জিনান কি সত্যিই পরী দেখেছিলো

ইসমাইল জসীম ২৮ নভেম্বর ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১০:৪৮:২৩পূর্বাহ্ন গল্প ১০ মন্তব্য

ছোটবেলা থেকে জিনান পরীদের কথা শুনে আসছিলো তার মা ও দাদু-নানুর কাছে। পরি নিয়ে কতো গল্প পড়েছে সে গল্পের বইয়ে। বাবা দেশে থাকলে জিনাকে তো পরীরানীর গল্প বলেই বলেই ঘুম পাড়াতো। লালপরী, নীলপরী, ফুলপরী, পরীরানীসহ আরো কত পরীর গল্প। জিনান এখনো ছোট । সবে তৃতীয় শ্রেণিতে উঠলো।
বাবা থাকেন দেশের বাইরে । জিনানের অনেক দিনের স্বপ্ন সে পরী দেখবে। সে শুনেছে পরীরা নাকি আরব দেশে থাকে। তারা আরবীতে কথা বলে, আরবী পোষাক পরে। জিনানের বাবা প্রতিবছর ছুটিতে আসেন ফেব্রুয়ারি মার্চে। স্কুল ছুটি থাকে সে সময় । আব্বুর কাছ থেকে পরীদের নিয়ে অনেক অনেক গল্প শোনা যায়। তাছাড়া সে সময় থাকে বইমেলার সময়। বাবাতো বইমেলায় নিয়ে যাবেনই । জিনানেরও সুযোগ হয় বইমেলা থেকে বিভিন্ন রকম পরীর গল্পের বই কেনার। বই পড়ে পড়ে শুধু পরীদের নিয়ে কল্পনা করা যায়, পরীদের নিয়ে স্বপ্ন দেখা যায়। জিনান তার বাবা জিজ্ঞেস করে-
আচ্ছা বাবা তুমি কি পরীরদেশে থাকো? ওখানে কি পরী দেখা যায়? এরা দেখতে কেমন? ওদের কি ডানা আছে?
বাবা জবাব দেয় , হুম ওখানে অনেক পরী। তবে ওখানে পরীরা কালো পোষাক পরে,
ওমা এরা আবার কেমন পরী? পরীরা আবার কালো হয় নাকি?
হয়রে মা, হয়। ওখানে লালপরী, সাদাপরী, সবুজপরীরাও আছে তবে এরা সবাই বাচ্ছা পরী। বড়রা হয় কালোপরী। বাচ্ছারা একটু বড় হলেই কালো পোষাক পরে। এরা মুখ ঢেকে রাখে যেন বাইরের লোকেরা দেখতে না পায়। এসব কথা শুনে জিনানের পরীরদেশে যাবার আগ্রহটা আরো বেড়ে গেলো। জিনান কিন্তু এবার সত্যি সত্যিই পরী দেখতে চায়। বাবা আসলে প্রতিবারই জিনান বায়না ধরে তাকে আব্বুর সাথে সৌদিআরব যাবার। কিনতু এবার সে নাছোড় বান্দা। জেদ ধরেছে বাবার সাথে যাবেই যাবে।
জিনানের আম্মুও বললো এবার না গেলে আর যাওয়া হবে না। আগামি বছর মেয়ে চতুর্থ শ্রণিতে উঠবে। প্রস্তুতি নিতে হবে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তির। স্কুল, ভর্তি কোচিং, গৃহশিক্ষক এসব কিছু মিলে আর সময় হবে না।পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে গেলেতো প্রশ্নই আসে না।
বায়না ধরলেই কি বাবার সাথে যাওয়া যায়? বিদেশ যেতে হলে একটা প্রস্তুতি দরকার আছে না? পাসপোর্ট বানাতে হবে। ভিসার জন্য দরখাস্ত করতে হবে আরো কতো অফিসিয়াল কাজ। এসব কিছু কাজ সম্পন্ন করেই না যেতে পারবে। জিনান ছোট হলেও এব কিছু বুঝে সে । কারণ সে দেখেছে তার বাবা বিদেশে আসা যাওয়ার সময় পাসপোর্ট হাতে নিয়ে যায় । বিদেশে যাওয়ার কথা শুনে সিয়ামের কিন্ত আর তর সইছে না। আম্মুকে তাড়া দিতে লাগলো পাসপোর্ট বানানোর জন্য। ‘ আম্মু চলো না আমাদের পাসপোর্ট করে নিয়ে আসি’। সিয়াম জিনানের একমাত্র ছোট ভাই। খুব আদর করে সে তার ছোটভাইকে । স্কুল থেকে আসার সময় তার জন্য কুকুমু নিয়ে আসতে্ই হবে। কুকুমু তার বেশ পছন্দের। স্কুল ছুটির পর জিনান প্রতিদিন সিয়ামকে পরীদের গল্প শোনায় ।

