‘‘সমাজ, পরিবার সবকিছু উলটো পথে হাঁটছিল৷ সব প্রতিবন্ধকতা ভেদ করেই আজকের জায়গা তৈরি করতে হয়েছে৷’’ ডয়চে ভেলেকে বলছিলেন তাসনুভা আনান শিশির, বাংলাদেশে প্রথম টেলিভিশনে সংবাদ পাঠের সুযোগ পাওয়া ট্রান্সজেন্ডার নারী৷

সম্প্রতি বাংলাদেশের তাসনুভা আনান শিশিরকে নিয়ে তোলপার,হৈচৈইয়ের শেষ নেই। কারন ট্রান্সজেন্ডার সংবাদ পাঠিকা হিসেবে তিনি বৈশাখী টিভিতে যোগদান করেছেন। কিন্তু আমার একটি প্রশ্ন বারবার মাথায় ঘুরছে সেটি হল শিশির কি হিজড়া না ট্রান্সজেন্ডার? অনেক রিপোর্টার বলছেন, ট্রান্সজেন্ডাররা অবহেলিত এবং এরা আমাদের কাছে হিজড়া নামে পরিচিত???? আসলে কি তারা একই?অনলাইনে প্রায় সবাইকেই দেখি এই দুটোকে এক করে কথা বলতে। এমন এমন মানুষকে ভুল করতে দেখি যে মনেহয় আমিই ভুল।

আমিই কি ভুল জানি তাহলে!!!! না, ভুল নয় কারন হিজড়া এবং ট্রান্সজেন্ডার আলাদা। চলুন আলোচনায় দেখাযাক-

হিজড়া: হিজড়া হচ্ছে ইন্টারসেক্স বা হার্মাফ্রোডাইট। অর্থাৎ জন্মের সময় সেক্স ক্রোমোজম কোন কারনে ভুল বিন্যাসে বিন্যস্ত হয়ে লিঙ্গ নির্ধারণে সমস্যা ঘটায়। অর্থাৎ সমস্যাটা শারীরিক, তাও আবার ক্রোমোজমাল।

ট্রান্সজেন্ডার: এরা নির্দিষ্ট লিঙ্গ নিয়েই জন্মায় কিন্তু সেই লিঙ্গকে মেনে নিতে পারেনা। নারী হয়ে জন্মালে মনমানসিকতা ও চাওয়া-চাহিদায় নিজেকে পুরুষ ভাবে আর পুরুষ হয়ে জন্মালেও নিজেকে নারী ভাবে। অর্থাৎ সমস্যাটা মানসিক। তখন শরীর ও মন এক পাল্লায় আনতে তারা হরমোনাল থেরাপি ও অপারেশনের মধ্য দিয়ে যায় এবং কাঙ্ক্ষিত লিঙ্গ ধারণ করে।

আমার মনে হয় এবং যতদুর ঘেটেঘুটে পাওয়া গেল তাতে হিজড়া আল্লাহ প্রদত্ত শারিরীক অসঙ্গতি সম্পন্ন মানুষ। রাস্তায় আমরা হিজড়াদের দেখি কারও মুখে দাড়ি গজায়, কন্ঠ পুরুষের এদিকে মেয়েদের মত ব্রেষ্টও হয়। আবার অনেকের দাড়ি গোঁফ থাকে কিন্তু মেয়েলি গলা ও হাটেও মেয়েদের মত। কিন্তু পুরুষাঙ্গ গ্রোয়ার নয়। বিবাহিত জীবন কাটানোর মত এবিলিটি তাদের থাকে না। আমাদের এলাকায় একজন স্বনামধন্য সরকারী প্রফেসর আছেন যিনি এ কারনেই অবিবাহিত ।আবার একটি মেয়ে আছে যে এখন জাহাঙ্গীরনগরে পড়ছে এবং হিজড়া থেকে এখন রুপান্তরিত ছেলে।

আর ট্রান্সজেন্ডার হল রুপান্তরিত নারী কিংবা পুরুষ। যারা জন্ম নেয় শারিরীকভাবে একজন পরিপূর্ন নারী বা পুরুষ হিসেবে। পরবর্তীতে তাদের সেক্সুয়াল সমস্যাসহ নানাবিধ মানুষিক সমস্যা দেখা যায়। গঠনগত একজন নারী; পুরুষ মেন্টালিটি গ্রো করে আর পুরুষ; নারী মেন্টালিটি গ্রো করে। ভালোলাগার ব্যাপারটিও ঠিক উল্টে যায়। অনেকসময় এদের ‘গে’ বা ‘লেসবিয়ান’ বলা হয়। যেহেতু তারা সমাজে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেনা তখন তারা তাদের সেক্স চেন্জ করতে ডাক্তারের সরনাপন্ন হয়। একসময় সম্ভব না হলেও বর্তমান উন্নত চিকিৎসার বদৌলতে হরমোনাল ইনজেকশান, ও অপারেশানের মাধ্যমে নারী পুরুষে কিংবা পুরুষ নারীতে রুপান্তরিত হয়! পরবর্তীতে তারা জীবনসঙ্গী সেভাবেই বেছে নিচ্ছে।

এখন শিশিরের লাইফ হিস্ট্রি বলে, ছোটবেলায় বাবা- মা তাকে ছেলে হিসেবে লালন- পালন শুরু করে। একসময় এসে তাদের কাছে বোধগম্য হয় ,সে ছেলে নয়।একটা বয়সের পর ছেলেদের দাড়ি- গোঁফ আসে এবং অন্যান্য পরিবর্তন এর সাথে পুরষাঙ্গেরও গ্রোথ হয়। শিশিরের তা হয় না। লোকচক্ষু ও কটাক্ষের ভয়ে তাকে রেখে আসে হিজড়াদের ডেরায়। সেখান থেকে বেডিয়ে আসা সহজ কথা না হলেও, শিশির নিজের বুদ্ধিমত্তায় নিজের চিকিৎসার ব্যবস্হা করে। তার সাফল্যের কথা আমরা সবাই জানি। সুতরাং শিশির ‘হিজড়া ট্রান্সজেন্ডার নারী’।

আমাদের দেশ তরতরিয়ে এগিয়ে গেলেও এখনো কিছু সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। হিজড়াদের সুবিধা না থাকায় তারা ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমে পড়ে। অনেকসময় তাদের ছত্রছায়ায় অনেক সুযোগসন্ধানীরা অন্যায় করে থাকে। এসব বন্ধের জন্য যদি সময়মত সুচিকিৎসার মাধ্যমে হিজড়াদের ট্রানজিট করে সকল সুযোগ সুবিধা দেয়া যায় তাহলে সমাজের বিরাট বড় একটি সমস্যার সমাধান হবে।

তার ভাবনা, ‘‘ভবিষ্যতেও তো হিজড়াদের জন্ম হবে৷ তারা কীভাবে বড় হবে? আমি চাই সরকার, সমাজ এমন কিছু একটা করুক যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পরিবারের সঙ্গে সুস্থ স্বাভাবিকভাবে পড়াশোনা করে বড় হতে পারে৷ আমাদের কমিউনিটিতে যেন তাদের আসতে না হয়৷’’

তাই আমাদেরও শিশিরকে নেগেটিভলি নেয়ার কিছু নেই। কারন পরিবর্তন ছাড়া তার পক্ষে সমাজে চলা কষ্টকর ছিল। সে সৃষ্টির সামান্য ভুলকে শুধরে এখন একজন পরিপূর্ন নারী। সে হিসেবেই তার জীবন চলুক। আমরাও তার এই সাফল্যই কামনা করি।

ছবি- নেট থেকে।

0 Shares

২৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