২৯ জুলাই, ১৯৮১ সাল, সমগ্র গ্রেট ব্রিটেন জুড়ে রাস্তায় নেমে উল্লাসে ফেটে পড়েছিল ব্রিটিশ জনগণ। বাকিংহাম প্যালেসের সামনে তখন তীব্র হর্ষধ্বনি, প্রতিটি বাড়ির কোণায় ঝুলছিল ব্রিটিশ পতাকা। ইংল্যান্ডের সিংহাসনের এক উত্তরাধিকারী প্রিন্স চার্লসের বিয়ের দিন ছিল সেটা। যাকে নিয়ে এতো আয়োজন সেই কনে তখন ব্যস্ত নিজেকে সাজাতে, হাজার হোক পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী রাজবংশের পুত্রবধূ হতে যাচ্ছেন! মাথার সোনালী চুলকে সুবিন্যস্ত করে সাজিয়ে দেওয়া হলো, মুখের উপর পড়লো সুনিপুণ মেকাপের আচড়। লম্বা আইভরি গাউনে সুসজ্জিত হয়ে যখন বাবা আর্ল স্পেন্সারের সাথে বিশেষভাবে সাজানো গ্লাসকোচ নামের গাড়িতে এসে বসলেন, তখন তাকে অবিকল রূপকথার সিনডেরেলার মতোই লাগছিল। টেলিভিশনের পর্দায় অপলক তাকিয়ে ছিল পুরো বিশ্ববাসী। তার নাম ডায়ানা ফ্রান্সিস স্পেন্সার!

তিনি জন্মসূত্রে রাজকুমারী বা সরাসরি রাজবংশীয় ছিলেন না। তবে তার বাবা এবং মায়ের বংশ পাঁচশ বছর ধরে রাজকার্যে নিয়োজিত ছিলেন, তারা ব্রিটিশ রাজা ও রাণীদের অনুগত বন্ধু ছিলেন। বাবা এডোয়ার্ড জন স্পেন্সার (ভিসকাউন্ট আলথ্রোপ) রাজা ষষ্ঠ জর্জ ও রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজসভায় কাজ করতেন। মা ফ্রান্সিস রোশের পরিবার ও রাজা-রাণীদের ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন! এই সম্পর্ক এতোটাই গভীর ছিল যে ডায়ানার বাবা মার বিয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান ওয়েস্টমিনিস্টার এবের মতো অভিজাত ও রাজকীয় স্থানে করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এই দম্পতির প্রথম দুই সন্তান মেয়ে হলে তখনকার দিনের অভিজাত পরিবার গুলোর মতোই তারা প্রচন্ডভাবে পুত্রসন্তান কামনা করতে শুরু করেছিলেন। তৃতীয় সন্তান ছেলে হলেও ভাগ্য সহায় ছিলনা, মাত্র দশ ঘন্টা পর মারা গিয়েছিল নবজাতকটি! তাদের মানসিক চাপ আরো বেড়ে গিয়েছিল; কারণ তখনকার সময়ে অভিজাত সমাজে বিশ্বাস ছিল একমাত্র পুত্রসন্তানই পরিবার ও বংশের গৌরব রক্ষা করতে পারে। মাত্র আঠারো মাস পরে চতুর্থ সন্তান জন্মদানের সময় পুত্রসন্তান লাভের আকাঙ্ক্ষা এতোটা তীব্র ছিল যে তারা সেইসময়ের প্রথা অনুসারে নাম বাছাইয়ের সময় মেয়ে নাম তালিকায় রাখেননি। ১ জুলাই, ১৯৬১ সালে যে মেয়ে জন্মালো, জন্মের এক সপ্তাহ পর তার নাম রাখা হলো ডায়ানা ফ্রান্সিস!

এর তিন বছর পর ওই দম্পতির পুত্র সন্তান জন্মালেও ডায়ানার মনে এর একটা স্থায়ী প্রভাব পড়েছিল। তিনি ওই বয়সেই নিজেকে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবতে শুরু করেছিলেন। বুঝতে পারতেন তার আগমনে তার মা বাবার হতাশার কথা, অনুশোচনা কাজ করতো হয়তো! যদিও এই পরিস্থিতির উপর তার কোন নিয়ন্ত্রণ ছিলোনা। রাজবাড়ির উন্মুক্ত খেলার পরিবেশ, মন ভুলানো প্রকৃতির উচ্ছ্বাস সত্ত্বেও তার শৈশব খুব সুখের ছিলনা। এর একটা বড় কারণ ওইসময় সন্তানেরা মা বাবাকে কাছে পেতোনা। নিয়ম ছিল আয়া, গৃহশিক্ষকেরা সন্তানের সব দেখভাল করবেন! এই অসুখী আবহাওয়া রীতিমতো দুর্যোগে পরিণত হলো যখন ১৯৬৯ সালে বাবা মার ডিভোর্স হলো। ওইসময়ে রাজ পরিবারে ডিভোর্স ছিল চরম স্ক্যান্ডালের মতো ঘটনা! গভীর রাতে অন্য ঘর থেকে ছোট ভাইকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলতে শুনতেন- ‘আমার মাকে এনে দাও!’

মাত্র ছয় বছর বয়সে বাবা মার বিচ্ছেদ তার জন্য অনেক বড় মানসিক আঘাত ছিল। সবাই তাকে ছেড়ে যাবে বা প্রত্যাখ্যাত হবেন এই দুঃশ্চিন্তা আজন্ম গ্রাস করেছিল মূলত সেই আঘাত থেকেই। নিজের এই না পাওয়া থেকেই পরবর্তী জীবনে রিলেশনশিপে প্রচন্ড নির্ভরশীল হয়েছিলেন। সম্ভবত এই পারিবারিক ভাংগন তার মধ্যে নিজের প্রতি সম্মান বা শ্রদ্ধাবোধ তৈরিতে বাধার কারণ হয়েছিল, পরবর্তী জীবনে যা প্রচন্ড মুড সুইং বা মুডের অকস্মাৎ ভালো খারাপ হওয়াতে রূপ নেয়! এই সব সমস্যা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে তার কিছু নিজস্ব ডিফেন্স মেকানিজম ছিল, যা মনের আত্মরক্ষার কৌশল, যেমন- নিজেকে সবসময় খুব ব্যস্ত রাখতেন, অনবরত কথা বলতেন, অনেক সময় নিজেকে কিঞ্চিৎ অসত্য উপায়ে উপস্থাপন করতেন!