পাসপোর্ট ভিসা হাতে পেয়ে জিনানের সেই রাতে আর ঘুম আসতে চাচ্ছে না। কেবল কল্পনা করছে। কখনে যাবে ? কবে দেখবে পরীর পাহাড়? পরীরদেশ? পরীদের সাথে কীভাবে কথা বলবে? এসব কল্পনা করতে করতে একসময় ঘুম নেমে এসে যায় তার চোখে। জিনান ঘুমের মধ্যে দেখলো একটি ফুটফুটে বাচ্ছা পরী তাকে ডাকছে। বলছে, ‘আস। তাড়াতাড়ি আস আমাদের দেশে। আমরা তোমাকে অনেক আদর করবো, অনেক খেলনা দেবো, অনেক চকোলেট দেবো, অনেক ফুল দেবো। অনেক মজা হবে’।
বিদেশ যাবার কথা ভেবে জিনানের আম্মু কিন্তু খুব ভয় পাচ্ছে। কীভাবে যাবে ? একা একজন মেয়ে মানুষ সাথে ছোট ছোট বাচ্ছা। জিনান কিন্তু মোটেও ভয় পাচ্ছে না। সে তার আম্মুকে বলছে, ‘আম্মু ভয় কিসের? আমরা বিমান করেই তো যাবো । এদিকে বিমানে উঠলেই তো সে বিমানে পরীর দেশ। আর সেখানেতো বাবা থাকছেনই’।


সময়টা ছিলো সকালবেলা । রমজান মাস। সূর্যটা কেবল তাপ দিতে শুরু করেছে। আরব দেশ মানে মরুভূমির দেশ। এখানে সূর্যের তাপমাত্রা থাকে অন্য দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। লোকের চেয়ে গাড়ির সংখ্যা অধিক । তাই স্বাভাবিকভাবে এ শহরের হাইওয়েগুলো থাকে সবসময় ব্যস্ত। গাড়িগুলো চলে প্রচণ্ডগতিতে। কিন্তু আজ রাস্তাঘাট কেবল ফাঁকা ফাঁকা। কারণ রমজান মাস। রমজান মাসে এরা দিনের বেলায় তেমন বের হয় না। বেরুই রাত্রিবেলা। অফিসিয়াল কাজকর্মও দিনের বেলায় তেমন হয় না। এরা রাতজাগা পাখি। দোকান পাঠ খুলে জোহরের নামাজের পরে। তাই কেমন জানি নিরব শহরে এসে পড়েছে জিনান। কয়েক সেকেন্ড পর পর শোনা যাচ্ছে কেবল প্রচণ্ডগতিতে চলা গাড়িগুলোর শোঁ শোঁ শব্দ।
বাবার সাথে জিনানদের নিতে এসেছিলো সাইফ আঙ্কেল। তাকে জিনান ছোটবেলায় একবার দেখেছিলো। তেমন মনে নেই। সাইফ আঙ্কেল ইঙ্গিত করলো সামনে দাঁড়ানো একটি সবুজ রঙের মারসিটিস কারের দিকে। গাড়িটি দেখে জিনানের মনে পড়ে গেলো একটি গল্পের কথা। সে একটি গল্প পড়েছিলো লাল নীল সবুজ পরীর গল্প। গাড়িটি ঠিক সেই সবুজপরীর গাড়িটির মতো। সবুজপরীদের নাকি সবকিছু সবুজ হয়। তাদের গাড়ি, বাড়ি, পোষাক পরিচ্ছদ, খাবার দাবার সবকিছুই সবুজ আর সবুজ। জিনানরা সবাই গাড়িতে চেপে বসলো। গাড়িতে বসে জিনান জানালার কাঁচের ভেতর থেকে দেখছে পরীর শহরটাকে। কিন্তু তার কাছে সবকিছু যেন এলোমেলো মনে হতে লাগলো। একি গাড়িগুলো উল্টো চলছে কেনো! আমাদের দেশে গাড়িগুলো চলে ডানহাতি আর এখানে বাঁহাতি। জিনানকে আম্মু শিখিয়ে দিয়েছিলো স্কুলে যাবার সময় কখনো রাস্তা পার হতে হলে ডানদিকে দেখবে কোন গাড়ি আসছে কিনা । কোন গাড়ি না দেখলে তারপর রাস্তা পার হবে। এখানে তো দেখি গাড়িগুলো সব বাম দিক থেকে। জিনান ভাবতে লাগলো । কারো কাছে কিছু জিজ্ঞেসও করছে না। কিন্তু জিনানের মনে পড়ে গেলো পরীদের দেশে নাকি সবকিছু বাম দিক থেকে হয় । তাদের ভাষা আরবি, তারা লিখে বাম দিক থেকে ডান দিকে। তাই গাড়িও হয়তো এরা বাঁহাতি চালায়।

