বধ্যভূমি ছোট
খুব বেশি দূরে আর কই? ঘর থেকে পা বাড়ালেই মিরপুর দশ নম্বর গোলচত্বর। সেখান থেকে রিকশা নিলাম আমরা। অগ্নি নির্বাপণ সংস্থার কার্যালয় পেছনে ফেলে কিছুদূর এগোলেই মিরপুর বেনারসি পল্লীর ১নং গেট। সেই গেট অতিক্রম করে পৌঁছলাম পিচঢালা পথের শেষমাথায়। সেখানে অবস্থিত পুরোনো পাওয়ার হাউজ।
পুরোনো সেই পাওয়ার হাউজের পাশেই বাঙালির বেদনাভারাক্রান্ত অসংখ্য স্মৃতিপীঠের একটি- ‘জল্লাদখানা বধ্যভূমি’।

কুখ্যাত এই বধ্যভূমিটি মূলত মিরপুর দশ নম্বর শহরাঞ্চলের ঝুটপট্টির অন্তর্গত নির্জন একখণ্ড জমির উপর অবস্থিত। জমির একপ্রান্তে একটি একতলা পাকা ঘর। স্বাধীনতাপূর্বকালে এই অঞ্চলের জল সরবরাহ নিশ্চিত করতে এখানে বসানো ছিলো একটি জল উত্তোলন যন্ত্র।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের বিরুদ্ধপক্ষ চোখ আর হাত বেধে আমাদের স্বজনদের ধরে আনতো এখানে। একটা ১ বর্গফুট বেদীর উপর তাঁদের মাথা চেপে ধরে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তা বিচ্ছিন্ন করতো শরীর থেকে। তারপর সেই দেহখণ্ডগুলো ফেলে দিতো দুটো বর্গাকার কূপে।
নির্মমতা-বিভৎসতায় এতোটাই কুখ্যাত হয়ে উঠেছিলো এই বধ্যভূমি যে, একসময় এর নাম প্রতিষ্ঠিতই হয়ে যায় জল্লাদখানা হিসেবে।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে নানা ধরনের তিক্ত স্মৃতির চাপে আমাদের শহীদ-স্বজনরা অনেকটাই তলিয়ে যান বিস্মৃতির অতলে। বিরুদ্ধ সময়ের চাপে ঢাকা পড়ে যায় বধ্যভূমিগুলোর বুকভাঙা কাহিনীও। কিন্তু কোনো চাপই যে শেষ পর্যন্ত বাধাগ্রস্ত করতে পারে না সত্যের প্রকাশপথকে, তার উজ্জ্বল প্রমাণ হিসেবে দৃশ্যমান হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের একটি অনন্য উদ্যোগ।

১৯৯৯ সালে শহীদ স্বজনরা আবার প্রবেশ করেন জনগণের আলোচনার মূলস্রোতে। ভাবনার কেন্দ্র জুড়ে পুনরায় ধ্বনিত হয় বধ্যভূমির বৃত্তান্ত। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি আক্কু চৌধুরীর পরিচালনায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৪৬ পদাতিক বিগ্রেডের সহায়তায় মিরপুরে শুরু হয় বধ্যভূমি খনন।
ভীষণ শ্রমসাধ্য এই খননের এক পর্যায়ে উঠে আসে পরিপূর্ণ এক বেদনার ভাণ্ড, যার ভেতরে জাতির রক্তাক্ত ইতিহাসবোধ, স্বজনহারার কান্না-ক্রোধ, যুদ্ধাপরাধের সুস্পষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণাদি বিদ্যমান। বেদনাভাণ্ডের অভ্যন্তরের উপাদানগুলো রক্ষা করার যথাসম্ভব চেষ্টা করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বিরুদ্ধশক্তির সক্রিয়তার বিপরীতে সে চেষ্টা সফলতার মুখ দেখে খুব সামান্যই।

তবে সামান্য সফলতাও যে চেতনার অগ্নিস্পর্শে কখনও কখনও ধারণ করে অসাধারণ আঙ্গিক, তার প্রশংসনীয় দৃষ্টান্ত জল্লাদখানা বধ্যভূমির প্রায় ত্রিকোনাকার ছোট্ট জমিটি, যেখানে ‘ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন অব হিস্টোরিক সাইট মিউজিয়ামস অব কনশান্স’ এর সংশ্লিষ্টতায় এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের তত্ত্বাবধানে ২০০৭ সালের ২১ জুন, বৃহস্পতিবার, বিকেল চারটায় উদ্ধোধিত হয় একটি সংরক্ষিত স্থাপনা- জল্লাদখানা বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠ।

ফেলে আসা সেই সব দিনের কথা ভাবতে ভাবতে আমরা প্রবেশ করি স্মৃতিপীঠের অভ্যন্তরে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হকের শিল্পভাবনার প্রেক্ষাপটে স্থপতি রবিউল হুসাইন নির্মিত এই জল্লাদখানা বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠের অসম ভূমিপৃষ্ঠটির অবস্থান রাস্তা থেকে প্রায় সাড়ে তিন ফুট নিচুতে। ভাঙা দেয়ালাকৃতির বেষ্টনীপ্রাচীরের ডানকোণে চার ফুট প্রশস্ত আধা বৃত্তাকার ছাদের প্রবেশপথ। তারপর সাতধাপ বিশিষ্ট সিঁড়ি এবং সিঁড়ি যেখানে শেষ, সেখান থেকে পায়ে চলার পথ শুরু।