স্কুলে তার চরিত্রে দয়াশীলতা দৃষ্টি কেড়েছিল সবার, ছোটদের সাহায্য করতেন, শিক্ষকদের কাজে সহযোগিতা করতেন। এটা শুধু মানুষেই সীমাবদ্ধ ছিলনা, প্রাণী পালতে পছন্দ করতেন খুব, গিনিপিগ পুষতেন। পোষা প্রাণীদের যত্ন করার জন্য পুরস্কার ও পেয়েছিলেন। তবে পড়াশোনার ক্ষেত্রে অংক ও বিজ্ঞান শিখতে খুব সমস্যা হচ্ছিল, যদিও শিল্প ও সাহিত্যের ক্লাস খুব উপভোগ করতেন। ছোটভাই চার্লস তার গ্রেডিং কম পাওয়া নিয়ে একটা টিভি শোতে তাকে শামুকের সাথে তুলনা করলে প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছিলেন মনে! দীর্ঘদেহী ও কর্মচঞ্চল হওয়ায় এথেলেট হিসেবে সুনাম হয়েছিল। টেনিস, নেটবল, হকি, সাঁতার সহ অনেক খেলাতেই পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। তেরো বছর বয়সে দাদু মারা গেলে তার বাবা নর্থহাম্পটনশায়ারের ইস্টেটের উত্তরাধিকারী হলে সপরিবারে সেখানে চলে আসেন। এসময় স্কুল ও পালটাতে হলো। এই স্কুলে তার বড় বোন আগে থেকেই পড়তো, সে পড়াশুনায় তুখোড় ছিল। সবসময় পড়াশুনা নিয়ে তুলনা ডায়ানাকে মানসিক ভাবে অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছিল, নিজেকে অপর্যাপ্ত ভাবতেন! তবে তিনি নিজের ভালো লাগার জায়গা দ্রুতই খুঁজে পেয়েছিলেন! স্কুলে নিয়ম ছিল সবাইকেই কোন না কোন স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করতে হবে সমাজে। ডায়ানা তার বান্ধবীদের নিয়ে এক অতি বৃদ্ধা মহিলার বাসা পরিষ্কার করে দিতেন, বাজার করে দিতেন, সংগ দিতেন। এই সময়ে নিয়মিত প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য আয়োজিত পার্টিগুলোতে যাওয়া শুরু করেন। তিনি যেন নিজেকে আবিষ্কার করলেন। বুঝতে পারলেন এই মানুষগুলোর সাথে মিশে যাওয়ার চারিত্রিক গুণ তার আছে, তাতেই তার প্রকৃত শান্তি! প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উপর যে বুদ্ধিমত্তা নির্ভরশীল নয় এর জ্বলন্ত প্রমাণ তিনি। ডায়ানার ছিলো ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স- অন্যের অনুভূতিকে উপলব্ধি করার সহজাত বুদ্ধি, যা তার সেলফ মারকেটিং এ চরম সফলতা এনে দিয়েছিল, সবচেয়ে প্রশংসিত মানুষে পরিণত করেছিল! অসাধারণ প্রজ্ঞা ছিল। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বুঝে নিতেন কখন তার দিকে ক্যামেরা তাক হচ্ছে। ফটোগ্রাফের যাদুও তার ব্যক্তিত্বে এতো ক্ষমতার যোগান দিত! ক্যামেরার দিকে লাজুক ভঙ্গীতে মাথা নীচু করে তাকানো ছিল নিখুঁত ভাবে স্বেচ্ছায় মঞ্চস্থ করা ভঙ্গী, যা তাকে এতোটা জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল! ডায়ানা নিজের সীমাবদ্ধতা জানতেন, হীনমন্যতায় না ভুগে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছেছিলেন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় সীমাবদ্ধতা তাকে মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল করেছিল, এই দূর্বলতা থেকে হেল্পার সিন্ড্রোম হয়েছিল। অন্যদের সাহায্য করাটা নেশায় পরিণত হয়েছিল, এর মধ্যেই মানসিক ও আবেগীয় শান্তি পেতেন! ফলশ্রুতিতে তিনি শেষ পর্যন্ত জনগণের হৃদয়ের রাণী হতে পেরেছিলেন!

১৯৭৭ সালে তার বাবা পুনর্বিবাহ করলে ভাই বোনেরা মিলে এর তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। সৎ মাকে কথায় কথায় টিটকারি থেকে শুরু করে বাজে ব্যবহার করতেন সবাই মিলে। এই ঘটনা তার কিশোরী কালকে আরেকটা মানসিক আঘাতের মধ্যে ফেলেছিল। এই বছরই প্রথমবারের মতো প্রিন্স চার্লসের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়, যদিও তা রোমান্টিক বা জাকজমকপূর্ণ কোন ঘটনা ছিলনা। ডায়ানার বয়স তখন মাত্র ষোল আর চার্লসের উনত্রিশ! চার্লসের ভাষ্যমতে ডায়ানা ছিলেন হাসিখুশি, আকর্ষর্ণীয়া কিশোরী যে খুব মজা করতো! অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষায় পরপর দুবার অকৃতকার্য হয়ে তার ইতি টানতে হলো শেষ পর্যন্ত! ডায়ানা নিজের মতো থাকতে চাচ্ছিলেন কিন্তু পরিবারের অনুমতি মিলছিল না। অবশেষে ১৯৭৯ সালে আঠারো বছরে পা দিলে তার জন্য আলাদা এপার্ট্মেন্ট কেনা হলো। তিনি তিন বান্ধবীর সাথে থাকা শুরু করলেন। এটা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়। প্রথমবারের মতো রাজ পরিবারের বিধি নিষেধের বাইরে এসে মুক্তির স্বাদ পেয়েছিলেন! ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ হয়েছিল। পরিবার থেকে ভরণ পোষণের খরচ আসলেও নিজে কিছু একটা করার কথা ভাবলেন। একটা কিন্ডারগার্টেনে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন। এইসময় একটা জিনিস স্পষ্ট হলো যে বাচ্চাদের সাথে মানসিক যোগাযোগ তৈরি করার অদ্ভুত ক্ষমতা তার আছে। বাচ্চারা ঘিরে ধরে রাখতো তাকে, প্রচন্ড ভালোবাসত তাদের এই শিক্ষককে। এমনকি তাদের মা বাবারাও এই শিক্ষয়ত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিল!

