জীবনযুদ্ধের অনুপ্রেরণা

রিমি রুম্মান ২২ ডিসেম্বর ২০১৮, শনিবার, ০৪:৩৮:৪৮পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ১৫ মন্তব্য

ছোট্ট একটি অভিজ্ঞতা। হেমন্তের এক নরম সোনালি রোদের দুপুর। নিউইয়র্কের ব্যস্ততম উড হেভেন বুলেভার্ডের প্রশস্ত সড়ক ধরে যাচ্ছিলাম। গাড়ির যাত্রীর আসনে বসা আমি। রেড লাইটে গাড়িগুলো থেমেছে সবে। সূর্যের কিরণে চোখ মেলে তাকানো যাচ্ছিল না। রোদ চশমা চোখে দিয়ে ডানে তাকাতেই পাশের গাড়ির চালকের দিকে চোখ পড়ল। তিনি একজন নারী। পাশের আসনে একজন পুরুষ, আর পেছনে শিশুরা। সম্ভবত সপরিবারে কোথাও যাচ্ছেন তাঁরা। কৃষ্ণবর্ণের নারীটি ছাপার সুতি শাড়ি পরিহিতা। তেল চপচপে মাথায় কপাল থেকে মাঝ বরাবর সরলরেখার মতো সিঁথি করে বাঁধা চুল। চেহারায় কোনো সাজ নেই, নেই পোশাকেও কোনো আধুনিকতা কিংবা আভিজাত্য। যদি সে নারী বাংলাদেশি হয়ে থাকেন, তবে তিনি একেবারেই প্রান্তিক মানুষ হবেন, আমার বিশ্বাস। আমি সামনে তাকাই। আবারও ঘাড় ঘুরিয়ে ডানে তাকাই। দৃশ্যটি আমায় এমনভাবে নাড়া দিয়ে যায়, আমার মনে হতে থাকে—এমন একজন নারী নিউইয়র্কের ব্যস্ততম রাস্তায় গাড়ি চালাতে পারলে আমি কেন নই?

ওই ঘটনার কয়েক দিন পর স্বামীর কাছে ড্রাইভিং শেখার আগ্রহ প্রকাশ করলাম। তিনি দুই দিন অ্যাস্টোরিয়ায় নিরিবিলি, প্রায় জনমানবহীন এক রাস্তায় শেখালেনও। অতঃপর এমন প্রতিক্রিয়া দেখালেন যেন, আমার দ্বারা এটি প্রায় অসম্ভব এক বিষয়। বললেন, ‘কিছু মনে করিও না, তুমি তো মানুষ মারি ফেলবা, দুর্ঘটনা ঘটিয়ে আমার ইনস্যুরেন্সের বারোটা বাজাবা, তার চেয়ে ঢের ভালো ড্রাইভিং স্কুলেই শিখো’। পাহাড়সম ভয় বুকে পুষে ভর্তি হলাম ড্রাইভিং স্কুলে। গাড়ি চালানো শিখলাম। অথচ গভীর দুঃখ ও লজ্জার সঙ্গে বলতে হচ্ছে, আজন্ম ভিতু এই নিরীহ আমি ছোটবেলায় ছোট ভাইয়ের হাতে মার খেতাম কারণে–অকারণে। আব্বা প্রায়ই বলতেন, ‘তুই হইলি বড়বোন, তুই ক্যান মাইর খাস! একটা মারলে বিনিময়ে দুইটা মারবি।’ কিন্তু আমার ধারণা, আমি না হয় মারলাম, কিন্তু বিনিময়ে সে তো আবারও মারবে দ্বিগুণ সাহসে, তার চেয়ে বরং ধৈর্য ধরে চুপ থাকাই ভালো, না-হয় কিছু ব্যথা কষ্ট করে হজমই করলাম, তাতে কী!’ সেই আমি একদিন নিউইয়র্কের জ্যামাইকায় গাড়ি চালানোর পরীক্ষা দিতে যাই। সেই দিন ছিল কনকনে শীতের সকাল। দুরুদুরু বুকে গাড়িতে অপেক্ষা করছি। পরীক্ষক বসলেন পাশের আসনে। বিশালাকৃতির কৃষ্ণাঙ্গ নারী। আমি ‘গুড মর্নিং’, ‘হাই’, ‘হাউ আর ইউ’ জাতীয় কিছু বললাম সাহস সঞ্চয় করে। তিনি নিরুত্তর, গম্ভীর হয়ে কিছু লিখছেন কাগজে।