৩.
অফিস করে ফিরতে ফিরতে জিনানের বাবার বেশ দেরি হয়ে গেলো । বাসার দরজা খুলতেই দেখে জিনান আর সিয়াম ল্যাপটপ নিয়ে বসা? মা ভেতরে ঘুমুচ্ছে। জার্নিতে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো সে। রাত তখন দু’টা। তিনটায় আবার সেহেরি খেতে উঠতে হবে।
কী মামনিরা তোমরা ঘুমাও নি?
না বাবা আমাদের ঘুম আসছে না। তাছাড়া গুগলে খোঁজ নিয়ে দেখছি এখানে কোথায় কোথায় কোন পরী দেখতে পাওয়া যায়।
হা হা হা হা । জিনানের বাবা হাসলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললো? গুগলে খোঁজ নিলে কি এদের পাওয়া যাবে? এরা কি গুগল ব্যবহার করে?
কেন ? এরা কি লেখাপড়া করে না? নাকি এদের ইন্টারনেট নেই ? এরা গুগলে থাকবে না কেন?
করে। তবে তাদের নেটওয়ার্ক আলাদা। আমরা তাদের নেটওয়ার্কে প্রবেশ করতে পারি না। যাক ওসব কথা তোমাদের কিন্তু কালকেই পরী দেখাতে নিয়ে যাবো । চলো এখন ঘুমিয়ে পড়ি।
না বাবা আমরা এখন ঘুমাবো না। ঘুমালে সেহেরি খেতে পারবো না। সেহেরি খেয়ে ঘুমাবো।
ঠিক আছে তাহলে আমরা গুগলে খোঁজ নিয়ে দেখি কাল কোথায় কোথায় যেতে পারি।

৪.
পরের দিন ছিলো ছুটির দিন । জিনানের আব্বু ঠিক করলো আজ ইফতারির পর সবাইকে নিয়ে একটি পার্কে যাবে। পরীর পার্ক। ওখানে প্রতি বিষ্যুদবার পরীরা আসে খেলা করতে। লালপরী, নীলপরী, সাদাপরী। কালোপরীরাও আসে বাচ্ছাপরীদের তদারকি করার জন্য। পার্কের পাশেই রয়েছে একটি অর্টিজম স্কুল। এটিকে সবাই বলে পরীর স্কুল । জিনানদের নিয়ে তার বাবা আগে ভাগে হাজির পার্কে। জিনান বেশ উৎসুক। কখন পরীরা আসবে ? কীভাবে আসবে? তাদের সাথে কথা বলতে পারবে তো!
জিনান দোলনায় চেপে দোল খাচ্ছিলো। হঠাৎ দেখে এক সাদাপরী তার পাশের দোলনায় দোল খাচ্ছে। পেছন ফিরে দেখে আরেকজন তাকে দোল দিচ্ছে। যেখানে এতোক্ষণ সিয়াম তাকে দোল দিচ্ছিল। জিনান বিশ্বাস করতে পারছে না। সত্যি সত্যিই কি পরীরা জিনানকে দোল দিচ্ছে? সিয়ামকে দেখি আহমেদ তা’ল বলে আরেকজনে ডেকে নিয়ে গেলো দোল দিতে । এ কী! জিনান অবাক হয়ে যাচ্ছে। একে একে পুরো পার্ক ভরে গেলো পরী আর পরীতে । জিনান এতো পরী একসাথে কল্পনাও করেনি। যেমনটি পড়েছে গল্পের বইতে । লালপরী, নীলপরী, সবুজপরী সাদাপরী। কেউ কেউ কেবল হাসছে, কেউ কেউ কথা বলছে, কেউ কেউ উড়ছে হাওয়ায়, আবার কেউ কেউ বসে আছে হুইল চেয়ারে। পার্কের চার পাশ ঘিরে আছে কালোপরীরা। এরা বুঝি মা পরী। জিনান এদের সাথে মিশতে গিয়ে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলো মা বাবার কথা। সবপরী আজ একসাথে।

0 Shares

১০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