১৯৮০ সালের জুলাই মাসে এক বন্ধুর বাড়িতে বারিবিকিউ পার্টিতে দেখা হয় পিন্স চার্লসের সাথে। কিছুদিন আগেই প্রিন্স চার্লসের প্রিয় গুরু মাউন্টব্যাটেন নিহত হয়েছিলেন। এটা নিয়ে তিনি খুব মর্মাহত থাকতেন, তাই কেউ তার সামনে এই বিষয় নিয়ে কথা বলতোনা। কিন্তু ডায়ানা ছিলেন ব্যাতিক্রম। তিনি জানতে চাইলেন প্রিন্স কিভাবে এই কষ্টের সাথে মানিয়ে নিচ্ছেন। চার্লস এই স্পষ্টবাদী ও সহমর্মিতায় ভরা দৃষ্টিভঙ্গীতে অভিভূত হলেন। তাদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ বাড়তে থাকলো। প্রেসের নজর এড়াতে পারলো না এইসব ঘটনা! এরপর ডায়ানার জীবন বদলে গেলো অনেকটাই। সাংবাদিকরা তার বাসার সামনে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকা শুরু করলো, অনেকে তার বাসার আশেপাশে এপার্টমেন্ট ভাড়া নিলো যাতে তার রুমের ভিতর পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায়! এতো কিছু সত্ত্বেও তিনি ভদ্র ও বিনয়ী থাকতেন সবসময়। এই গুজবে রাজ পরিবারের ও টনক নড়ল। তারা ভেবে দেখল ডায়ানা সরাসরি রাজপরিবারের সাথে সম্পর্কিত ব্রিটিশ মেয়ে যার ব্যক্তিজীবন নিয়ে কোন কানাঘুষা নেই। সে কনে হওয়ার জন্য উপযুক্ত। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৮১ সালে রাণির অফিস উইন্ডসর ক্যাসেলে প্রিন্স চার্লস ডায়ানাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এরপর ডায়ানাকে নিজের এপার্ট্মেন্ট ছেড়ে উঠতে হলো বাকিংহাম প্যালেসে। রাজকীয় কায়দা কানুন শিখতে হলো- কিভাবে হ্যান্ডশেক করতে হয়, কথা বলতে হয়, জনতার দিকে হাত নাড়াতে হয়! আজন্ম মুক্তিকামী ডায়ানার জন্য তা হয়তো মোটেও স্বস্তিকর ছিলোনা।

বিয়ের কয়েকদিন আগের এক ফটোগ্রাফে দেখা যায় চার্লসের পোলো খেলা দেখতে গিয়ে কান্নায় ভেংগে পড়েছেন ডায়ানা। এর পিছনে গল্প ছিল। অনেকদিন আগে থেকেই প্রিন্স চার্লসের সম্পর্ক ছিল ক্যামিলা পার্কারের সাথে। সেদিন খেলা শেষে তার জন্য গিফট নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল চার্লসের। ডায়না হয়তো বিয়ে নিয়ে সংশয়ী ছিলেন। কিন্তু ততোদিনে রাজকীয় বিয়ের প্রস্তুতি এতোদূর এগিয়েছে যে সেটা আটকানোর হয়তো আর কোন উপায় ছিলোনা! বিয়ের পর হানিমুন ও ডায়ানার জন্য খুব বেশি রোমান্টিক ছিলোনা। চার্লস তার সাথে কথা বলার চেয়ে মাছ শিকার নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকলেন। সবচেয়ে উদ্ভট ছিল তিনি দর্শনের বই সাথে নিয়েছিলেন, চেয়েছিলেন ডায়ানা সেটা পড়ে তার সাথে আলোচনা করুক। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি বীতশ্রদ্ধ ডায়ানার কাছে এটা ছিল চরম হতাশার হানিমুন। এর পরের সময় গুলোতেও চার্লসের আচরণ একই রইল। ডায়ানা ধীরে ধীরে নিঃসঙ্গ ও বিরক্ত হয়ে উঠছিলেন। তিনি লন্ডনে ফিরতে চাইলে জানানো হলো রাজপরিবারের নিয়মের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। তাকে অভ্যস্ত হতে হবে! ডায়ানা ভেবেছিলেন বিয়ের পর প্রেসের হাত থেকে রেহাই পাবেন, কিন্তু তা হলোনা। ডায়ানা আরো বেশি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হলেন। তার জনপ্রিয়তায় স্বয়ং প্রিন্স চার্লস বিস্মিত হতেন। রাস্তার দুইপাশে দাঁড়ানো জনতার উদ্দেশ্যে অভিবাদন জানিয়ে হাঁটার সময় যে পাশে চার্লস থাকতেন সেই পাশে স্পষ্টত হতাশার ছাপ দেখা দিত। একবার হতাশ হয়ে চার্লস বলেই ফেলেছিলেন- ওরা তো আমাকে দেখতে চায়না!

১৯৮২ সালে প্রথম সন্তান উইলিয়াম ফিলিপের জন্ম হয়। সন্তান জন্মের পর বেশকিছু মাস খুব ভালো কেটেছিল এই যুগলের। দুজনেই বাবা মাকে ছোটবেলায় বেশি কাছে না পাওয়ায় সিদ্ধান্ত নিলেন তাদের সন্তানের ক্ষেত্রে এরকম হতে দিবেন না। দুজনেই তার আদরযত্ন শুরু করলেন। এর মধ্যেই ডায়ানার পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেসনের লক্ষণ দেখআ দিচ্ছিল- হতাশা, ভয়াবহ মুড সুইং, ক্লান্তি! তার মনে হলো রাজপরিবারের সবাই তাকে কোণঠাসা করে ফেলছে! সন্তানের বিষয়ে তার মতামতের কোন মূল্যই নেই। এর আগে রাজকীয় ভ্রমণে বাচ্চাদের রেখে যাওয়ার নিয়ম ছিল। ডায়ানাই প্রথম উইলিয়ামকে নিয়ে রাজকীয় সফরে বের হলেন। মা হিসেবে তার দৃড় ব্যাক্তিত্বের জয় ছিল এটা, যে কারণে রাণি এলিজাবেথকে অনুমতি দিতে হয়েছিল। সন্তানের মায়া বা ডায়ানার জনপ্রিয়তা কোনকিছুই যদিও চার্লসের সাথে দূরত্ব কমাতে পারলো না! চার্লস জানতেন তার সাথে ডায়ানার কোন মিল নেই বরং অনেক বেশি মিল পুরানো বন্ধু ক্যামিলা পার্কারের সাথে। শিকারে যাওয়ার ছুতোয় ক্যামিলার সাথে দেখা করা শুরু করলেন নিয়মিত। ডায়ানা ভ্রমণ ভালোবাসতেন না তাই তাকে একরকম জোর করে দূরে রাখা হতো এসব থেকে। তবু প্রেস ও মিডিয়া টের পেয়ে গেলো! রূপকথার সময় ফুরিয়ে আসার আভাস দিলো তারা!

