবক । কি পেয়েছে পাথরময় মরুর জীবনে সদ্য প্রস্ফুটিত বাইশের তরুণ । হাড়ভাঙ্গা কঠোর পরিশ্রম ,আত্মীয় পরিবারহীন নিরানন্দ অবসর, মায়ের হাতের সুস্বাদু খাবার এবং স্নেহহীন বুভুক্ষ জীবন । তারপরেও আছে চাকুরীতে গরীব দেশের মানুষ বলে উপেক্ষার বহর।কতগুলো ঈদ কেটে গেছে, মনে পড়েছে ছোটবড় সবাইমিলে ঈদের আনন্দ করা। নামাজ পড়ে বাড়ী ফিরতেই মায়ের হাতের সেমাই , পোলাও কোর্মা । ইস কতদিন, ভুলেই গেছে সে সবাদ।মরুর দেশে বিদেশিদের কোন ঈদ নেই, শুধু আছে কাজ আর কাজ । আর আছে কাজের বিনিময়ে তরল সোনায় ছাপা কাগজের নোট গোনা । একমাত্র সাথে সহকর্মী ভাইরা, ওরাই বন্ধু, ওরাই স্বজন । অসংখ্য বিনিদ্র রাত , কাউকে নিজের করে একান্ত করে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় স্বপ্নের জাল বোনা , এবং এক সময় ক্লান্ত অবসন্ন দেহে ঘুমিয়ে পরা । পরদিন ভোরে উঠে আবার সেই চিরায়িত জীবন।
সাতটি বছর, অনেক অনেক সময় ।
শাহজালাল এয়ারপোর্টে পা রাখতেই স্ফিতবুকে এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সাইদ । জানে এয়ারপোর্টের বাইরে অপেক্ষামান ওর একান্ত আপনজন ।ইমিগ্রেশন এবং লাগেজ সংগ্রহ করে গ্রীন চ্যানেল দিয়ে বের হয়ে আসে সাইদ । চোখে পরে বৃদ্ধ বাবা আবু সাইফ, মা আয়শা খাতুন আর ছোট ভাইবোনদের । আনন্দের এক ফল্গুধারা বয়ে যায় অন্তরে ।ফিরে এসেছে, ফিরে এসেছে নিজ দেশে, গরীব দেশের মেহনতি সন্তান সাইদ। জমাপুঞ্জি যা করেছে তাই দিয়ে দেশেই কিছু করবে ও । ছুটিতে এলেও আর ফিরে যাবে না ও।

বাবা আবু সাইফ কুমিল্লার চোদ্দগ্রাম থেকে মাইক্রবাস ভাড়া করে নিয়ে এসেছিলেন। সবাই মিলে হইচই করে ফিরে এল বাতাবী গ্রামে বিদেশ ফেরত পুত্রসহ । এ যেন এক উৎসব , উৎসব আবু সাইদের গরীব বাড়ীতে। না গরীব আর কোথায় ? এখন সানবাঁধানো ভিটায় চার রুমের টিনের চৌচালা ঘর। ঘরের সাথে পাকা টয়লেট, বাথরুম । বাড়ির আঙিনায় ডিপ টিউবওয়েল । না এ বাড়ি রেখে যায়নি আবুসাইদ কিন্তু সৌদি যাবার প্রথম তিন বছরেই ঋণ শোধ দিয়ে বাবাকে বলে বাড়ির চেহারা পালটে ফেলেছে। বুকটা আনন্দে ভরে উঠে ,চোখে খুশির ঝলক নাচে। নাহ ওর এতগুলি বছর বৃথা ব্যায় হয়নি । ওর গরীব বাবামা ভাইবোন একটু আরাম আয়েশে থাকতে পারছে । একি কম সুখের ব্যাপার !
কালার টিভি, কম্বল, মোবাইল সেট,হাতঘড়ি,কাপড়চোপড় , চকলেট কি আনে নাই। আপনজনদের ছাড়াও গ্রামের জ্ঞাতি বন্ধুবান্ধব , কারো কথাই ভুলে নাই আবু সাইদ। একবাক্যে সবাই খুশি ।

