বাংলা মাসের হিসেবে এখন বৈশাখ শুরু যদিও, কিন্তু এই শহরের প্রকৃতি যেন কেবলই শীতকে বিদায় দিয়ে বসন্তকে স্বাগত জানাচ্ছে। ড্রইং রুমের কাঁচের দরজার এদিকটায় দাঁড়িয়ে মুগ্ধতায় বাইরের প্রকৃতি দেখি প্রায়ই। বেল্কনির ওপাশে শীতল বাতাস বইছে। বাতাসের তীব্রতার সাথে তাল মিলিয়ে নিচে উঠোনের গাছগুলো থেমে থেমে একদিকে হেলে যাচ্ছে। যেন মিউজিকের তালে ছন্দে ছন্দে দুলছে হলুদ আর বেগুনি ফুলের গাছেরা। প্রতিবেশী চায়নিজ শিশুদের সাথে রিহান ছুটোছুটি খেলছে, ফুঁ দিয়ে বাবল উড়িয়ে দিচ্ছে শূন্যে, বাতাসে।
কিন্তু এমন খোলামেলা পরিবেশে ছুটোছুটি খেলে বেড়ে উঠবার সুযোগ হয়নি আমার। ইটপাথরের চার দেয়ালের শহুরে এক জীবন ছিল। যেখানে লোকে শুনবে বলে জোরে কথা বলা নিষেধ, হাহা হোহো শব্দে হেসে উঠা নিষেধ। যেখানে দুপুরের আহারের পর হাল্কা ঘুমিয়ে নেবার নিয়ম, সন্ধ্যায় পড়তে বসা আর ঘড়ির সময় ধরে রাতে ঘুমোতে যাবার নিয়ম। ব্যবসায়িক কাজে বাবা ঢাকায় গেলে বাবাহীন বাড়িটিতে আনন্দের জোয়ারে ভাসতাম। বিকেলের ছাদে দাঁড়িয়ে বুকভরে শ্বাস নিতে নিতে গেয়ে উঠতাম, আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। সময় ধরে ঘুমানোর তাড়া নেই। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে একজোড়া রক্তচক্ষুর তাগাদার দিকে চেয়ে পড়তে বসবার তাড়া নেই। আহা স্বাধীনতা !
সময় বয়েছে অনেক। নিউইয়র্কের স্কুলগুলোয় বসন্তকালীন ছুটি চলছে। ছেলে দুটি গেইম খেলায় মগ্ন। সিমকার্ডবিহীন ফোনটির চার্জ ফুরিয়ে যাবার আগ অবধি খেলা চলতেই থাকে। রুটিন মাফিক বকাঝকা চলে আমার। প্রতিনিয়তই নতুন নতুন নিয়ম জারি করি। ঘরে বাইরে নানান কাজে ছুটোছুটি করা আমায় সারাটি দিন বাসায় কাটাতে দেখে বড় বাপজান রিয়াসাত জিজ্ঞেস করে, " আম্মু, তুমি আজ বাইরে যাবা না ? " উত্তরে বলি, " না "। সে বলে, "ওহ্ " । দু'অক্ষরের একটি মাত্র শব্দ ! যেন আহত শোনালো কণ্ঠটি। তাঁকে বলি, "কেন জানতে চাইলে ? " সে ততোধিক হতাশার স্বরে, বেজার মুখ করে বলল, " নাহ্ এমনিই " । বিরক্তিতে বলি, " ভেবেছ আমি কিছু বুঝি না ? আমি বাইরে গেলে বড্ড আনন্দ হয় বুঝি ? " এবার ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি ঝুলে থাকে তাঁর। সে হাসি ধীরে ধীরে প্রশস্ত হয় আরো, ছড়িয়ে পড়ে সারা মুখে, চোখে। আমি মুখ ঝাম্টা দিয়ে বলি, " বদের হাড্ডি "। রিয়াসাত কাছে এগিয়ে এসে বলে, " হোয়াট ইজ বডের হাদ্দি ? " এমন অদ্ভুত উচ্চারণে হোহো করে হেসে উঠি আমি। হেসে উঠে সে-ও......
বয়সের গহীন এক অর্থ সামনে এসে দাঁড়ায়। আমাদের জীবনের সাথে জীবনের কতো মিল, তাই না ?
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
৮টি মন্তব্য
শুন্য শুন্যালয়
আমার ছেলে বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করছে। আমি রেগে গেলে বাংলায় কথা বলে খুশি করার চেষ্টা করে। বলে শুভ লাতলি।
জীবনের সাথে জীবনের মিল তো হবেই আপু। সময়ের শুধু রিসাইক্লিং হয়, ডিসপজাল নয়।
বাইরে যান না কেন? যান যান একা একা বাইরের হাওয়া মজার লাগে। 🙂
নীহারিকা
ছোটবেলায় আম্মা বাইরে গেলে আমিও বেশ খুশি হতাম। স্বাধীন স্বাধীন লাগতো তখন। কিন্ত সমস্যা ছিলো আমার ছোটবোনকে নিয়ে। আম্মা ফিরলেই সে আমার সমস্ত দুষ্টুমির লিস্ট গড়্গড় করে বলে দিতো। তারপর……. আর কিছু বলতে চাই না। 🙁
ব্লগার সজীব
উফ গেমস যে কত মজার তা যদি আম্মু আর বড় আপুকে বুঝাতে পারতাম 🙁
মেহেরী তাজ
আপনি ও পিচ্চিগুলা কে খেলতে দেন না? 🙁
নীলাঞ্জনা নীলা
রিমি আপু যেমন তুমি কিউট, তেমনি রিয়াসাত।
তীর্থর সাথে আমিও কথা বলে অনেক মজা করি। ও যখন খেলে ল্যাপুতে গিয়ে জ্বালাই, আমাকে শিখিয়ে দে না গুলটু। কাজের কাজ যা হয়, বেচারা পরাজিত হয়। 😀
শুভ নববর্ষ আপু। অনেক ভালো থেকো। -{@
ইলিয়াস মাসুদ
বড় মেয়েকে নিয়ে এই প্রথম দেশে গিয়েছিলাম গত মাসে,ও বাংলা আগে থেকেই পাড়তো তবে খুব একটা পরিস্কার ছিল না। এখন দেশ থেকে এসে বাংলা ছাড়া কথা বলছে না, খুব বাংলা শেখার আগ্রহ দেখাচ্ছে, যা আমি গত দশ বছরে পারিনি। আসার সময় ইয়ারপোর্টে বলছে আচ্ছা বাবা, তুর্জু ভাইয়া সাত্তককে বলেছে ছাগলের মত হাসিস না!!! তুর্জু ভাইয়া চাগোলের হাসি কি ভাবে জানে???
ইঞ্জা
শুভকামনা আপু।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
বাসা একা পেলে ছেলে মেয়েরা অন্যরকম স্বাধীনতা ভোগ করে।
ভালো লাগলো আপনার লেখাটি।