ডায়ানা ও দেহরক্ষী ব্যারী

স্বামীর কাছে কাঙ্ক্ষিত ভালোবাসা না পেয়ে ডায়ানাও হয়তো জড়িয়ে পড়েছিলেন বিবাহ বহির্ভূত রোমান্টিক সম্পর্কে। ব্যারী ম্যান্নাকি ছিলেন রাজপরিবারের নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার। কথিত আছে তার সাথেই গভীর প্রণয় ছিল ডায়ানার! মৃত্যুর পর প্রকাশিত একটি ভয়েস টেপে এক অনামী দেহরক্ষীর সাথে গভীর সম্পর্কের বিষয়ে ডায়ানার অকপট স্বীকারোক্তি পাওয়া গিয়েছিল! যদিও তিনি কখনোই ব্যারী ম্যান্নাকির নাম উল্লেখ করেননি কোথাও! সার্জেন্ট ব্যারী প্রিন্সেসকে আগলে রাখতেন পরম মমতায়। সম্ভবত এটা কখনো শারীরিক সম্পর্কে গড়ায়নি বরং ছিল প্লাটোনিক সম্পর্ক! ১৯৮৭ সালে এক মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় ব্যারী মারা যাওয়ার পর আজীবন ডায়ানার মনে এই সন্দেহ ছিল যে হয়তো তাকে মেরে ফেলা হয়েছিল! যদিও এর স্বপক্ষে বিশেষ কোন প্রমাণ ছিলোনা!

এরমধ্যেই ১৯৮৪ সালে দ্বিতীয়বারের মতো গর্ভবতী হলেন ডায়ানা। চার্লস চেয়েছিলেন মেয়ে হোক। কিন্তু এবারো ছেলে সন্তান দেখে কিছুটা হতাশ হয়ে বাচ্চার লাল চুল নিয়ে তির্যক মন্তব্য করলে ডায়ানার মনে প্রচন্ড প্রতিক্রিয়া হয়। কারণ লাল চুল মূলত ডায়ানার বংশের লোকদের ছিল। চার্লসের জন্য যেটুকু ভালোবাসা অবশিষ্ট ছিল তাও যেন উবে যায়!

হ্যারীর জন্মের কিছুদিন পর পুনরায় যখন জনসম্মুখে ফিরলেন তখন তার আউটলুক পালটে ফেলেছেন। আগের দিনের পোশাক ছেড়ে আধুনিক পোশাক পড়তেন, চুলের কাট চেঞ্জ করতেন বারবার, মুখে মেকাপের ছোঁয়া থাকতো মসৃণ। তাকে আগের চেয়েও বেশি সুন্দর দেখাতো! হালকা পাতলা লম্বা গড়নে তার সৌন্দর্য এতোটাই কিংবদন্তী হয়েছিল যে ওই সময়ের বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীরা বলেছিল তারা সবাই ডায়ানার মতো হতে চাই। এতো কিছুর পরেও সত্য সামনে আসতে শুরু করেছিল। সংবাদ মাধ্যম গুলো ডায়ানা ও চার্লসের একসাথে পাবলিক প্রোগ্রামে না আসা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করলো। এটা যেমন ঠিক তাদের আলাদা আলাদা শিডিউল থাকতো তেমনি দুই জনের বয়সের ব্যবধান তাদের পছন্দকেও আলাদা করে ফেলেছিল। এই পরিস্থিতিতে রানী এলিজাবেথ রাজ পরিবারকে স্ক্যান্ডালের হাত থেকে বাঁচাতে তাদের একসাথে বেশি সময় কাটাতে বললেন। তারা  রাজীও হলেন! তবু তাদের আলাদা ব্যক্তিজীবন নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকলেন। চার্লস ক্যামিলার সাথে আর ডায়ানা তার বন্ধু জেমস হেউইট এর সাথে। পত্রিকাগুলো গুজবের জোগান দিতে থাকলো।

