
লোকমুখে যখন থেকে শুনতে শুরু করি মিনি কক্সবাজার খ্যাত অপরূপ মৈনটের সৌন্দর্যের কথা তখন থেকেই মৈনটের প্রতি গভীর ভালবাসা আর নির্মল প্রেম অন্তরে জাগ্রত হতে শুরু করে। মনে প্রবল স্বাদ জাগে একটিবার হলেও মৈনটের অপার সৌন্দর্য অবলোকন করতে যাব।
তবে, এইবার শীতে আমার একটা শখ জাগলো, আমি একা গ্রামের ভিতর দিয়ে গ্রামের অপরূপ বৈচিত্র্য দেখতে দেখতে হেঁটে মৈনট দেখতে যাব।
যেই কথা সেই কাজ, মুয়াজ্জিনের সুমধুর কন্ঠে আযানের সুরে ঘুম ভাঙ্গে, নামাজ পড়ে দিলাম রওনা।
আমাদের গ্রাম ডাইয়ার কুম গ্রামের আঁকাবাঁকা রাস্তার ভিতর দিয়ে হাঁটছি, চারদিকে সবুজের সমারোহ, পাখি কিচিরমিচির গান করছে।পথের দুইপাড়ে নাম না জানা বাহারি ফুল। কোনটা লাল, কোনটা সাদা, আবার কোনটা নানা রংয়ের। কুয়াশার ফাঁক ভেদ করে কেবল সূর্যের আলো উঁকি দিচ্ছে। মিষ্টি শীতল বাতাস এক অপূর্ব মাদকতা। গাছি গাছ থেকে খেজুরের রস নামাচ্ছে। আরেকটু আগাতেই দূর থেকে ঢেঁকির আওয়াজ পেলাম, মনে হলো কেউ যেন চাউল কাটছে পিঠা বানাবে। খেজুরের রসে ভিজানো পিঠা খেতে জবর মজা।
গ্রামের ভিতর দিয়ে হাঁটছি তো হাঁটছি, অনেক দূর। উঠানে বোনেরা নকশা আঁকা কাঁথা সেলাই করছে, আবার কেউ রোদ পোহাচ্ছে আর খেজুর পাটি বুনাচ্ছে, মনোরম সুন্দর এক দৃশ্য। দোহার খাল পাড় আসতেই দেখি একদল পোলাপানে হাত দিয়ে খালের নিশ্চল পানিতে মলা মাছ ধরছে। মলা মাছের চড়চড়ি খেতে দারুণ মজা এই কথা মনে হতেই যেন ক্ষুদায় পেট চোঁ চোঁ করতে শুরু করছে । দেখি এক চাচা কটকটি বিক্রি করছে, তার কাছথেকে কটকটি খেলাম। তাদের গ্রামে আসছি তাই দাম নিলেন না, খুশি হয়ে আরো কতখানি বেশি করে দিলেন।
আকাশে প্রচন্ড রোদ, কিন্তু বাতাস বেশ ঠান্ডা মনে হচ্ছিল।
হাঁটতে হাঁটতে যখন মৈনটের কাছাকাছি এসে পরি তখন দেখি পথে বালু আর বালু, পা যেন আর চলতে চায়না। নিচ থেকে পা কে যেন টেনে ধরে রাখছে। বালি কয়- কই যাও, এতদিন পরে আইছাও আমার এইহানেই থাহো। বালু দিয়ে পোলাপান ঘর বানাচ্ছে আর ঝিনুক দিয়ে মালা গাঁথছে। আমিও কতগুলো ঝিনুক টুকিয়ে কোছরে গুঁজে নিলাম।
নৌকায় চড়ে পদ্মার অপরূপ সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে পদ্মার মাঝবুকে যাই। জেলেরা জাল দিয়ে রুপালী ইলিশ মাছ ধরছে। এই প্রথম আমি জীবিত ইলিশ মাছ দেখলাম, দারুণ এক শিহরন। সারি সারি নাম না জানা পাখি ভেসে বেড়াচ্ছে পদ্মার নির্মল জলে। শীতের নানা অতিথি পাখির কিচিরমিচির গানে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিলাম প্রকৃতির মাঝে। আমার কাছে এরচেয়ে আর রোমাঞ্চকর কি হতে পারে। যতদূর চোখ যায় অপলক চেয়ে থাকি। আহ্ কি রূপ, কি সৌন্দর্য! পৃথিবীর সমস্ত সুখ আর সৌন্দর্য যেন এসে ধরা দিল একসাথে, যেন পৃথিবীর বুকে একটুকরো জান্নাত।
