বিবাহের সকল প্রস্তুতি শেষ করে মজিদ শাকিব সহ তার পুরো পরিবার একটি গাড়ীতে।অন্যদিকে বরের গাড়ীতে বর কনে সহ বোনের পরিবার এবং কনের সাথে আসা একজন অতিথী।সময়ের তালে তাল রেখে খুব দ্রুতই বিয়ের কাজ শেষ করে বরযাত্রী নিয়ে বাড়ীর মুখী রওয়ানা দিলেন।এ দিকে মজিদের ছেলে তার চাচা শাকিবের কোলে বসে বাহিরে দিকে তাকিয়ে শুধু এ প্রশ্ন ঐ প্রশ্ন করেই যাচ্ছে।শাকিব গাড়ীতে বসে কেমন যেন আনমরা হয়ে বসে আছেন।মনে হল তার মনের ভেতরে বিরহের ঢেউ দোলছে।কিছুতেই সে তার প্রিয়তমা নূসরাতের মুখটি ভুলতে পারছেন না। বার বার যেন সামনে আসছে তার বচন ভঙ্গির অববয়গুলো।
-আবার হবেতো দেখা?
-কেন নয়?
-পরদেশী যে এমনি হয়।
-অন্তর দিয়ে বুঝতে পারলে পরদেশী সবায় নাহি রয়।
-তবুও হয় ভয়,না জানি কী হয়!
এর মধ্যে ভাতিজা আবারো প্রশ্ন করল।
-চাচ্চু ঐ চাচ্চু
অন্য মনস্ক প্রস্থানে চাচা ভাতিজার কথায় মনযোগ।
-হুম বলো?
-কী বলব তুমিতো দেখছি কুমড়া হয়ে আছো।
ভাতিজার কথা শুনে শাকিব হাসল।
-হা হা হা কুমড়ো মানে কী?
-কুমড়ো মানেও বুঝো না…নাহ্ তোমারে দিয়া কিচ্ছু হবে না।
ছেলের এমন পাকনা পাকনা কথা শুনে গাড়ীর সামনের বসা তার মা মিটমিটিয়ে হেসে যাচ্ছেন।ছেলেকে বলছেন।
-রকি বাবা তোমার চাচ্চুর আজ মন ভাল নেই….দুষ্টুমি করো না।অবশ্য কিছুক্ষণ পর কী হয় কে জানে!
ভাবীর কথায় শাকিব কেমন যেন রহস্যের গন্ধ পেল।সব চেয়ে আশ্চর্য হলেন ভাবী কী করে জানল তাদের প্রেম বিষয়ের উপখ্যান।মজিদের স্ত্রী কিছুক্ষণ পর পর চোখ রাখছেন তাদের পিছনে আসা বরের গাড়ীর দিকে।
-ভাবী এ সব কী বলছ? তুমি কী কিছু জানো নাকি?
-জানি না মানে!ভাবীরা না জানলে দেবরা কী বিয়ে করতে পারে?তোমার ভাই সাথে নতুবা তোমারে আজ আমি কী যে করতাম।তুমি আমারে না জানাইয়াই এসব….।
-ভাবী আস্তে কও ভাইজান শুনবে…।
-না,ওনি এখন সেলফোনে কথায় ব্যাস্ত।ওনি আবার সেলফোনে কথা বলা শুরু করলে বাহিরের হদিস রাখেন না।তুমি যদি আমাকে একটা স্পেশাল চাইনিজ খাওয়াও তাহলে তোমাকে একটা সুখবর দেব।
-কী বলো না?
-আগে বল প্রস্তাবে রাজী?
-ওকে ডান…।

ঠিক সে সময় বরের গাড়ীটা তাদের গাড়ীটাকে ওভাটেক করে।শাকিবের হঠাৎ চোখ পড়ে গাড়ীটির দিকে।দরজার গ্লাসের উপর দিয়ে ঝাপসা কার মাথায় যেন একটি লাল গোলাপ দেখলেন।মন আনচান করে উঠল।তাহলে কী নূসরাত ঐ গাড়ীতে? নাহ্ তা কী হয়!নূসরাত এলেতো বলতো তাকে।হয়তো অন্য কেউ।তবুও মন মানছে না তাই ভাবীকে জিজ্ঞাসা করলেন।
-ভাবী বরের গাড়ীতে কে কে আছেন?
-কেন?(ভাবী মিটমিটিয়ে হাসছে)
-না মানে বলো না?
-ওগাড়ীতে বর কনে,বরের বোন ও ছেলে এবং….।
-এবং কে? বলো না।
-এবং ডট ডট ডট
-মানে ?
-এটাও বুঝো না-মানে কেউ নেই।
আসল কথা এড়িয়ে গেলেন ভাবী।
-ওআচ্ছা।
হতাশায় উৎসুক মন বিধ্বস্ত।ভাবী লক্ষ্য করে দেখলেন দেবরের মনটা কেমন দুখিয়ে গেছে।
-চিন্তা করো না দেবর-দেখা হয়ে যাবে আবারো কোন একদিন।
এবার ভাবীর কথা কেমন যেন সতীনের গন্ধ খুজেঁ পেল শাকিব।মজিদের ফোনের কথা শেষ হওয়াতে সে আবারো আশাহত মন খারাপ করে ভাতিজাকে কোলে নিয়ে বসে রইলেন তার সিটে।মজিদ তার ওয়াইফকে বললেন।
-তোমরা কে কী যেন বলছিলে?
-কৈ কিছু নাতো!
-কীরে শাকিব আবার কোন ভেজাল টেজাল ভাজাইলি নাতো?
-কী যে কন ভাইজান!
আবারো মজিদের মোবাইলে রিংটোন বেজে উঠল।নম্বরটি দেখে মজিদ বিরক্তির স্বরে বললেন।
-কী যে শুরু করছে না!মোবাইলে রিং এর যন্ত্রণায় আর ভাল লাগে না।রিসিভ করল সে।
-হ্যালো…………(কথা চলছে)