প্রিন্সেস ছোটবেলা থেকেই অসহায়, দুঃস্থ, এতিমদের সাথে মিশতে ভালোবাসতেন। এখন সেইসব কাজে সময় দিতে শুরু করলেন। আশির দশকে এইডস নিয়ে খোদ ইউরোপেও প্রবল কুসংস্কার ছিল। ইংল্যান্ডে প্রথম এইডস হাসপাতালের উদ্বোধন করেছিলেন এবং রাজ পরিবারের প্রথম সদস্য হিসেবে এইডস রোগীর সাথে খোলা হাতে করমর্দন করেছিলেন তিনিই। এই ছবি বিশ্ব জুড়ে প্রচারিত হলে এইডস সম্পর্কে কুসংস্কারের অনেক কমেছিল! এতিমখানায় গিয়ে সেখানের শিশুদের সাথে পরম মমতা নিয়ে গল্প করতেন ঘন্টার পর ঘন্টা! বস্তুত মানুষকে ভালোবাসার সহজাত গুণ ছিল তার। অন্যদিকে চার্লসের সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েন আড়ালে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন, যদিও অধিকাংশ সময় দুইজন আলাদা থাকতেন, সপ্তাহান্তে দেখা হলেও প্রচন্ড ঝগড়া ঝাটি হতো। কান্নায় ভেংগে পড়তেন ডায়ানা, মাকে চোখের জল মোছার জন্য টিস্যুপেপার এগিয়ে দিতেন উইলিয়াম! এতোকিছুর পরেও জনসম্মুখে, প্যারেডে সুখী পরিবারের অভিনয় করে ছবির জন্য পোজ দিতেন চার্লস ও ডায়ানা! ডায়ানার মানুষের মাঝে কাজ করার এই স্পৃহা তাক আরো বেশি জনপ্রিয় করে তুললো। মিডিয়ার কাছে তিনি হয়ে উঠলেন সাধারণের কাছে পৌছাতে পারা মানুষ। অন্যদিকে মিডিয়ার কাছে প্রিন্স চার্লস ক্রমশ জনগণের থেকে দূরে থাকা মানুষ হিসেবে পরিগণিত হলেন। মিডিয়ায় প্রিন্স চার্লসের উল্লেখ কমে আসল। ১৯৯১ সালে উইলিয়াম মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হলে অপারেশনের দরকার পড়ল। অপারেশনের সময় মমতাময়ী মা ডায়ানা উপস্থিত থাকলেও প্রিন্স চার্লসকে রাজকীয় প্রটোকল মেনে একটি অপেরায় উপস্থিত হতে হলো। ব্রিটিশ পত্রিকা সান ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে লিখল-’কেমন বাবা তুমি?’ চার্লস বুঝতে পড়লেন তার ইমেজ সংকটে পড়তে যাচ্ছে। তার উপদেষ্টা ও বন্ধুরা প্রচার শুরু করলো যে ডায়ানা আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা, মুড সুইং আছে, সর্বোপরি এটেনশন বা মনোযোগ পেতে চান অতিরিক্ত! এই ঘটনা ডায়ানাকে প্রচন্ড ক্ষেপিয়ে তুললো, বুঝতে পারলেন তাকে যুদ্ধ করতেই হবে এবার। সে সময়ে প্রকাশিত তার এক জীবনী ‘হার ট্রু স্টোরি’ তে পরোক্ষভাবে নিজেকে নিঃসঙ্গ নারী হিসেবে উপস্থাপন করালেন যে আবেগহীন এক পুরুষের সাথে অসুখী বিয়ের জালে আটকে পড়েছে! তার বুলিমিয়ার সমস্যার জন্য রাজপরিবারের দেয়া মানসিক চাপকে দায়ী করলেন। এই যে বারবার খাওয়া আর বমি করে বের করে দেয়ার প্রবণতা বা বুলিমিয়াকে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন- বারবার খাওয়া অনেকটা তার মানসিক চাপ কমাতো, সেই সব সমস্যায় যার সমাধান অসাধ্য ছিলো! তিনি বলার পর অসংখ্য মানুষ এইরকম মানসিক সমস্যা নিয়ে সামনা সামনি কথা বলতে শুরু করেছিল। ওই বছরই বুলিমিয়ার জন্য চিকিৎসা নিতে আসা মেয়েদের সংখ্যা দ্বিগুণে পৌঁছেছিল! সংবাদমাধ্যম এই ঘটনার নাম দিয়েছিল ‘ডায়ানা এফেক্ট’! তীব্র প্রতিক্রিয়ায় রানী এলিজাবেথ বললেন, ডায়ানা সীমালঙ্ঘন করে ফেলেছে! অবশেষে ৯ ডিসেম্বর, ১৯৯২ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হাইজ অফ কমন্সে তাদের বিচ্ছেদের কথা আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা দিলেন, যদিও রাজতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী ডিভোর্স অনুমোদিত নয় এবং চার্লস রাজা হলে ডায়ানাই রাণী হতেন!

ডায়ানা বাইরের চেহারায় যতোখানি শান্ত ভঙ্গিমা ফুটিয়ে রাখুক না কেন মনের ভিতরের জগত ছিল বিশৃংখলাপূর্ণ, ব্যাথাতুরা! অনেকের মতে তার মধ্যে বর্ডারলাইন পারসোনালিটির কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য হয়তো ছিল! হতাশা, আবেগীয় অস্থিতিশীলতা, শূন্যতাবোধ, হারানোর ভয় ও অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা, আবেগের বশে রাগ-ক্ষোভে ফেটে পড়া, তীব্র আবেগের বশে নিজের এবং পরিবারের ক্ষতি করার প্রবণতা ও দুর্দশায় পড়া, বারবার বেপরোয়া প্রেমের সম্পর্কে জড়ানো ইত্যাদি হয়তো তারই উদাহরণ ছিল। ফ্রয়েডের সাইকোএনালাইটিক থিওরিতে চিন্তা করলে ধারণা করা যায় এই বর্ডারলাইন পারসোনালিটির বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব হয়েছিল অসুখী শৈশব থেকে! অচেতন মনে থাকা শৈশবের যন্ত্রণার চিন্তার ভূমিকা ছিল। তার হয়তো ফিয়ার ডাইলেমা (Fear dilemma) ছিল; অন্যের সাথে গভীর সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়তা বোধ ও ভয় একইসাথে কাজ করতো! পুরোটা জীবনই ছিল একটা মনস্তাত্বিক নাটকের মঞ্চ যেখানে অগণিত বার মিলন ও বিচ্ছেদের অভিনয় হয়েছিল! তার কখনো শান্তি ছিলোনা কারণ চমৎকার কল্পনা আর ধূসর বাস্তবতার মাঝামাঝি বর্ডারলাইন হয়েই পার হয়েছিল জীবন।