দিনতিনেক শুধু হাসি আনন্দ আর এরওর সাথে দেখা করা, গল্প গুজব আর মায়ের নানপদের রান্না খেয়েই কাটিয়ে দিল।
তিনদিন পর রাতে বাবা মায়ের সাথে সিরিয়াসলি বসল। আসলে বাবা আবু সাইফই বসলো ছেলের সাথে। আগেই চিঠিতে এবং ফোনে কথা হয়েছিল এবার আবু সাইদকে বিয়ে করে যেতে হবে। বাবামা গোটা তিনেক মেয়ে প্রাথমিক পছন্দ করে রেখেছেন , ঘরপরিবার সব দেখাশুনা বাকি শুধু সাইদের চূড়ান্ত পছন্দ ।প্রতিটি কন্যার বাবাই এই বিয়েতে মেয়েকে যাবতীয় খাটপালং, ড্রেসিংটেবিল , ছেলের পোশাক , ঘড়ি আংটি ছাড়াও নগদ দিতে উৎসুক ।
মাথা নিচে করে শোনে সাইদ। বাবার এমন মতাদর্শকে মোটেও সায় দিতে পারে না সাইদ। অনুগত এবং বিনয়ী ছেলে বাবামাকে বোঝায়, ওর নিজের দুটি বোনই বিবাহযোগ্যা। এইভাবে মেয়ের বাবামার অসহায়ত্বের সুযোগ গ্রহন করা উচিৎ নয়।ব্রং খুব ভাল হয় যদি পালটাঘরে বিবাহযোগ্য কোন ছেলে থাকলে বনের বিয়ের কথা বলা। তাছাড়া সাইদের বড় বোনটি এখন গ্রামের কলেজে বিএ পড়ে , দ্বিতীয়টি এস এস সি ফাইনাল দেবে এ বছর ।বাবামা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে এবং চেলের কথায় চুপ করে যায় । নাহ বাবামার উপযুক্ত সন্তান আবুসাইদ , পরামর্শটি মন্দ মনে হয় না।
আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই মেয়ে দেখতে যায় আবুসাইদ। আগেই খবর নিয়ে দেখেছে কোন মেয়েটির যোগ্য ভাই রয়েছে।বোনের বিয়ের কথা মাথায় রেখেই দেশে ফিরেছে সাইদ এবং সে ভাবেই মেয়ে দেখতে গেল। মেয়েটি আসলেই দেখতে মন্দ নয়, লক্ষিমন্তি চেহারা , এস এস সি পাশ করে আর পড়াশুনা করেনি । বয়সটা উনিশকুড়ি হবে, তা হউক না হয় একটু বেশিই ছোট ।

ইতিপূর্বে বাবমাকে জানিয়ে দিয়েছে আবু সাইদ তিনমাসের ছুটিতে এলেও আর ফিরে যাবে না ও। কিছু টাকা ডাউনপেমেন্ট করে ব্যাঙ্ক ঋণ নিয়ে ট্যাক্সিক্যাব কিনবে ও। তাই চালিয়ে ঋণ শোধ আর সংসার চালাবে। আর কিছু টাকা দিয়ে পতিত জমি কিনে বিভিন্ন ফলের চাষ , পুকুর করে মাছ চাষ আর গরুর খামার করবে ।ছোট ভাইটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ বর্ষে পড়ছে।পড়া শেষ করে সে এগুলো দেখাশুনা করুক আর ও ট্যাক্সি চালিয়ে যা আয় করবে তাতেই চলবে।
না, ছেলের সিদ্ধান্ত খুব মন্দ মনে হয় না কিন্তু তারপরেও আবু সাইফ অসহায় বোধ করেন। ভালইত ছিল ছেলে বিদেশ থেকে মাসে একটা ভাল টাকা পাঠাত, সামান্য জমির আয় মিলিয়ে ভালই চলছিল । উপরন্তু ছেলে টাকা জমিয়ে বাড়ীঘর ঠিক করেছে। বলছে আরও কিছু পুঁজি জমা আছে । কি দরকার ছিল, ফিরে আসার। আরও পাঁচটা বছর থাকত না হয় । বিয়েটা সেরে চলে যাওয়াই ভাল। কত মানুষ আছে না ! আরও একটি বোন আছে ,বড় মেয়ের না হয় বিয়ে হচ্ছে । কে পোষাবে এতসব খরচ ? নাহ আর ভাবতে পারে না ।
কিন্তু আবু সাইদের মা ছেলের সাথে একমত। পচিশ বছরের ছেলে আজ আট বছর পরে ফিরে এসেছে বত্রিশ বছরের হয়ে। মা যেন ভুলতেই চলেছিলেন তার পঁচিশ বছরের ছেলেটি বেচে আছে কোথাও কোনখানে । না উনি আর ছেলেকে যেতে দেবেন না। যা উপার্জন হবে তাই দিয়ে ওর নিজের সংসার চলাতে পারলেই হল । অন্য ভাইবোনের দায়িত্ব ওর নয়।মা সেট মা’ই হয় আর এই জন্যই বুঝি সর্বশক্তিমানের পরেই মায়ের স্থান দেয়া হয়।

