
তিনদিন ধরে কথা বন্ধ। টুসি টুকটুক করে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরময়, রান্নাবান্না করছে, ছোট্ট দু’কামরার বাড়িটি পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখছে, আর অনিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। না দেখে আর উপায় কী, কথা যে বন্ধ!
আর এই কথা বন্ধের পিছনে কার দায় কতটা, সে এক অনুসন্ধানের বিষয় বটে!
তিনদিন আগে, সন্ধ্যেবেলার ঠিক এ সময়টাতেই বেঁধে গেল গোল। আর তার জন্য সর্বাগ্রে দায়ী করা যায় এখনকার এই অনির্দিষ্ট ছুটিটাকে। বেশ চলছিল জীবন, টোনাটুনির সংসার। মাত্র দু’মাসের বিবাহিত স্বামীটি সকালবেলা খেয়েদেয়ে অফিস, আর স্ত্রীটি বিকেল অব্দি একলা ঘরে। বিকেলে অনিক নামের স্বামী যখন ঘরে ফেরে, বাইরের জামাকাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়, টুসি নামের বউটি তখন চা টা বানিয়ে টেবিল সাজায়। তারপর দু’জনে মিলে এটা ওটা টুকটাক গল্প করে চা খেতে খেতে একটু টিভি দেখা। টিভি দেখতে ভালো না লাগলে প্রায়ই লুডোর বোর্ডটা নিয়ে বসে পড়ে ওরা। বিয়ের ঠিক দু’মাসের মাথায় বিশ্বজুড়ে শুরু হওয়া করোনার প্রভাবে আটকে গেল জীবন। অফিস বন্ধ, ঘরে বন্দি সারাক্ষণ। টিভি দেখে আর কত সময় পার করা যায়! দু’জনের সংসারে ঘরের কাজও বিশেষ কিছু নয়। বউয়ের সাথে সাথে সেগুলোও করার চেষ্টা করে অনিক। তবুও যেন অফুরন্ত সময়। সন্ধ্যেবেলায় লুডো খেলাটা হয়ে উঠল নিত্য প্রয়োজন। আর এই প্রয়োজনই গোল বাধাল সেদিন।
তার আগে যে গোল বাধেনি তা নয়, তবে তা গণ্ডগোল পর্যন্ত গড়ায়নি। সেদিন গড়াল, বেশ ভালোমতোই গড়াল। অনিক কোনও মায়াদয়া না করে একে একে টুসির গুটি কেটে চলেছে। এই পরিস্থিতিতে টুসির দরকার বারে বারে ছক্কা হাঁকান, কিন্তু পড়লে তো? কী যে গ্রহণ লেগেছিল সেদিন কে জানে , ছক্কাও পড়ে না আর টুসির গুটি বেরও হয় না। যে দুটো গুটি বাইরে ছিল, তাদেরও পথ আটকে রেখেছে অনিক, তার গুটি জোড়া করে। মাথা গরম না হয়ে যায় কোথায়? রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে কাঁদতে শুরু করল টুসি, একপর্যায়ে লুডোর বোর্ডটাও ছিঁড়ে ফেলল কুটি কুটি করে। এ পর্যায়ে অনিক সহানুভূতি দেখাতে গেল আলতো করে বউকে কাছে টেনে। আর যাবি কোথায়! এক ঝটকা মেরে অনিককে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“থাক, আর দরদ দেখাতে হবে না এখন! মাত্র দু’মাস হয়েছে আমাদের বিয়ে হয়েছে, তারমধ্যেই এত বিষ জমেছে তোমার মনে? এমনি তো বলতে পার না, খেলার ছলে সেটা বুঝিয়ে দিলে? এতটুকুও ভালোবাসা নেই তোমার মনে আমার জন্যে!”
অবস্থা বেগতিক দেখে অনিক বলল,
“আরে, ওটা তো খেলা, তোমাকে আমি কত্ত ভালোবাসি! আর ভালোবেসেই তো বিয়ে করেছি তোমাকে!”
দু’চোখে দরিয়ার বান নিয়ে টুসির উত্তর,
“থাক থাক, আর বলতে হবে না!”
আবারও বউয়ের মান ভাঙানোর জন্য এগিয়ে গেল অনিক। টুসি দূর থেকেই বলল, “খবরদার এগোবে না আমার দিকে, কথা বলারও চেষ্টা করবে না!”