ডায়ানা রাজপরিবারের বিধি নিষেধ থেকে মুক্তি পেলেও সন্তানদের কাছ থেকে বেশ দূরে চলে যেতে বাধ্য হলেন। সবসময়ই চাইতেন তার সন্তানেরা রাজপরিবারের আবদ্ধ গন্ডির বাইরের বিরাট জগতের সাথে পরিচিত হোক। উইল করেছিলেন যাতে তিনি মারা গেলে তার সন্তানদের দেখভালের দায়িত্ব রাজপরিবারের বাইরের কেউ পায়! যদিও এটা কখনো কার্যকর হয়নি। মানবতার কাজে নিজেকে আরো বেশি বিলিয়ে দিয়েছিলেন, রেডক্রসের শুভেচ্ছাদূত হয়েছিলেন, মাদার তেরেসার সাথে পরিচিত হয়েছিলেন। পর্দার আড়ালে আরো অনেক বেশি কাজ করতেন, অসুস্থ শিশুদের বাবা মার সাথে কথা বলতেন, তাদের বন্ধু হতেন! অভিজাত বংশের মেয়ে হয়েও চেয়েছিলেন পৃথিবীর জন্য ভালো কিছু করতে। কিন্তু নভেম্বর, ১৯৯৩ এ জিমে ব্যায়াম করার কিছু ছবি গোপনে তুলে পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তার আত্মবিশ্বাস ভেংগে যায়। তিনি নিজেকে নাটকীয়ভাবে সব রাজকীয় কাজ এবং দাতব্য কাজ থেকে গুটিয়ে নিলেন। তিনি তখন আলাদা কিন্তু আইন অনুযায়ী ডিভোর্স পাননি, রাজপরিবারের লোক হলেও সেখানে কাঙ্ক্ষিত নন, বাইরের পৃথিবীও তার জন্য নয়! বিশেষ করে প্রেস ও ফটোগ্রাফারদের নতুন অত্যাচার ততোদিনে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল! নিজের নতুন কোন ভূমিকা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তখন তিনি রাজকীয় প্রহরা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ততোদিনে নতুন প্রজন্মের বেপরোয়া ফটোগ্রাফার যাদের পাপারাজ্জি বলা হয়, প্রচন্ড বেপরোয়া হয়ে পড়েছিল। কারণ ডায়ানার ছবি তুলতে পারলে তা হাজার ডলারে কিনত পত্রিকা। তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য টম আর জেরীর মতো অবস্থা হচ্ছিল তার!

যখন কেনসিংটন প্রাসাদে একা থাকতেন অতীত ও বর্তমানে তার সাথে ঘটা বেইমানির কথা ভাবতেন, শত্রুদের নিয়ে চিন্তায় মগ্ন হতেন, কখনো কেঁদে ভাসাতেন আবার কখনো মনে প্রতিশোধপরায়ণ কগনিটিভ স্কিমা বা চিন্তার ধরন কাজ করতো! এইরকম মুহুর্তে হয়তো ভুল সিদ্ধান্ত ও নিতেন। তার বন্ধু ডেভিড পুটম্যানের ভাষ্যমতে, যদি মনের সবগুলো কাজ গোছানো ভাবে না হয় আবার সেই মনের বুদ্ধিমত্তা খুব সুতীক্ষ হয়, সেটা কিছুটা উদ্ভট মন! ব্যক্তিত্বে অসাধারণ পরিপক্কতা ও অপরিপক্কতার অদ্ভুত মিশ্রণ। তিনি সৎ মানুষ ছিলেন। তবে এটাও সত্য সোজাসুজি সত্য বলতেন না সবসময়, রং লাগিয়ে বাড়িয়ে বলার অভ্যাস ছিল! হয়তো এই আচরণের পিছনের প্রেরণা ছিল নিজেকে আড়ালে রাখা, প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা পাওয়া! বিশেষ করে তার সাক্ষাৎকার গুলো সবসময় প্রকৃত সত্য বলতোনা, বরং ঘটনার প্রতি তার আবেগীয় বক্তব্য ছিল, যেখানে সাইকোথেরাপিস্ট, জ্যোতিষবিদ্যা কিংবা অন্য থেরাপিস্টরা তার দোষারোপ করার অভ্যাসকে রিইনফোর্সড করেছিল। যখন জনগণ সেই কাহিনী গুলোকে সত্য হিসেবে নিত তার এই আচরণ আরো মজবুত হতো! দ্য টাইমসের সিমন জেনকিন বলেছিলেন- প্রিন্সেস ডায়না ছিলেন এই যুগের অসুখী নারীদের প্রতীক!

তার ব্যক্তিজীবন আর দুর্বিষহ হলো যখন তার গোপন প্রেমিক জেমস হেউয়িট তাদের সম্পর্কের খুঁটিনাটি প্রকাশ করে বই লিখলেন “প্রিন্সেস ইন লাভ’! এটা ছিল চরম বিশ্বাসঘাতকতা! ১৯৯৫ সালে পাকিস্থানী কার্ডিয়াক সার্জন হাসনাত খানের সঙ্গে পরিচিত হলেন, দ্রুত তাদের সম্পর্ক গভীর হলো, প্রিন্সেস সার্জনের জগতে ডুব দিলেন। মেডিকেল জার্নাল পড়তেন, পাকিস্থানী প্রথা শেখার চেষ্টা করতেন! খান হয়তো তাকে সত্যি পছন্দ করতেন! তিনি এ সম্পর্ক কখনো বাইরে আনেননি, পাপারাজ্জিদের ক্যামেরার বাইরে রেখেছিলেন। তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে বসে থাকলেও প্রিন্স চার্লস তার ইন্টারভিউ ও আত্মজীবনীতে তাকে ইমোশনালি অস্থির প্রকৃতির হিসেবে চিত্রিত করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। রাজপরিবারের পক্ষ থেকে এরকম পরোক্ষ আক্রমণে শেষ পর্যন্ত ১৯৯৫ সালে গোপনে ইন্টারভিউ ভিডিও দিলেন! তিনি অসুখী জীবনের গল্প শোনালেন, জানালেন বিয়েটা কখনোই সুখের হতোনা কারণ আগে থেকেই চার্লসের জীবনে ক্যামিলা ছিল! তিনি আরো বলেছিলেন- ‘আমি মানুষের হৃদয়ের রাণী হতে চাই, সিংহাসনের রাণী নয়!’ রানী এলিজাবেথ খুব রেগে গিয়েছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন এভাবে মিডিয়ায় কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করলে রাজপরিবারের সুনাম শেষ হতে বাধ্য। ডিভোর্সের ঘোরবিরোধী হয়েও চার্লস ও ডায়ানাকে আনুষ্ঠানিক ডিভোর্সের অনুমতি দিলেন! ডায়ানার অনুরোধ ছিল বিচ্ছেদের পর যেন তার উপাধি প্রিন্সেস অফ ওয়েলস থাকে। ক্ষুব্ধ রাণী এলিজাবেথ প্রজ্ঞাপন জারি করে তার উপাধি ‘হার রয়্যাল হাইনেস’ কেড়ে নিলেন। ব্রিটিশ জনগণ এই কাজকে রাণির সংকীর্ণ মনের প্রতিশোধ পরায়ণতা হিসেবেই দেখেছিল!

