আমরা খুব অল্পতেই অধৈর্য হয়ে উঠি। হয়ে উঠি অসহিষ্ণু। রাস্তায় নামলেই বুঝা যায় সবাই কেমন জানি একটা দৌড়ের মধ্যে আছে। আছে তাড়ার মধ্যে। সবাই কোন এক অজানা ব্যস্ততায় ছুটছে তো ছুটছেই। কারো কারোর দিকেই তাকানোর যেন কোন ফুরসৎ নেই। নেই হাতে সময়। সবাই একটা গতির ঘোরের মধ্যে আছে। সবার গতি চাই গতি ! কেমন জানি অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা আর গতি কাজ করছে আমাদের জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে। বলা হয়ে থাকে বিজ্ঞান মানুষের জীবনে দিয়েছে গতি আর বেগ এবং নিয়ে গেছে সব অনুভূতি আর আবেগ। রাস্তায় কেউ এক সেকেন্ডের জন্য অপেক্ষা করতে চায়না। পথচারী রাস্তা পার হচ্ছে শশব্যস্ততা নিয়ে। রাস্তায় হাটার সময় ভ্রূক্ষেপ নেই কোথায় হাটছে, কিসের উপর দিয়ে হাটছে, গাড়ী চাপা পড়ছে নাকি গায়ে গাড়ির ধাক্কা লাগছে। রিক্সা, অটো রিক্সা, হাল্কা, মাঝারী বা ভারী যানবাহন কোন কিছুর প্রতি নেই কোন তোয়াক্কা এমনকি মোবাইলে কথা বলতে বলতে রাস্তা পারাপারেও। হকার, ফেরীওয়ালা, সব্জী, মাছ, মুরগীসহ বিবিধ পণ্যের বিক্রেতা, কুলী মজুর, সাধারণ মানুষ, পথচারী সবাই অনিয়ন্ত্রিত অপ্রতিরোধ্য অতি দ্রুত গতির মধ্যেই যেন আছে। আছে দৌড়ের মধ্যে আর ব্যস্ততার মধ্যে। আবার অন্যদিকে রিক্সা, অটো রিক্সা, কার, টেম্পু চালক থেকে শুরু করে ট্রাক বাস সব ধরণের হাল্কা ও ভারী যানবাহনের চালকদের হাতেও খুব একটা সময় নেই। তাঁরা শুধু গতির ওপরেই থাকতে চায়, সামনে একটা মানুষ বা জীব জন্তু পড়লো অথচ তা যেন তাঁদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। একটা গাড়ী একটু ব্রেক কষে আরেকটা গাড়িকে সাইড বা পথচলা সহজ করে দেবে তাঁরা তা করতেও নারাজ। সবাই ছুটছে তো ছুটছে জীবনের গতিকে অতিক্রম করে যেন যন্ত্রের গতিতে। হয়তবা মানুষ নয় যেন জীবন্ত কোন রোবট আবেগ অনুভূতি সহানুভূতি বিচার বিবেক বুদ্ধিহীন। গতিকে সবাই সবসময় কেন জানি কাবু করতে, বশে আনতে মরিয়া। চালকরা বিপদজনক ওভারটেকিং করতে গিয়ে মর্মান্তিক ও মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। যদি এক গাড়ির চালককে অন্য গাড়ির চালক সুস্থ ও স্বাভাবিক নিয়মে ওভারটেক করে এগিয়ে যায় তাহলে সে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে যেন তাঁর আঁতে ঘা লেগেছে। অতএব সে তাকে অতিক্রম করার জন্য প্রাণপণ ছুটতেই থাকে যতক্ষণ না তাকে ধরতে পারে। মনে হয় কেউ কাউকে ফেলে এগিয়ে গেলে তাঁদের আত্মসম্মানে আঘাত লাগে। তাঁদের ধারণা আমাকে ঢিঙ্গিয়ে, আমাকে ওভারটেকিং করে, আমাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার এতো দুঃসাহস তার কেমনে হয় ? প্যাডেল রিক্সা, ভ্যান গাড়ীও যন্ত্রচালিত গাড়ির চেয়ে কম যায়না। এসব গাড়ির অসুস্থ গতি আর দৌড়ের কুফলে আমরা প্রতিদিন রাজপথে মানুষের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর মিছিল দেখছি। মানুষ গতিকে অতিক্রম করতে গিয়ে গাড়ী চাপা পড়ছে, নদী নালা খাঁদ খন্দকে পড়ছে ট্রেনে কাটা পড়ছে আর অস্বাভবিক দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে অথবা পঙ্গুত্ব বরণ করছে। তবুও থেমে নেই গতি। যা নিয়ে আসছে মানুষের জীবনে দুঃখ দুর্দশা দুর্ভোগ ভোগান্তি আর দুর্গতি।