গাড়ী চলছে সো সো করে।গ্রামকে পিছনে ফেলে ক্রমশতঃ শহরমুখী হচ্ছেন তারা। হঠাৎ এক সময় তাদের আশপাশে গাড়ীগুলো সংখ্যা  বাড়তে থাকে আর গতি শ্লো হতে থাকে।ড্রাইভার গ্লাসে চারদিক তাকিয়ে দেখলেন তার সামনে পিছনে বায়ে ডানে অসংখ্য গাড়ী।ক্রমশতঃ শ্লো গতিতে এগুচ্ছেন। ফোন কানে রেখে একটু হালকা করে মজিদ ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলেন।
-কী ব্যাপার ভাই,জ্যাম নাকি?
-হ্যা, তাইতো মনে হয়।সামনে নদীতো তাই পারাপারের জন্য সবাই সিরিয়াল ধরছে।তবে সমস্যা নেই,এ জ্যাম থাকবেনা কিছুক্ষণের মধ্যেই কেটে যাবে।

অনেকটা কাছেই ফেরি যার মাধ্যমে গাড়ীগুলোর নদী পথে একমাত্র পারাপারের মাধ্যম।উৎসুক শাকিব জ্যামে অতিষ্ট হয়ে ভাতিজাকে সাথে নিয়ে গাড়ী হতে বের হয়ে হাটছেন ফেরির সম্মুখমুখী।ফেরিতে এসে শাকিব ফেরির নিরাপত্তা বেষ্টনি রডে দুহাত চেপে ধরে নদীমুখী মুখ করে আছেন।দুষ্টু ভাতিজা তার মুডঅফ ভঙ্গি ভাঙতে প্রশ্নের ফন্দি আটলেন।
-চাচ্চু
-হুম।
-আমি ঝালমুড়ি খাব।
পাশেই ছিল ঝালমুড়ি বিক্রেতা।তাকে অর্ডার করতেই সে তৈরী করে দিল দু’ঠোঙা ঝালমুড়ি।টাকা দিয়ে দুজনেই যে যার মুডে ঝালমুড়ি খাচ্ছেন।এর মধ্যে ভাতিজা আবার ডাকলেন।
-চাচ্চু…
-আবার কী?
-তোমার কী মন খারাপ?
-না চাচ্চু,আমি ঠিক আছি।