১৯৯৭ সালে রেডক্রসের পক্ষে ল্যান্ডমাইনের বিরুদ্ধে সচেতনতা জাগাতে আফ্রিকা ভ্রমণ করেছিলেন। এই সময় তিনি না ছিলের রাজকীয় প্রতিনিধি, না ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের কেউ, তবু ব্যক্তি ডায়ানার উপস্থিতি ল্যান্ডমাইন ও তার ভয়াবহতা সম্পর্কে সমগ্র পৃথিবীতে আলোড়ন তুলেছিল। ডায়ানাও যেন জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পেয়েছিলেন। এই সময় সংসার জীবন চলা কালে চার্লসের সাথে যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছিল তা কমে আসে। চার্লস ও কিছুটা নমনীয় হোন। মাঝে মাঝে একসাথে সন্তানদের সময় দিতেন। মিডিয়ায় পস্পরের প্রতি বিষেদাগার বন্ধ হলো। পুত্র উইলিয়ামের পরামর্শে ডায়ানা মূল্যবান সব পোশাক অকশনে বিক্রি করে সব টাকা মানব সেবায় দান করেছিলেন। তার ব্যক্তিগত জীবনে হাসনাত খানের সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। খান অন্তরালে থাকতে ভালোবাসতেন, কিন্তু ডায়ানা তাদের রোমান্টিক সম্পর্কের কথা প্রেসে প্রকাশ করে দিলে খুবই বিরক্ত হয়েছিলেন।

ডায়ানা, ডোডি আল ফায়েদ

১৯৯৭ সালেই পরিচিত হোন মিশরীয় ধনকুবেরের পুত্র ডোডি ফায়েদের সংগে। তারা ঘন্টার পর ঘণ্টা গল্প করতেন বীচে। দুজনেরই অনেকটা একই রকম শৈশব ছিল, প্রাচুর্যে ভরা তবু নিঃসঙ্গতার হাহাকার! যদিও ডোডির লেডিকিলার হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রেসের টনক নড়ল, তারা লিখল- ‘দ্য প্রিন্সেস এন্ড দ্য প্লেবয়!’ পুনরায় পাপারাজ্জিরা পিছনে লাগল। ডায়ানা ডোডির সাথে দেখা করার জন্য প্যারীস গেলেন। ডিনারে যাওয়ার সময় ফটোগ্রাফাররা রীতিমতো বাইক নিয়ে তাদের তাড়া করছিল, অল্পের জন্য দুর্ঘটনা থেকে বাঁচল তাদের গাড়ি!

ডিনার শেষে হোটেলের পিছনের দরোজা দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ড্রাইভার হেনরি পল আগে থেকেই মদ্যপ থাকতেন আর সেদিন কিছু ওষুধ ও খেয়েছিলেন। মারসিডিস গাড়ি নিয়ে প্রচন্ড জোরে এলোপাথারি ভাবে চালাতে লাগলেন। পিছে পিছে কয়েকটা গাড়ি ও বাইক নিয়ে তাড়া করলো ফটোগ্রাফাররা! প্রতি ঘন্টায় একশ কিমি এর বেশি গতি নিয়ে সীন নদীর নীচের আলমা টানেলে ঢুকে কলামের সাথে ধাক্কা খেয়ে বিধ্বস্ত হয়ে গেলো তাদের গাড়িটা। ডোডি ফায়েদে ঘটনাস্থলেই মারা গেলেন। প্রিন্সেস ডায়ানা তখনো বেঁচে ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে তখনো পাপারাজ্জিরা চূর্ণ বিচূর্ণ গাড়িটিকে ঘিরে রেখে যতো বেশি সম্ভব ছবি তোলার চেষ্টা করছিল। মেশিগানের ফায়ারিং এর মতো জ্বলছিল তাদের ক্যামেরার ফ্ল্যাস লাইট!

চিকিৎসকেরা ডায়ানাকে অপারেশন টেবিলে তুলে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন বাঁচানোর। কিন্তু অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে ৩১ আগসট, ১৯৯৭ সালের ভোর চারটায় মৃত্যু হয় তার! তার মৃত্যুর খবরে সবাইকে অবাক করে দিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন প্রিন্স চার্লস! তিনি নিজে প্যারীসে গিয়ে ডায়ানার মৃতদেহ লন্ডনে নিয়ে আসলেন! রাণি এলিজাবেথের এতে খুব বেশি সায় ছিলোনা। প্রিন্স চার্লস প্রথমবারের মতো মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেলেন। তিনি বলেছিলেন- ‘রাজপরিবারের কেউ তাকে আনতে না গেলে ব্রিটিশ জনগণ কোনদিন রাজপরিবারকে ক্ষমা করবেনা!’ জনগণ প্রত্যাশা করেছিল রাজপরিবার লণ্ডনে এসে শোকজ্ঞাপন করবে। কিন্তু রাণী এলিজাবেথ লন্ডনে তো আসলেনই না এমনকি শোকের প্রতীক হিসেবে বাকিংহাম প্যালেসে পতাকা অর্ধনমিত ও করলেন না! তিনি আসলে জনমত বুঝতে পারেননি। প্রতিবাদ উঠল- ‘রাজপরিবারকে অবশ্যই মাথা নীচু করতে হবে, নতুবা এটা বিলুপ্ত হবে!’ সংবাদপত্রে শিরোনাম হলো- ‘কোথায় আমাদের রাণী? কোথায় তার পতাকা?’ প্রবল জনমতের চাপে পড়ে ডায়ানার মৃত্যুর চারদিন পর রাণি এলিজাবেথ বাকিংহাম প্যালেসে এসে এই মৃত্যুতে শোকজ্ঞাপন করেছিলেন!