কুমিল্লার হোমনায় বাইশারি গ্রামে একই পরিবারে ভাইবোনের পালটাপালটি বিয়ে ঠিক হয়ে যায় । ঠিক হয় একমাস পর বিয়ে। ভাইবোনের একত্রে বিবাহের কারণে একটি কমিউনিটি হল ভাড়া করা হয় , যেখানে একসাথে সাইদ এবং ভাবি ভগ্নীপতি বরবেশে আসবে। বাড়ীর প্রথম বিয়ে, তার উপর জোড়া বিয়ে । এ যেন এলাহি ব্যাপার। নানাজনের নানা ফরমাশ, নানাবিধ কেনাকাটা, এর কাপড় ওর জুতা ইত্যাদিতেই ব্যাস্ত সবাই ।আনন্দের এক ঝর্ণাধারা বয়ে যায় পরিবারে।
সবাই যখন বিয়ে আনুসাঙ্গিকতায় ব্যাস্ত, এই অবসরে আবু সাইদ ব্যাঙ্কের সাথে যোগাযোগ করে এবং নিজের পুঁজি হতে একটা ভাল পরিমাণ জমা দিয়ে টয়োটা গাড়ি কিনে ফেলে। শো-রুম থেকে ডেলিভারি নিয়ে সোজা চৌদ্দগ্রাম চলে আসে। সবাইকে দেখানো এবং সেই সাথে একটি গোপন ইচ্ছা, বহুদিনের স্বপ্ন নিজের কেনা গাড়িতে করে বর সেজে বিয়ে করতে যাওয়া । বাড়ির আঙ্গিনায় গাড়ি আসতেই , চারিদিকে সাড়া পরে যায় । সবাই প্রশংসা আর বাহবায় ধন্য ধন্য করে । এমন ছেলে ক’জনের হয় ! দারুন ভাগ্য আবু সাইফের, ধন্য পিতা আবু সাইফ। পূর্ব পুরুষদের অনেক দোয়া পেয়েছে সে।
মার্চের সাতাশে বিয়ের দিন ধার্য হয়েছে । আর মাত্র তের দিন বাকি ।সন্ধ্যা হতেই সকলে রঙ্গিন টিভির সামনে । যে বাড়িতে সাদাকালো টিভি ছিল না এতদিন, আজ সেখানে মস্ত রঙ্গীন টিভি।সবাই বিভিন্ন চ্যানেল ঘুরিয়ে পছন্দের অনুষ্ঠান দেখছে, একটু আধটু কাড়াকাড়ি , মন কষাকষি হচ্ছে কখনো কখনো। এরই ফাকে মুরুব্বীরা দেখছেন খবর। আজ কদিন সবাই খুব উৎকণ্ঠিত , রাজনীতির নামে কি চলছে দেশে! রোজ কোথাও না কোথাও বাসে, গাড়িতে , টেম্পোতে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে একদল। এ কেমন রাজনীতি ?একদল আরেকদলের সাথে মারামারি করে, ধস্তাধস্তি করে, তাও দেখেছে সবাই । হরতাল, ধর্মঘট , মিছিল মিটিং সবাই হবে এটাই সবাভাবিক। সকলেই জানে রাজনীতিমানে জনসভা আর শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত রাজপথ।কিন্তু একেবারেই রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এমন নিরীহ খেটে খাওয়া মানুষগুলকে জিম্মি করে রাজনীতি , এ কেমন নিয়ম?
সৌদি ফেরত আবু সাইদ বিসন্ন হয়ে পরে। একি দেশ আর দেশের জনগণের বিভীষিকাময় জীবন ? এই দেশেই আর দশজনের মত গায়েগতরে খেটে জীবন নির্বাহ করতে ফিরে এসেছে ও! প্রায় মাসের অধিক প্রতিদিন পেট্রোল বোমার বিস্ফোরণ ,জলন্ত মানুষের উদ্বাহু নৃত্য খবরের কাগজের পাতায় । একেবারে সাধারন মানুষগুলো প্রতিদিনের শিকার। নিরীহ ঘুমন্ত বাসযাত্রি, গরীব টেম্পো চালক তার ক্লান্ত অবসন্ন ঘুমন্ত শিশু, সংসারের কলুর বলদ বাস ড্রাইভার, স্কুলগামী বালকবালিকা , অসুস্থ স্বামী । কে নয় ? কিন্তু কোন রাজনইতিক দলের কর্মী নয় কেউ । এ কেমন সভ্যতা? কিসের গণতন্ত্র ?
গণতন্ত্র ,উপনিবেশ, সমাজতন্ত্র এ সব ভারি ভারি শব্দ বোঝে না অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ,অল্পশিক্ষিত সাধারন খেটে খাওয়া মানুষ । তারা কাজ চায়, কাজ করে দুমুঠো উপারজন করে ছেলেসন্তান নিয়ে আরামে ঘুমাতে চায় । একি অভিশাপগ্রস্ত জাতি? রাজনৈতিক দলের আদর্শ হওয়া উচিস সাধারণের রক্ষক হওয়া , না তা কোথায় ? আজ তারাই ভক্ষক।