সেই থেকেই এই অবস্থা। একে ঘরবন্দি, তাতে এই অবস্থা, জীবন যেন তেজপাতা হয়ে গেছে একদম। রান্না-বান্না, খাওয়া-দাওয়া, কাজ-কর্ম সবই চলছে, কিন্তু কথা বন্ধ তো বন্ধই। অনিক যে চেষ্টা করেনি তা নয়, তবে টুসি সেই যে কুলুপ এঁটেছে তো এঁটেছেই। খুব নরম মোলায়েম মুখ করে, ঠোঁটে বিনয়ী হাসি ছড়িয়ে, চোখের চাহনিতে চুড়ান্ত আবেগের প্রকাশ ঘটিয়েও লাভ হচ্ছে না। হবে কেমন করে? যার জন্যে এই মোলায়েম মুখ, বিনয়ী হাসি আর চুড়ান্ত আবেগ, সে তাকিয়ে দেখলে তো! দৃষ্টি বিনিময়ও যে হচ্ছে না ঠিকমতো! এখন একমাত্র উপরওয়ালাই ভরসা। তিনি মুক্তি দিলেও দিতে পারেন, করোনা থেকে আর করোনার কারণে সৃষ্ট মাত্র দু’মাস বয়সী বউয়ের সাথে এই গণ্ডগোল থেকে।
বেডরুম থেকে দেখা যাচ্ছে, ছোট্ট ডাইনিং পেরিয়ে যে ছোট্ট ব্যালকনি, ওখানে টুসি দাঁড়িয়ে কারও সাথে মোবাইলে কথা বলছে। আহা পেছন থেকে বউটাকে কী সুন্দর-ই না লাগছে! কোমর পর্যন্ত ঈষৎ কোঁকড়া চুল, অঙ্গে জড়ানো আকাশীরঙ শাড়ি। কথা বলছে হেসে হেসে। হাসির দোলায় দুলে দুলে উঠছে টুসি, টুসির কোমর ছোঁয়া চুল। ভেতর ভেতর একটু কি অভিমান জমলো অনিকের মনে? কার সাথে এত ভাব? ভাবে হেসে হেসে কথা? শুধু অনিককেই অবহেলা?
মুখে মেঘ জমলো অনিকের৷ থমথমে মুখে শুয়ে পড়ল দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে। কেটে গেল কিছুটা সময়। বিষণ্নতায় একটু বুঝি চোখ জড়িয়ে এসেছিল। হঠাৎ এক আলতো ছোঁয়ায় কেটে গেল তা। আকাশী তাঁতের শাড়ির খসখস শব্দ হল। তবু অভিমান নিয়ে মুখ ফিরিয়েই রইল অনিক। দেয়ালে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই শুনতে পেল,
“মোড়ের দোকানটা খোলা নেই? মুখে মাস্ক পরে যাও তো একটু, আরেকটা লুডোর বোর্ড নিয়ে এসো। বড়আপু ফোন করেছিল, আমাদের ঝগড়ার কথা শুনে খুব বকলো, তারপর হাসতে হাসতে বলল, আমি নাকি ছোটই রয়ে গেছি এখনও। যাও, লুডো কিনে আনো। আমি যে ছোট নই, আর ঠুক কথাতেই রাগ করে বাড়ি মাথায় করি না, সে অপবাদটা আমার ঘোঁচাতেই হবে!”
দেয়াল থেকে চোখ না সরিয়েই অনিক ভাবলো, যাক বাবা, বাঁচা গেল!
২৮টি মন্তব্য
নীরা সাদীয়া
খুনসুটি পড়ে কেবল হাসলাম। আগে যখন ইন্টারনেট ছিলো না, তখন এগুলোই ঘটতো।
রেহানা বীথি
এখন আমরা প্রায় আগের যুগে ফিরে গেছি। ভালো থাকবেন সবসময়।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
আহ্। আপু অ-নে-ক ভালো লেগেছে। নতুন নতুন বিয়ে, টোনাটুনির খুনসুটি তাও লুডু খেলা নিয়ে চমৎকার লিখেছেন। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন শুভকামনা রইলো
রেহানা বীথি
অনেক ভালোবাসা।
ভালো থাকুন আপনিও। শুভকামনা রইল।
তৌহিদ
ঘরবন্দি খুনসুটি আর ঠুকাঠুকি সবারই লাগছে বুঝতে পারছি। আমিও এর বাইরে নই কিন্তু!!