তার আচরণের ব্যাখ্যায় বিহ্যাভিওরাল পারস্পেকটিভ থেকে বলা যায় আচরণ পরিবর্তিত বা অর্জিত হতে পারে পরিবেশ ও অন্যদের প্রভাবে ও তাদের প্রতি প্রতিক্রিয়ায়! তার যেসব আচরণ সবার প্রশংসা পেয়েছিল তা রিইনফোর্সার হিসেবে কাজ করেছিল বা ওই আচরণের প্রবণতা বাড়িয়ে দিয়েছিল, যেমন- স্বেচ্ছাসেবী ও দাতব্য কাজ, সন্তানের ভালোবাসা, জনগণের ভালোবাসা! আবার পরিবেশ থেকে তার জন্য বিরুপ প্রতিক্রিয়া আসলে তার জন্য অন্যরকম আচরণ করেছিলেন। এগুলো ছিল তার উপর পানিশমেন্টের মতো। রাজ পরিবারের সাথে প্রচন্ড টানাপোড়েনের চাপে বুলিমিয়া ও ডিপ্রেশন হয়েছিল। রাজপরিবার তার পদবী কেড়ে নিলে নিজের আত্নপরিচয় দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন, নিজেকে রোবোটের মতো অনুভূতিহীন মনে হতো তার, অপর্যাপ্ত মনে হতো! বিবাহিত জীবনে অসুখী হওয়ার কারণে বারবার সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন।

কগনিটিভ পারস্পেক্টিভ থেকে ভাবলে মনে হয় তার ব্যক্তিত্ব প্রভাবিত হয়েছিল উনি যে পরিস্থিতি গুলোর মুখোমুখি হয়েছিলেন সেগুলো নিয়ে তার নিজস্ব ব্যখ্যা দিয়ে। উনি যেভাবে সেই ঘটনাগুলো কে নিয়ে ভেবেছিলেন তা দিয়ে। এছাড়া অন্য তাকে নিয়ে কি ভাবছে, অন্যদের সাথে নিজেকে তুলনা করার মতো বিষয়গুলো ও তার ব্যক্তিত্ব ও আচরণকে প্রভাবিত করতো। এছাড়া ছোটবেলা থেকে তার মধ্যে হয়তো ছিল প্রিয়জন ছেড়ে যাবে এই রকম একটা পূর্বনির্ধারিত চিন্তার ধরন!

নিওএনালাইটি পারস্পেকটিভ থেকে ভাবলে আন্দাজ করা যায় তার ব্যক্তিত্বের মূল সেলফ বা নিজস্বতা বোধে কিছুটা অপর্যাপ্ততা ছিল! তাই সংবাদমাধ্যম, রাজ পরিবার বা জন সাধারণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবেন কিনা এ নিয়ে হয়তো কিছুটা অনিশ্চয়তা বোধ কাজ করতো মনে। এসব নিয়ে যেন সমালোচনা না হয় তাই বারবার ভিন্ন আঙ্গিকে ভিন্ন ব্যক্তিত্বে নিজেকে উপস্থাপন করতেন। তবে তিনি মূলত অন্তর্মুখী মানুষ ছিলেন যিনি নিজেকে বহির্জগতে প্রকাশ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিলেন। তার সদা চঞ্চল ও উচ্ছ্বল চরিত্রের উপর রাজকীয় প্রটোকল চাপানোর কারণে এক সত্তায় একাধিক পরিচিতি বহন করতে হচ্ছিল, সাথে ছিল বড় দুই বোনের একাডেমিক সফল জীবন যা তার উপর চাপ তৈরি করেছিল হয়তো। সবকিছু মিলিয়ে নিজেকে নিয়ে কিছুটা হীনমন্যতায় ভোগা অস্বাভাবিক ছিলনা। অল্প বয়সে ডিভোর্স প্রতিকূল পরস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তার সত্তাকে প্রচন্ড চাপে ফেলেছিল, ফলত নিজস্বতাকে নিয়ে অপর্যাপ্ততায় ভোগার বোধটা অনিবার্য হয়ে উঠেছিল!

বাইরের দুনিয়ার কাছে তারকা খ্যাতি পেলেও ভিতরে হতাশা কাজ করতো হয়তো সবসময়। প্রতিকূল শৈশব, পোস্ট নাটাল ডিপ্রেশন (বাচ্চা জন্মদানের পর হতাশা), অসুখী বিবাহিত জীবন তাকে হতাশার জাল থেকে বের হতে দেয়নি কখনো! যদিও সবচেয়ে বেশি ফটোগ্রাফ তারই তোলা হয়েছিল তবুও হয়তো স্পটলাইটে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না। হতাশার জন্য থেমে থাকেননি , বরং সমগ্র পৃথিবীতে শান্তি আনার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ছিলেন প্রকৃতির পাঠানো আরোগ্যকারী যিনি নিজের জীবন ভেঙ্গে চুরমার হলেও পৃথিবীতে অখন্ড শান্তির জন্য কাজ করেছিলেন। কারো ব্যক্তিত্বে নিঃসঙ্গতা দূর করার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে ভালোবেসে অন্যদের সাহায্য করা। প্রিন্সেস ডায়ানা তাই করেছিলেন। তবে আব্রাহাম মাশলোর ‘হায়ারকি অফ নিড’ তত্ত্ব মতে মানুষের চরিত্রের বিকাশের সর্বোচ্চ পর্যায় হলো সেলফ একচুয়ালাইযেশন বা আত্মোপলব্ধির পর্যায়। তবে এই ধাপে পৌছাতে হলে অনেকগুলো মৌলিক চাহিদার ধাপ পূরণ হতে হয়। তার অন্যতম হচ্ছে ভালবাসা বা অন্যের সাথে একাত্ম হওয়ার ধাপ। তিনি অনেক গুলো দাতব্য কাজ শুরু করলেও ডিভোর্সের পর প্রায় অধিকাংশই ছেড়ে দেন। তার সত্যিকারের ভালোবাসা পাওয়ার চাহিদাটি কখনো হয়তো পূরণ হয়নি। তাই আত্মোপলব্ধির সর্বোচ্চ ধাপে তিনি পৌছাতে পেরেছিলেন এই কথা বলা যাবেনা!

তৎকালীন অসংখ্য মেয়েদের যেন প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। প্রিন্সেস হওয়া সত্ত্বেও তার অসুখী জীবন, প্রেমিকদের প্রতারণা, সারা জীবন সঠিক মানুষটিকে খুঁজে না পাওয়া, সবসময় দোষ খুঁজে বেড়ানো শ্বাশুড়ির সাথে মনোস্তাত্বিক সংঘাত, সন্তানের প্রতি প্রচন্ড ভালোবাসা, হতাশা, রাজকীয় সংকীর্ণ প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, এসবের মাঝে মেয়েরা হয়তো নিজেদের অস্তিত্বকে খুঁজে পেয়েছিল। এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা, অন্যদের চাহিদা অনুযায়ী নিজেকে মানিয়ে নেয়ার যে চেষ্টা করেছিলেন সেটাকে বলে মেয়েদের আবেগিক উভয়সংকট  (quintessential female dilemma)।

ছবি ও লেখা কৃতজ্ঞতাঃ ইন্টারনেট

0 Shares

১৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