মানুষের জীবনেও একটা সুস্থ সুন্দর স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত মননশীল সৃষ্টিশীল নান্দনিক পারিবারিক সামাজিক জাতীয় এবং ধর্মীয় ভাব গাম্ভীর্যের নিজস্ব গতি প্রকৃতি রয়েছে। রয়েছে সুস্থ শুভ স্বাভাবিক অনিন্দ্য সুন্দর প্রতিযোগিতা নিজেদেরকে সাফল্যের অগ্রগতির দিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য। জীবন ধারণের জন্য, জীবনকে সুখী সুন্দর করার জন্য। পাশাপাশি বেঁচে থাকার প্রয়োজনে মানুষকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হচ্ছে একটি ছন্দময় সুন্দর সুস্থ মানবিক নৈতিক নিজস্ব কৃষ্টি সভ্যতা সংস্কৃতি ধর্মীয় রীতি নীতি অনুশাসনের নিয়ম নীতির স্বাভাবিক গতির মাধ্যমে। আজ আমাদের জীবনের সুস্থ স্বাভাবিক ছন্দময় গতি প্রকৃতিতে ভর করছে বহুমাত্রিক অশুভ গতি। যা আমাদের সুন্দর জীবনকে ভয়ংকর সর্বনাশা ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির কিছু কিছু ক্ষেত্রের অপব্যবহারে আমাদের সুস্থ জীবনধারাকে করছে কূলষিত। ইন্টারনেট, উন্মুক্ত আগ্রাসী বিজাতীয় অপ-আকাশ সংস্কৃতির গতি আমাদের জীবনকে নোংরা অশ্লীলতায় ভাসিয়ে দিচ্ছে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও জাতিকে নিয়ে যাচ্ছে সামাজিক, মানবিক মূল্যবোধ, নৈতিক, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের দ্বারপ্রান্তে। আমাদের দেশজ ও নিজস্ব সভ্য কৃষ্টি সভ্যতা আর সংস্কৃতি মার খাচ্ছে উগ্র গতির তথাকথিত উদারমনা, অবাধ স্বাধীনতা, প্রগতিশীলতা, অপসংস্কৃতির উত্থানের কাছে। ফলে বাড়ছে নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা, অশ্লীলতা, মাদকাসক্তি, যৌন বিকৃতি, পরকীয়া, যৌন হয়রানি, হেনেস্তা, শিশু নারী শিশু নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, খুন, হত্যা, নারীদেরকে ব্ল্যাক-মেইলিং ও চরিত্র হননের মতো নির্মম নিকৃষ্ট পৈশাচিক মর্মন্তুদ বিভিন্ন ঘটনাগুলো প্রতিনিয়ত। শ্রদ্ধার আসনে আসীন শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার সহ সকল শ্রেণী পেশার মানুষের অশ্লীল, নোংরা, লোলুপ কামনা বাসনার দৃষ্টি আজ নিন্দনীয় কুলষিত অসভ্যতা আর অশ্লীলতার দ্বারপ্রান্তে এসে ঠেকেছে। সবধরনের অবক্ষয় ভর করে আছে সমাজের সর্বক্ষেত্রে। অশিক্ষিত বা অর্ধ শিক্ষিত, প্রভাবশালী, মাস্তান, দুর্ধর্ষ মানুষেরদের সাদা কালো টাকার গতির কাছে সুস্থ স্বাভাবিক আর ভালো মানুষের রাজনীতি আজ তার গতিপথ হারিয়েছে। হয়েছে কক্ষচ্যুত।
সুস্থ যথাযথ নিয়মে অর্থ বা মুনাফা করার পরিবর্তে ব্যবসায়ীরা নিয়ম কানুন রীতি নীতি তোয়াক্কা না করে দ্রুত গতিতে বা শর্টকাট পদ্ধতিতে ধনী বা বড়লোক হওয়ার জন্য সততা , মানবিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা, ন্যায়নিষ্ঠা, ধর্মীয় রীতিনীতি বিসর্জন দিচ্ছে। খাদ্যে, ঔষধে, ভেজাল করছে। বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত করছে, মজুদদারী করছে, খাদ্য পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি করছে। দেশের বিভিন্ন পদে আসীন কর্মকর্তা কর্মচারীরাও আজ তাঁদের উপর ন্যস্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য সততা ন্যায়নিষ্ঠা যথাযথ নিয়মনীতি মেনে দেশের উন্নয়নের পরিবর্তে স্পীডমানির স্পীডে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। অর্থ আত্মসাৎ করছে, সঠিকভাবে কাজ না করেও সরকারি কোষাগার থেকে বিল পরিশোধ করছে অন্যায় অনৈতিক সুযোগ সুবিধা নিয়ে। দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন অশুভ অসুস্থ অন্যায় অবিচারের প্রতিযোগিতা করছে অনেকেই। যে যা বলিস ভাই আমার সোমার হরিণ চাই ! এই ব্রত নিয়ে দেশ জাতি আর আর্থ মানবতার সেবার পরিবর্তে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের অশুভ অনৈতিক অমানবিক পথে দ্রুত গতির মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের ধান্ধায় বুঁদ হয়ে আছে অনেকেই। আসুন