ঠান্ডা বাতাস, শীত শীত অনুভব হচ্ছিল, গরম কাপড় পড়ে নিলাম। মৈনটের রাস্তায় রয়েছে সারি সারি টংঘর ও ফাস্টফুডের দোকান। সেখানে থেকে পদ্মার ইলিশ ভাজার সাথে পান্তাভাত খেলাম। দারুণ এক মজা, না খেলে বুঝা যায়না এর অপার স্বাদ। মৈনটের চারপাশ বেশ পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন, মনে হল এখানকার সবাই পরিবেশ সচেতন। আমিও ময়লা, আবর্জনা এখানে সেখানে না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে ফেল্লাম।
সারাদিন পদ্মার পাড়ে ঘুরে বেড়ালাম, দারুণ মজা। যেদিকে তাকাই কেবল প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্যের সমারোহ। সৃষ্টি কর্তার এক নিখুঁত সৃষ্টি এই মৈনট। প্রায় পাঁচ ঘন্টা হেঁটে এসে মৈনটের সকল সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে পথের ধকল ভুলে মনটা সতেজ হয়ে উঠলো।
মৈনটের অপার সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গেলে দিনশেষ হয়ে যাবে। আবার পরে কমু, সূর্য্য ক্রমশ পশ্চিম দিকে হেলে পরছে, সাঁঝ নামতাছে, বাইত্তে যামু। ঝিঁঝি পোকা ঝিঁ ঝিঁ করতাছে, মায়েরা তই তই কইয়া য়াঁস টুকাইয়া খোঁয়াড়ে ঢুকাইতাছে। মিনি কক্সবাজার খ্যাত অপরূপ মৈনটের অপার সব সৌন্দর্য দেখে তৃপ্তি মিটেনা মনের। বাইত্তে যাইতে দিলে টানে না, ইচ্ছা হয় আরো থাহি। মৈনটের কানে কানে বলি আবার আসব এই বলে মনকে শান্তনা দিয়ে বাড়ির পথে রওনা করি।
বাইত্তে আইয়া দেহি মায় খুন্তি হাতে নিয়া খাঁড়াইয়া রইছে। মায় চিল্লাইয়া কয়- হারাদিন না খাইয়া কই আছিলা? আইজক্যা বাইত্তে আহো দিমুনে ঠ্যালা।
মায়ের হাতের বাড়াভাত খাইয়া ঝিনুক দেখতে দেখতে কহন ঘুমাইয়া পড়ছি জানিনা। স্বপ্নে দেখি আমি পদ্মা নদীতে দুইহাত ওপরে দিয়া হাঁতরাইতাছি।
সকালে ঘুমে থেকে উঠে দেখি গতর আর পা বিষ্যে বিছানা থেকে ওঠতে পারিছিনা।
এই বিষ যেন আনন্দের কাছে কিছুই না।
১৯টি মন্তব্য
স্বপ্ন গোধূলি
গ্রামের নাম বেশ অদ্ভুত। মৈনট গিয়েছি, এক কথায় অসাধারণ জায়গা। আপনার পোস্ট পড়ে আবারো ঘুরলাম।
সাখাওয়াত হোসেন
নামট শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও জায়গাটি দেখতে কিন্তু বেশ চমৎকার। আবার যখন যান আমাদের বাড়িতে বেড়ানোর নিমন্ত্রণ রইলো।
ভালো থাকবেন ভাইয়া।
বন্যা লিপি
দোহার গিয়েছি, শুনেছি মৈনট মিনি সমুদ্রসৈকতের কথা। কিন্তু যাওয়া হয়নি। আমার মেজো জায়ের বাবার বাড়ি দোহার এ।বারবার বলে যেতে। আপনার ভ্রমন কাহিনী পড়ে এখন খুব যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পেন্ডামিক টাইম চলছে, যাই কি করে? পদ্মা দেখতে গিয়েছিলাম এক বিকেলে। সুযোগ পেলে আবার যাবার ইচ্ছে আছে। দোহার আমার ভালো লেগেছে বেড়াতে। আপনার বর্নিত প্রাকৃতিক পরিবেশ আমার স্বচোখে দেখা। ভীষণ ভালো
শুভ কামনা।
সাখাওয়াত হোসেন
আবার দোহার আসলে অবশ্যই আমদের বাড়িতে বেড়াতে আসবেন আপু, তারপর না হয় একসাথ মৈনটের সৌন্দর্য দেখতে যাব।
আপনার মেজো জা-কে আমার সালাম দিবেন। শুভেচ্ছা রইলো অবিরত, ভালো থাকবেন।