বিয়ের তিনদিন আগে সবাই বসে মিটিং হল।অনেক আলাপ আলোচনায় স্থির হল এমন অবস্থায়, নতুন গাড়ি দিয়ে বরযাত্রী না যাওয়াই উচিৎ। গাড়ির কিছু হলে আর উপায় থাকবে না। আবু সাইদ খুব সচেতন ও বুদ্ধিমান ছেলে ।সহজেই পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে জানে সেই ছোট বেলা থেকেই। হ্যা সকলের সাথে বাসে করেই যাবে, বেশিত দূর নয় সকালে যেয়ে দুপুর নাগাদ বিবাহ সম্পূর্ণ করে দিন থাকতেই ফিরে আসা।
সেই কাকডাকা ভোরে ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠেছে সবাই, আজ এ বাড়ীর দু দুটো বিয়ে। আত্মীয়স্বজনে সরগরম সারা বাড়ী । এতগুলো মানুষের নাস্তাপানি কম কথা নয়, রিতিমত হৈ চৈ হাঁকডাকে ব্যাতিব্যাস্ত সবাই । ঘুম ভেঙ্গে যায় আবু সাইদেরও । গতকাল ওর হলুদ হয়েছে, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবেরা মিলে কাল খুব করে হলুদ দিয়েছে ওকে। দুপুরে ওবাড়ি থেকে হলেদের ডালা এসেছে, এসেছে ওর বিয়ের পোশাক, জুতা আর আনুসাঙ্গিক সব।না কোন যৌতুক নেয় নি আবু সাইদ।বিনিময়ে ওরাও অদের বোনকে ছেলে দিয়ে নিজেরাই সাজিয়ে নিচ্ছে ঘরে ।
ওর দুহাতে এখন বিয়ের মেহেদী, পাঁচ পাচ দশ আঙ্গুলে ঘন কালচে রঙ্গের মুকুট পরানো , তালুতে বিয়ের চাঁদ ; জানান দিচ্ছে বিয়ে হচ্চে ওর । এ দেশে ছেলেরা শুধুমাত্র বিয়ের সময়ই এ ভাবে দুহাতে মেহেদী পরে ।ঐ বাড়িতেও সকল কিছু পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে কাল সকালেই। জোড়া রুই, রঙিন কাগজে বরবউ সাজিয়েছে ছোট ভাইবোনের দল।কি জানি সেই একজনের কি অবস্থা। সেও কি এমন করে ভাবছে ওর মত। কত রাত বিনিদ্র কাটিয়েছে, মনের মত একজনকে সুখদুঃখের সাথি পাবে, ভালবাসবে জীবন দিয়ে একান্ত আপনার করে।
না, আরেকটু শুয়ে থাকতে চায় ও।অবিবাহিত জীবনে এই একা শুয়ে থাকার পরিসমাপ্তি নিজের মত করে উপভোগ করতে চায় । কত যে ভাব না আসছে মনে। নাহ, অনেক কষ্ট করেছে, জীবনের সমস্ত সাধ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছে শুধু সবার জন্য একটু সুখ কিনবে বলে । পরম করুনাময় কি ওর সে আশা পূরণ করবে না ? না বেশি কিছু চায় না । একটু নিঝঞ্ঝাট নিরুপদ্রপ জীবন ওর একান্ত কাম্য ।