এর মধ্যে অপেক্ষমান তাদের গাড়ী ফেরিতে ঢুকে পড়ল।সে গাড়ীর সামনে গিয়ে দরজায় উকিঁ দিয়ে ভাবীকে ইশারা করল গ্লাস ওপেন করতে।ভাবী গ্লাস ওপেন করলেন।
-ঝালমুড়ি খাবে? আনব?
শাকিব কথাগুলো বলে সোজাঁ হয়ে দাড়াতে চোখ পড়ল বরের গাড়ীর দিকে।তার সন্দেহ ছিল বরের গাড়ীতে দেখা খোপায় গোলাপ রাখা সেই মেয়েটি কে? তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নতুন বউয়ের বরাবর।ঠিক তার পাশেই বসা সেই গোলাপী মেয়েটি মুখ অপর দিক করে আছেন।ফেরিতে বরের গাড়ীটি এসে উঠেছিল ঠিক তাদের গাড়ী লাইনের পঞ্চম লাইনে।দূরত্ব একটু বেশী হওয়ায় সে তেমন বুঝতে পারছিলেন না আসলে ঐ মেয়েটি কে।একটু অপেক্ষা করতেই সেই মেয়েটি দরজা খুলে যখন গাড়ী হতে বের হলেন।তার রূপ তখন চোখকে ধাঁধিঁয়ে দিল। সেই একই রূপ যেন হাজার বছরের চেনা তার।তার চোখ ক্রমশত গোলাপ ছেড়ে তার ফেইসে রূপান্তরিত হয়ে যখন স্পষ্ট হল তখন তার বুঝতে একটুও সমস্যা হল না যে এই সেই তার নূসরাত।নূসরাত গাড়ী হতে নামতেই বাতাসে তার দীঘল কালো কেশ উড়তে থাকে- সাথে শাড়ীর আচঁল।ভাবীকে সে তার হাতের ঝালমুড়ীর প্যাকেটটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিশ্চুপে এখান হতে দ্রুত সেখানে চলে গেলেন।ভাবী তার পথ চাওয়ায় হা করে তাকিয়ে রইলেন।
-হায়!
শাকিব আশ্চর্য হলেও নূসরাত শাকিবকে দেখে একটুও আশ্চর্য হননি।তাই স্বাভাবিক ভাবে বললেন।
-হায়, কোন গাড়ীতে ছিলেন?
-ঐতো ভাইয়া ভাবীর সাথে।তুমি যে আসবে আমিতো ভাবতেই পারছি না।
-হুম আপনিতো একবারও বললেন না আমাকে সাথে যেতে- তাই আমিই সব ব্যাবস্থা করেছি। সবাই যখন বলল কনের সাথে বান্ধবীকে যেতে হবে তাই আমিও অমত করলাম না- এ সুযোগটা কাজে লাগালাম।
কথা বলতে বলতে ওরা ফেরির সম্মুখ ভাগের এক কোণে গিয়ে দাড়াল।পাশাপাশি দুজনের দৃষ্টি নদীমুখী-কখনো কখনো আকাশপানে পরিযায়ী পাখির কোলাহলে।
-তুমিতো জানতে আমি এই বর যাত্রীর একজন তাহলে একটি বারও কি মনে পড়েনি আমার কথা?
-এই আপনাদের ছেলেদের হল একটি দোষ! প্রেম করবে অথচ সবুর সয় না।আরে বাবা মনে করা কী বলে কয়ে হয়? মনে করতে হয়না ,মনে মন থেকেই যায় স্বচ্ছ গ্লাসের ন্যায়।তাছাড়া আমিতো যাচ্ছিই আপনাদের বাড়ীতে,দেখাতো হবেই।

দুজনেই চুপচাপ।নীরবতায় মন বলে যায় নদীর ঢেউয়ের তালে তালে কতকিছু।স্বপ্ন বুণে মন-এ বন্ধন যেন হয় না কখনো পর।
-আজকের এ পথটি যদি আর কখনো শেষ না হত।
-আমি পরিযায়ী পাখির মত উড়ে বেড়াতাম তুমি আকাশ হয়ে আগলে রাখতে আমায়।
-তুমি গলা ছেড়ে গাইতে কোন এক অনন্তকালের প্রেমের গান।
-আমি শ্রোতা মন্ত্রমুগ্ধে শুনতাম তোমার না বলা কত কথা।
-আদরে জড়িয়ে নিতাম তোমার উষ্ণ ভালবাসায়।
-সেই ভালবাসায় আমিও বুণে দিতাম জীবনের যত আশা।
নীরবতা ভেঙ্গে আবারো কথা বলেন শাকিব।
-কী হল!অমন চুপচাপ দাড়িয়ে কী ভাবছো?
-না কিছু না…এমনিই।আমার মন যখন খুব বেশী ভাল থাকে তখন এমনি চুপচাপ থেকে মনের খবর লই।
-তা কী পেলে মনের খবরে?
-আপনার মন জুড়ে আমার বিস্তৃত ভাবনার আকাশ।
-হুম।এই আপনি আপনি করে বলাটা না আমাদের প্রেমে কেমন যেন অন্তরায় হয়ে দাড়ায়।তুমি কী এখনো আমাকে তুমি করে বলতে পারো না?
-পারিতো কিন্তু বলি কী করে?
-কেন?
-ঐতো! লজ্জা করে না বুঝি?
-যখন দুই মন এক হয় তখন আর কোন বিবেদ থাকে না।থাকতে নেই সংকোচ লজ্জাবোধ তাতে প্রেমে অমঙ্গল হয়।
-তাই বুঝি?
-হুম, জ্বি ম্যাডাম।বলো না একবার তুমি করে-তুমি যে আমার।

গাড়ীর হর্ণ বাজল।ওরা সামনে তাকিয়ে দেখল কিছুক্ষণের মধ্যেই ফেরি ভীড়বে তার জেটিতে।নূসরাত শাকিবের শেষ কথার উত্তর দিলেন ইশারায়।গাড়ীর হর্ণ শুনে নূসরাত ফিরে যাচ্ছিলেন তার গাড়ীর দিকে,পিছন ফিরে শাকিবকে লক্ষ্য করে হাতের আঙ্গুলের ইশারায় লাভ একেঁ তালুতে ফু দিয়ে তা উড়িয়ে দিলেন তার প্রতি,তর্জুনীর আঙ্গুলে একেঁ দেখালেন ভালবাসি “তোমায়”।

চলবে...

প্রথম পর্ব

0 Shares

২১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