মোঃ মজিবর রহমান
মৈনট ভ্রমণ বিশ্লেষন মন জগতকে জাগরিত করল সৃষ্টির অপরুপ শুভা নিজ চক্ষে দেখছি । অসাধারণ বর্ননা। পরিপাটি উপস্থাপন মৈনট দেখার সাধ জাগে। আল্লাহ সহায় হলে যাব ইনশাল্লাহ।
সাখাওয়াত হোসেন
অবশ্যই আসবেন ভাইয়া। একসাথ মৈনটের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে পদ্মার তাজা ইলিশ ভাজার সাথে খিচুড়িও খাওয়া হবে।
মনির হোসেন মমি
মৈনট নামটি বেশ সুন্দর। ভ্রমণ কাহিনী পড়ে মনে হল নিজেই যেন ভ্রমণ করে এলাম মৈনট।চমৎকার উপস্থাপনা। ভ্রমণ লেখায় ভেতরে দুএকটা স্থানীয় দর্শনীয় স্থানের ছবি থাকলে আরো ভাল হত।
সাখাওয়াত হোসেন
বাস্তবে মৈনটের সৌন্দর্য আরও বেশি চমৎকার। সময় পেলে একবার আসবেন আমাদের দোহারে।
মনে হবে যেন এটা আপনারই গ্রাম।
মনির হোসেন মমি
নিমন্ত্রণে অসংখ্য ধন্যবাদ।আশায় বেচে থাকি।
স্বপ্ন নীলা
সুন্দর এবং সাবলীল লেখা। পড়তে পড়তে কখন যে শেষ হলো তা বুঝতে পারি নাই। দোহার গিয়েছি। কিন্তু মৈনটের সৌন্দর্য্য উপভোগ করা হয় নাই। চমৎকার বর্ণনার দেখে নিলাম মৈনটের সৌন্দর্য্য —- শুভকামনা রইল
সাখাওয়াত হোসেন
আবার যখন দোহার আসবেন আমাকে অবশ্যই জানাবেন ভাইয়া।
ফয়জুল মহী
খুব সুন্দর লিখেছেন ,
ভীষণ ভালো লাগলো পাঠে,
শুভ কামনা নিরন্তর।
সাখাওয়াত হোসেন
মন্তব্যে অনুপ্রেরণা পেলাম। অশেষ ধন্যবাদ ভাইয়া, ভালো থাকবেন।
জিসান শা ইকরাম
ডাইয়ার কুম বাংলাদেশের কোনো স্থানের নাম! মনে হয় বিদেশের কোনো এক স্থানের নাম।
মৈনট যেতে যেতে গ্রাম বাংলার সুন্দর বর্ননায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম। জীবন্ত বর্ননায় মনে হচ্ছিল আমিও আছি আপনার সাথে।
আপনার ইচ্ছে শক্তি জেনে অবাক হলাম খুবই। পাঁচ ঘন্টা হেটে পৌছালেন মৈনট!!!
কখনো যাইনি এই স্থানে। আপনার পোস্ট পড়ে যাবার ইচ্ছে প্রকট হলো। যাবো ইনশ আল্লাহ্।
নিয়মিত লিখছেন দেখে ভালো লাগছে।
ভালো থাকুন, শুভ কামনা।
সাখাওয়াত হোসেন
ইনশাআল্লাহ একবার এসে ঘুরে যাবেন আর সেইসাথে একসাথে ইলিশ ভাজাও খাওয়া হবে।
ভালো থাকবেন ভাইয়া।
আরজু মুক্তা
পেপারে পড়েছি। আবারও পড়লাম। ভালো লাগলো
সাখাওয়াত হোসেন
প্রাকৃতিক পরিবেশে জায়গাটি দেখলে আরও বেশি ভালো লাগবে।
ভালো থাকবেন আপু।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
আপনার বর্ণনায় মনে হচ্ছিল কোনো কিশোরের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী। মৈনট দেখার জন্য পাঁচ ঘন্টা হাঁটলেন!! স্যালুট জানাতেই হয়। দিনশেষে মায়ের বকুনি যেন কিশোরের প্রতি মিষ্টি শাসন।প্রতিটি বর্ণনায় যেন প্রকৃতির সৌন্দর্য খুঁজে পেলাম চমৎকার ভাবে। হারিয়ে গেলাম আপনার গ্রাম থেকে মৈনট আবার মৈনট থেকে গ্রামে পৌঁছানো পর্যন্ত সময়ে।
ভালো থাকুন নিরাপদে থাকুন। শুভ রাত্রি
সাখাওয়াত হোসেন
প্রাকৃতিক পরিবেশে ভ্রমণটি সত্যি আনন্দদায়ক ছিল। অশেষ কৃতজ্ঞতা আপু, ভালো থাকবেন।