দশটা নাগাদ সবাই মোটামুটি রেডি। সাইদের বাবা খুব হাসিমুখে ছেলেকে পাগড়ী পরালেন , মা মিষ্টি খাওয়ালেন। আজ বড় সুখের দিন, দু দুটো সন্তাঙ্কে একই আসরে বিয়ে দিচ্ছেন। সৃষ্টিকর্তাকে হাযারও শোকর ।কমিউনিটি সেন্তারে পৌছাতে পৌছাতে বারটা পার হয়ে গেল। সবাই নিকটস্থ মসজিদে নামাজে শরীক হল ।
বেলা আড়াইটা নাগাদ দুপক্ষের বিয়ে কোন ঝামেলা ছারাই সমাধা হয়ে গেল । দুপক্ষই আগেভাগে গেট ধরা। জুতয়া চুরির টাকা সমাধান করে নিয়েছিল, তথাপি আনন্দে ঘাটতি হয়নি একটুকু। এবার বিদায়ের পালা, সাইদ জননী বুকের এক অংশ কন্যাকে রেখে বউ নিয়ে বাসে উঠলেন ।

ঘন্টা খানেক চলার পর সবাই বলতে লাগলো একটু চা খেতে পারলে ভালই হত। ড্রাইভার বেচারার বোধকরি ঘুম পেয়ে থাকবে , কাজেই সুযোগ মত একটি বহুল পরিচিত রেস্টুরেন্টের সামনে থামাল। হুড়মুড় করে প্রায় সবাই নেমে গেল। নতুন বর আবু সাইদ, নববধুকে ছেড়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না ভেবে বসে থাকল। পিছনের দিকে আরও দুচারজন বয়স্ক আত্মীয়া এবং দুটি বাচ্চা রয়ে গেল। অবশ্য আবু সাইদের মাও আছেন পিছনে ওদের সাথে।খেয়াল রাখছেন নতুন বউর দিকে।আড় চোখে এতক্ষণে তাকে একটু দেখবার ইচ্ছে হল খুব, একটু ঝুকে ঘোমটার আড়ালে তাকাতেই তরল কি যেন একটা গায়ে পড়লো , সাথে আগুন। সদ্য বিবাহিত বউটির গায়ে দাউ দাউ আগুন, জানালার ধারে সেই বসেছিল, জানালা গলিয়ে আগুনের হাতছানি জড়িয়ে ধরেছে আবু সাইদকেও । চিৎকার দিয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরে আবু সাইদকে। আবু সাইদও ওর না দেখা ভালবাসাকে আগুনের লেলিহান শিখা থেকে বাঁচাতে জড়িয়ে ধরে। কোন রকমে দরজা গলিয়ে বেড়িয়ে আসে। পিছনের মহিলা ও শিশুদের জানালা দিয়ে বের করে নিয়েছেন অন্যরা।জলন্ত বাসের পাশে জড়াজড়ি জ্বলছে সদ্য বিবাহিত যুগল। চারিদিকে আগুন, নেভাও, বাচাও , পানি, পানি কই ইত্যাদি চিৎকার আর হাহকারের মধ্যে এক সময় নিভে গেল আগুন। ততক্ষনে   কাল কুচকুচে জোড়া অঙ্গার  মানবমানবি দহন যাত্রার শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে অনন্ত বাসর শয্যায়।

0 Shares

১১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