আমরা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে অন্যায় অবিচার অনৈতিক নীতিহীন অসুস্থ অস্বাভাবিক অনভিপ্রেত আর অনাকাঙ্ক্ষিত গতির লাগাম টেনে ধরি। পাশাপাশি আমাদের আগামী প্রজন্ম আমাদের এই অশুভ গতির পরিণতির অবক্ষয় আর বিপর্যয়ের জন্য কোনদিন ক্ষমা করবেনা। আসুন সভ্য সুখী সুন্দর সুস্থ দেশজ কৃষ্টি সংস্কৃতি বিকাশ আর প্রসার এবং নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সততা ন্যায়নিষ্ঠার সাথে পালন করি পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি শোষণ, ক্ষুধা আর দারিদ্র মুক্ত প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলি। অন্যথায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নিহত ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর ইজ্জৎ হারানো দুই লক্ষ মা বোনের ত্যাগের প্রতি অন্যায় আর উপহাস করা হবে।
১২টি মন্তব্য
হালিমা আক্তার
চমৎকার পোস্ট। আমরা ছুটছি তো ছুটছি। কোথায় ছুটছি, কি আমাদের লক্ষ্য, তা আমাদের অনেকটাই জানা নেই। আর তাই ছুটে চলার শেষ হয় না। এভাবে ছুটতে ছুটতে আমরা নিজেদের বিবেক বুদ্ধি সব ধ্বংস করে দিচ্ছি।
ছুটে চলা শেষ হোক। সুন্দর পৃথিবী গড়ে উঠুক। শুভ কামনা রইলো।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আপনার যুক্তিপূর্ণ মতামতের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ আপু। “ছুটে চলা শেষ হোক। সুন্দর পৃথিবী গড়ে উঠুক” — আপনার সঙ্গে একমত। শুভ কামনা রইলো।
রোকসানা খন্দকার রুকু
সবকিছুর একটা নির্দিষ্টতা থাকা উচিত বলে আমি মনে করি। কে শোনে কার কথা আজকাল দুটো কথা বলার জন্য ডেকেও কাউকে পাওয়া যায়না। বরং বিরক্ত হয়। কেন যে আমরা ছুটছি দুদিনের দুনিয়ায় নিজেও জানিনা॥
ধন্যবাদ ভাই
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আপনার গুরুত্বপূর্ণ মতামতের জন্য অশেষ ধন্যবাদ। আপনি ঠিক বলেছেন আপু — “কেন যে আমরা ছুটছি দুদিনের দুনিয়ায় নিজেও জানিনা”॥ আসলেই জানিনা আমাদের গন্তব্য কোথায়। শুভ কামনা রইলো।
বোরহানুল ইসলাম লিটন
সুন্দর সমাপ্তি।
দুনিয়াটাই আজ চলছে দৌড়ের উপর।
আন্তরিক শুভ কামনা জানবেন।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আপনার মতামতের জন্য ধন্যবাদ।
মনির হোসেন মমি
ধর্মান্ধে ছেয়ে গেছে এ দেশটা।মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন এবং ৭২ এর সংবিধানে ধর্ম নিরপক্ষ রাস্ট্র ছিলো ক্ষতিটা করে গেছে স্বৈরশাসক এরশাদ।সব চেয়ে বড় ক্ষতি করে গেছেন জিয়াউর রহমান।বহুদলীও গণতন্ত্রের নামে যুদ্ধাপরাধী জামাতের রাজনিতীর বৈধতা দিয়ে।যার কারনে দিনে দিনে সাম্প্রদায়ীক শক্তি বিস্তার লাভ করে।
এখন অসম্ভব এ সব সাম্প্রদায়ীক হামলা হতে রক্ষা পাওয়া তবে হ্যা যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে ধর্মকে রাজনিতীতে ব্যবহার করা যাবে না তবে এর প্রতিরোধ করা যাবে নচেৎ সব নষ্টদের দখলেই থাকবে।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাই।
ছাইরাছ হেলাল
লাগাম টানতে হবে জানি এবং বুঝিও কিন্তু লাগাম যে কার হাতে তা তো ঠিক বুঝতে পারছি না,
শুধুই ছুটছি আর ছুটছি, হন্যে হচ্ছি! কোথায় থামতে হবে বা গতির লাগাম টানতে হবে বুঝতে পারছি না।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
চমৎকার মতামতের জন্য অশেষ ধন্যবাদ ভাইয়া।
অনন্য অর্ণব
মানুষ ছুটছেতো ছুটছেই – থামার কোন গন্তব্য তার ডায়েরিতে লেখা নেই। অথচ মৃত্যু আমাদের কত নিকটে। আহা যদি একবার মৃত্যুর কথা ভাবি তবে শরীর হিম হয়ে আসে।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
মতামতের জন্য অশেষ ধন্যবাদ।