ভারী জ্যাকেটের ভেতর আমি ঘেমে নেয়ে একাকার। অন্তরাত্মা শুকিয়ে কাঠ। শুধু বললেন, সামনে যাও। ভালোয় ভালোয় তাঁর কথা মতো ডানে গেলাম, বাঁয়ে গেলাম, ব্রোকেন ইউ টার্ন, প্যারালাল পার্কিং করলাম। ভাবলাম সবই তো সম্পন্ন হল। পাস করে যাচ্ছি এই ভেবে ভেতরে কিঞ্চিৎ আনন্দও খেলে গেল। ভাবনার মাঝে কানে এল পরীক্ষকের গমগমে কণ্ঠস্বর, ‘মেইক আ লেফট অ্যান্ড পুল ওভার’। খুব ধীরে বাঁয়ে টার্ন নিচ্ছিলাম। অমনি বাঁ পাস দিয়ে শাঁ করে আমায় পাস কাটিয়ে দ্রুত গতিতে চলে গেল একটি গাড়ি। কৃষ্ণাঙ্গ পরীক্ষক উচ্চ স্বরে বলে উঠলেন, ‘স্টপ স্টপ!’ ব্যাস, সে যাত্রায় ফেল। ভয়ে পরে গাড়ি চালানোর ইচ্ছাকে মাটি চাপা দিয়ে রাখলাম। মনে হল, আমাকে দিয়ে হবে না। এ বড় কঠিন কাজ।

দীর্ঘ প্রায় এক বছর পর মে মাসের চমৎকার এক বিকেল। শেষ বিকেলের ম্রিয়মাণ কমলা আলো তখন প্রকাণ্ড সব গাছের মগডালে চিকচিক করছিল। হাঁটছিলাম বাড়ির সামনের ঢালু রাস্তা বেয়ে। এখানে–ওখানে কিছু পাখি ডাকছিল। অতিথি পাখি হবে হয়তো। প্রতিটি বাড়ির সামনের গাছগুলোয় প্রস্ফুটিত নানা রঙের ফুল। মন মাতানো সৌরভ আর পরম মুগ্ধতায় ছেয়ে আছে মনপ্রাণ, চারপাশ। কোনো কারণ ছাড়াই আমার আচমকা সেই নারীর মুখচ্ছবি ভেসে উঠে মানসপটে। এই যান্ত্রিক শহরে ব্যস্ততার মাঝে রোজ কত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় বেলা–অবেলায়, অথচ কারও মুখচ্ছবি আমার মনে থাকে না, মনে পড়ে না। কিন্তু কেন সেই নারীকে? আমি কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে ছোট্ট শ্বাস নেই। মুখে দুই হাত বুলাই মোনাজাতের ভঙ্গিতে। মাথার ওপরে গাছের ডালে ডেকে-ওঠা পাখির দিকে তাকাই। আমার আবারও মনে হলো, ‘আমি কেন নই?’ মনে মনে আমি আবারও রোড টেস্ট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।

নির্দিষ্ট দিনে আমার ড্রাইভিং স্কুলের ইনস্ট্রাক্টর আমাদের দুজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে রওনা হন জ্যামাইকার পরীক্ষাস্থলের উদ্দেশ্যে। পুরোটা পথজুড়ে আমার সঙ্গের শিক্ষার্থী তরুণ অনর্গল বলে চলেছেন, ‘ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য পরীক্ষা দেওয়া কোনো ব্যাপার হল! কেন যে মানুষ বারবার ফেল করে!’ আমি তাঁর কথা শুনে উজ্জীবিত হই, মনে সাহস পাই, আত্মবিশ্বাস বাড়ে। প্রথমেই তাঁর রোড টেস্টের পালা। আমরা রাস্তার একপাশে অন্য সবার সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। পরীক্ষক তাঁর গাড়িতে উঠে বসেন। তরুণ উজ্জ্বল হাসি হাসি হয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলেন। গতি বাড়ালেন। আমরা গভীর মনোযোগে তাকিয়ে আছি সেই পথের দিকে। দেখলাম তিনি ওয়ান ওয়ে রাস্তায় চলে গেলেন অনেকটাই! ভাগ্যিস বিপরীতমুখী কোনো গাড়ি আসেনি সেই সময়ে! নইলে নির্ঘাত দুর্ঘটনা ঘটে চিৎপটাং হতেন। নিমেষেই ফিরে এল গাড়িটি। তিনি নেমে এলেন মুখ আঁধার করে। মানুষের এসব মন খারাপ আমার মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে প্রায়শই। ভয় আর আশঙ্কায় এবার আমার পালা। সব ভয়কে জয় করে সেবার আমি ভালোভাবেই উতরে যাই।

এসব আজ থেকে ১৫ বছর আগের ঘটনা। মাঝে মধ্যেই আমি যখন সপরিবারে ড্রাইভ করে কোথাও বেড়াতে যাই, পাশের আসনে বর, পেছনের আসনে বাচ্চারা ও তাঁদের দাদু বসেন। তাঁরা সবাই যখন নানান বিষয়ে গল্পে মশগুল থাকে, সেই সময়টায় আমার একজন নারীকে খুব মনে পড়ে। মাথার মাঝখান বরাবর সরলরেখার মতো সিঁথি করে চুল বাঁধা। খুব সাধারণ অথচ বড় বেশি অসাধারণ। আমরা আশপাশের কত কী দেখেই না অনুপ্রাণিত হই!