লুডু খেলাটা মন্দ নয়। আমরাও খেলছি। ভালো থাকবেন আপু।
রেহানা বীথি
লাগছে তো বটেই ভাই, মিষ্টি-মধুর ঠোকাঠুকি। ভালো থাকবেন আপনারাও।
সুরাইয়া নার্গিস
দারুন খুনসুটির গল্প বেশ ভালো লাগলো।
লুডু খেলা আমিও জানি ছোটবেলা অনেক খেলেছি এখন সময় পাই না।
শুভ কামনা আপু।
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন আপনিও। শুভকামনা রইল।
সুরাইয়া পারভীন
হা হা হা হা হা দারুণ লেগেছে খুনসুটি, ঝগড়াঝাটি।
লুডু খেলতে খেলতে গণ্ডগোল আর তারপর টানা কথা বলা বন্ধ ।
চমৎকার লিখেছেন। ভালো থাকবেন আপু
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন। শুভকামনা সবসময়।
ফয়জুল মহী
অনন্যসাধারণ লেখা। শুভেচ্ছা । দোয়া করবেন।
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন সবসময়।
ছাইরাছ হেলাল
করোনাকালে এই মধুর লেখা পড়তে ম্নদ লাগে না।
আহা, লুডু যখন ঠুক বিহীন।
রেহানা বীথি
এই দুঃসময়ে মন হালকা করার ছোট্ট প্রয়াস ভাইয়া। ভালো থাকবেন সবসময়।
জিসান শা ইকরাম
করোনা কালে কত মিষ্টি মিষ্টি ঘটনা যে ঘটবে প্রতি সংসারে তার হিসেব কে রাখবে?
অনেক ভালো লেগেছে গল্প আপু,
শুভ কামনা।
রেহানা বীথি
আপনার অভিজ্ঞতাও জানতে চাই আমরা। ভালো থাকবেন ভাইয়া।
নাজমুল হুদা
এসব গল্প আমার জন্য পুরোপুরি নিরাপদ না। হিংসা লাগে।
তবে ঝগড়াটা ভালোই লাগলো অনিক পরে একটু ভাব ধরলেই পারত, আমি হলে ভাবটা ধরতাম। 😆
রেহানা বীথি
বেচারা নাস্তানাবুদ হয়ে বেশিক্ষণ ভাব ধরার সময় পায়নি। ভালো থাকবেন। দোয়া করি এই দুঃসময় থেকে মুক্তি পাই আমরা আর তারপরেই আপনার এমন একটি গল্পের প্লট তৈরি হোক খুব দ্রুত।
নাজমুল হুদা
আমরা সবাই মুক্তি পাই ও সবাই সুস্থ থাকুক। তবে গল্পের প্লট কল্পনায় থাকুক, বাস্তবায়ন হোক যথাযথ সময়ে।
সুপায়ন বড়ুয়া
করোনাকালের খুনসুটি
জটিল না হলে ভাল।
শুভ কামনা।
রেহানা বীথি
ভালো থাকবেন দাদা।
শুভকামনা সবসময়।
ইঞ্জা
মান অভিমানে কাটুক না বন্দী জীবন, লকডাউন চলছে দেশে কিন্তু ভালোবাসায় যেন লকডাউন না হয়।
চমৎকার অনুগল্প, ভালো লাগলো আপু।
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া।
ভালো থাকবেন সবসময়।
ইঞ্জা
শুভকামনা রইলো আপু
জাকিয়া জেসমিন যূথী
ভীষণ সুন্দর কাহিনীটা আপু। এত সুন্দর আর প্রাঞ্জলতায় একটা নতুন বিয়ের সম্পর্কের সৌন্দর্য, দুজনার প্রেম, অভিমান, খুনসুটি আর পরিশেষ লিখেছেন যে পড়ে সত্যিই ভীষণ মুগ্ধ হয়েছি। আপনার লেখা এই প্রথম পড়লাম আপু। বইমেলার বইটা নেয়া হয়নি। করোনা যাক। নিতেই হবে।
খুব ভালো থাকবেন।
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ আপুমণি। করোনা যাক, আমরা সবাই বেঁচে থাকি সুস্থভাবে। বই একটা দিতেই হবে আপনাকে।
হালিম নজরুল
গত দশ দিনে আমার পড়া সেরা ছোটগল্প। চমৎকার।
রেহানা বীথি
অসংখ্য ধন্যবাদ। ভালো থাকুন, নিরাপদে থাকুন সবসময়।