বাংলার আদি নির্মাণ সামগ্রীতে নির্মিত সেই পায়ে চলার পথে কেবলই বেদনাগাথা।
দেয়ালের পাশ জুড়ে সমাধিফলকের আকারে শ্বেতপাথরে কালো অক্ষরে খোদিত সাড়ে চার শতাধিক হননভূমির বিভাগওয়ারী নামগুলো পড়তে পড়তে ঝাপসা হয় চোখ!
এতো এতো নামের অসম্পূর্ণ প্রবাহ মনের ভেতর তৈরি করে এক বিমূর্ত অভিঘাত, যা থেকে অবমুক্ত হয়ে মূর্ত জীবনের চলমান ধারায় আবার অভিযোজিত হতে সাহায্য করে হাঁটা পথের সমদূরত্বে স্থাপিত মৃন্ময়পাত্রে সংরক্ষিত ছয়টি বধ্যভূমির মাটি; সাহায্য করে স্মৃতিপীঠের পশ্চিমদিকে স্থাপিত পনেরো বর্গফুট আকারের একটি নান্দনিক দেয়ালচিত্র।

পরিত্যাক্ত পোড়া ইট, সিমেন্ট, মাঝে মধ্যে লোহার খাড়া দণ্ড সহযোগে খুব সাধারণ অথচ অসাধারণ মনকাড়া ভঙ্গীতে নির্মিত এই দেয়ালচিত্রটিতে একাত্তরের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের মর্মস্পর্শী প্রকাশ ঘটিয়েছেন যশস্বী শিল্পী রফিকুন্নবী এবং মোহম্মদ মুনীরুজ্জামান। সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াই আমরা। ক্ষরিত হৃদয়ে অনুভব করার চেষ্টা করি ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা শহীদ দেহাবশেষ আর তাঁদের চেতনার স্পর্শে উদীয়মান সূর্যের উষ্ণতাকে।

তারপর আবার হাঁটা- হাঁটতে হাঁটতে চোখ যায় উত্তরদিকের দেয়ালে, যেখানে পৃথিবীর তাবৎ হত্যাযজ্ঞভূমির নাম এবং হত্যাসংখ্যার বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের সাথে স্বদেশভূমির সন্নিবেশন প্রয়াস প্রতীয়মান। এই প্রয়াস আমাদের ভেতর জাগ্রত করে যে হাহাকার তার শেষ কোথায়?
সম্ভবত কালো গ্রানাইড পাথরের ওপর লাল হরফে লেখা শহীদ জহির রায়হানের সত্যভাষণে- ‘স্টপ জেনোসাইড’- ‘গণহত্যা বন্ধ করো’-

পূর্বদিকে প্রক্ষালন কক্ষের পাশে বধ্যভূমির দুইটি কূপের একটি। এই কূপটির অবস্থান সম্পূর্ণ উন্মুক্ত পরিবেশে। মোটা একখণ্ড কাঁচে আচ্ছাদিত কূপটির বর্গাকার মুখ। পাশেই সর্বাপেক্ষা আলোচিত কক্ষটি। কক্ষটির প্রবেশপথের ওপর একটি পেতলের ঘণ্টা ঝোলানো। কক্ষের ভেতরে ঢোকার মুখেই বাংলাসহ পৃথিবীর সর্বাধিক প্রচলিত ছয়টি ভাষায় খোদিত ‘কী ঘটেছিলো এখানে?’- এমন একটি প্রশ্ন।
প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পেতলের ঘণ্টায় অনুরণন তুলি আমরা। প্রবেশ করি আলো-অন্ধকার কক্ষের ভেতরে।

এই কক্ষেই অবস্থিত বর্গাকৃতির দ্বিতীয় কূপটি- একটি চতুষ্কোণ কৃষ্ণবলয়ের ভারসাম্যহীন কোণে- এই কূপের ওপরও মোটা কাঁচের আচ্ছাদন, যার ওপরে লেখা ‘মাথা নত করে শ্রদ্ধা নিবেদন করি সকল শহীদদের প্রতি’- নিচে কালো জল কৃষ্ণসময়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কূপের কাছেই সাদা রংয়ের নিধনবেদীটি। বেদীর উপর রক্ষিত এই বদ্ধভূমির পবিত্র মাটি। কক্ষটির ভেতর ছোট একটি আলমারি সদৃশ্য স্থানে রয়েছে খননের সময় প্রাপ্ত কিছু শহীদস্মৃতিচিহ্ন। প্রদর্শন সংখ্যায় যা অল্প, কিন্তু বেদনাভারাক্রান্ততায় অসীম- এতো বেদনার ভার সহ্য করে সাধ্য কার!

দমবন্ধ হয়ে আসে ভেতরে। বাইরে আসি দ্রুত- চিত্ত বিদারিত এই উপলব্ধি থেকে পরিত্রাণ পেতে একটু বসি স্মৃতিপীঠের সর্বাপেক্ষা খোলামেলা এবং সর্বশেষ কক্ষটিতে। কক্ষটির চারকোণায় চারটি কাঠের টেবিলের উপর বধ্যভূমি সংক্রান্ত নানা তথ্য, উপাত্ত এবং ‘দ্যা জেনোসাইড কনভেনশন, ১৯৪৭’-এর সংরক্ষিত কপি। আর মাঝখানে সিমেন্টে বাঁধানো টেবিলের উপর রাখা আছে একটা পরিদর্শন খাতা। মন চাইলে কিছু লেখা যায় এই খাতায়- লিখবো কিছু? ভাবি একা একা- মন তো চায় লিখতে! কিন্তু কি লিখবো? বেদনার কথা? বেদনার কথা লিখতে যে ভালো লাগে না- কিন্তু লিখি শেষঅবধি- বেদনার কথাই, তবে নিজের কথা নয়, কাহলিল জিবরানের- ‘তোমার উপলব্ধিকে আবৃত করে রাখে যে খোলস, বেদনাই তাকে বিদীর্ণ করে-’

 

0 Shares

১৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