এবার আসি লেখালেখির বিষয়ে।
ছোটবেলায় যখন ছন্দ মিলিয়ে ছড়া লিখতাম, লুকিয়ে রাখতাম, ভয়ে। অপমানিত হওয়ার ভয়ে। কেউ দেখলে ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ কিংবা তাচ্ছিল্য করবে, হাসাহাসি করবে। যেচে কারও হাসির পাত্র হতে কে চায়? এই বিদেশের বাড়িতে বসেও বিগত বছরগুলোয় লিখে গেছি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। আমার কেন যেন মনে হয়, যারা লিখতে ভালোবাসেন, তাঁদের ভেতরের এই ইচ্ছেটা সময় সুযোগ পেলেই প্রকট হয়ে ওঠে এবং তা একরকম নেশার মতো। অগণিত লেখা, অসংখ্য অনুভূতি কাগজে পুরে জমিয়ে রেখেছিলাম ড্রয়ারে। অতঃপর একদিন ধুলো জমা সেই সব লেখা, আমার অনুভূতির সব অক্ষর, ফেলে দিয়ে আসতাম গারবেজ ক্যানে।
একদিন কর্মক্ষেত্রে সোফিয়া নামের স্প্যানিশ সহকর্মীর কাছ থেকে ধার চেয়ে লাঞ্চ ব্রেকের সময়ে পড়লাম হেলেন কেলারের ‘দ্য স্টোরি অব মাই লাইফ’। হেলেন একজন বিস্ময়কর সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ ছিলেন। আমেরিকায় জন্ম হলেও তিনি পুরো বিশ্বে পরিচিত ছিলেন এ কারণে যে, তিনি জীবনসংগ্রামে সব বাধার বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই করে সফল হয়েছিলেন। তিনি বিস্ময়কর এ কারণে যে, মাত্র ১৯ মাস বয়সে যিনি মেনিনজাইটিস অথবা স্কারলেট ফিবারে আক্রান্ত হয়ে একাধারে বাক্‌শক্তি, শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। যদিও দশ বছর বয়সে চিকিৎসার মাধ্যমে তিনি বাক্‌শক্তি ফিরে পান। এসব প্রতিবন্ধকতাকে সঙ্গী করে ক্রমাগত সংগ্রাম চালিয়ে যান তিনি। এন সুলিভান নামের একজন প্রশিক্ষক হেলেন কেলারের শিক্ষার দায়িত্ব নেন। যদিও এটি ছিল কঠিন এক দায়িত্ব। কিন্তু তিনি নিষ্ঠার সঙ্গেই তা পালন করেন। তিনি সার্বক্ষণিক পাশে থেকে হেলেনের লেখা অনুবাদ করে দিতেন এবং পাঠ তৈরিতে সহায়তা করতেন। হেলেন যেকোনো কথা হাতে উচ্চারণ করে বোঝাতেন। একের পর এক অভিজ্ঞতার কথা লিখে শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি প্রতিবন্ধী হেলেন চমকে দেন সারা পৃথিবীকে। ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম নেওয়া এই নারী ১৯০২ সালে লেডিজ হোম জার্নালে লেখালেখি শুরু করেন এবং ‘দ্য স্টোরি অব মাই লাইফ’ শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেন নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা। ১৯০৮ সালে প্রকাশ করেন ‘দ্য ওয়ার্ল্ড আই লিভ ইন’। বইটিতে তিনি ব্যক্ত করে গেছেন মানুষের জীবনে স্বাদ, স্পর্শ ও গন্ধের ভূমিকা। খ্যাতি, সম্মান, পুরস্কার অর্জন সবই পেয়েছেন তিনি। ১৯৬৮ সালে ৮৮ বছর বয়সে এই মহীয়সী নারী পরলোক গমন করেন।

সব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও মানুষের এসব জীবনযুদ্ধ আমাকে অনুপ্রাণিত করে খুব। মনে হয়, কে কী ভাবল, কে কী বলল—তা নিয়ে মন খারাপ না করে যার ভেতরে ন্যূনতম যেটুকু প্রতিভা আছে, সেই সঙ্গে নিজের চেষ্টা এবং আগ্রহটুকু কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাক সকলে। স্রষ্টা তো আর সবাইকে দুই হাত উজাড় করে দেন না। জগতের কাউকে কাউকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দেন। তবে জীবনে যা কিছুই ঘটুক না কেন, তাতে আমাদের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে যদি আমরা ধৈর্যের পরিচয় দিই।

রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

0 Shares

১৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