কংক্রিটের তৈরী উঠোনটিতে কলনীর ছোট ছেলেমেয়েরা এসে খেলা করত। ওদের খেলনাগুলো ছিল অনেক দামীয় ও দেখতে সুন্দর। কলনীর কাছাকাছি একযায়গায় ছিল দরিদ্র মানুষের ছোট একটি বস্তী। সেখানে থাকত তুলি নামের ছোট্ট একটি মেয়ে। তুলির গায়ের জামাকাপড় থাকত ছেড়া আর ময়লা। আর কলনীর ছেলেমেয়ের গায়ের জামাকাপড় থাকত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। এমনকি সূর্যের আলোয় নকশাগুলো চকচক করত। সে কারনে তুলি কখনই কলনীর ছেলেমেদের সাথে খেলতে যেতনা। তুলি ছিল ছোট, তবুও ও বুঝত ময়লা জামাকাপড় পরে কলনীর ধনী ছেলেমেদের সাথে খেলতে যাওয়া মানায়না।
**********************************
তুলির মা ঐ কলনীতে সকাল বিকাল বিভিন্ন প্রকার ঘরোয়া কাজ করতে যেত। কলনীতে যাদের জামাকাপড় ময়লা হয়ে যেত, তাদের জামাকাপড়গুলো ধুয়ে পরিস্কার করত, রোদে শুকাত তারপর দোকান থেকে স্ত্রি করে আনত। যাদের ঘরের থালাবাসনগুলো খাবার খাওয়ার পর অপরিস্কার অবস্থায় পরে থাকত, সেগুলো ধুয়ে পরিস্কার করে তাকে তাকে সাজিয়ে রাখত। আর ঘরের মেঝেতে ময়লা জমে থাকলে তা কুড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলে আসত। এসব কাজ করে তুলির মা যে টাকা পেত তা দিয়ে তার সংসার কোন মতে চলে যেত।
**********************************
তুলি দেখল একটা লাল রংয়ের খেলনা গাড়ি উঠোন জুড়ে পোঁ পোঁ শব্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারপর উঠোনের শেষ প্রান্তে গিয়ে থেমে যাচ্ছে। আবার পিছন ঘুরে চলতে শুরু করছে। একটা ছেলে রিমোট কন্ট্রোলারের সাহায্যে যেদিকে ইচ্ছা ঘুরাচ্ছে। হঠাৎ শব্দের পরিবর্তন হচ্ছে। কখনো হিন্দি গানের শব্দ আবার কখনো ইংলিশ গানের শব্দ। কখনো কখনো শুধু বাদ্যযন্ত্রের শব্দ। খেলনাটা তুলির পছন্দ হয়ে গেল।
*********************************
সন্ধ্যার পর তুলির মা বস্তিতে ফিরল। তুলি বলল, মা আমাকে একটা গাড়ি কিনে দেবে?
তুলির মা বিস্ময়ে চোখমুখ ছোট করে বলল, কিসের গাড়ি?
তুলি বলল, খেলনা গাড়ি মা।
তুলি মাঝে মাঝে এমন বায়না করে থাকে। তখন ওর মা ধমক দিলে থেমেও যায় সাথে সাথে।
তুলির মা প্রতিবারের মত এবারও ধমক দিয়ে বলল, খেলনা কেনার টাকা নেই। ওসব বাদ দিয়ে লেখাপড়া কর ঠিকমত। কলনীতে তোমার চেয়ে ছোট বাচ্চারাও ইংরেজি দেখে পড়তে পারে আর তুমি অক্ষরগুলোও ঠিকমত চেননা।
তুলি চিৎকার করে বলল, আমাকে খেলনা গাড়ি কিনে না দিলে আমি আর পড়তে বসব না।
তুলির মা আরো রেগে গিয়ে বলল, তোর বাপ কি মারা যাবার সময় লাখ লাখ টাকা রেখে গিয়েছিল যে যখন যা চাইবি দিতে পারব?
তুলি চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল।
তুলির মা বলল, কাঁদবিনা! কলনী থেকে বেতন পেলে কিনে দেব।
তুলি আরো জোড়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল আর বলল, কালকেই কিনে দিতে হবে।
তুলির মা বিরক্ত হয়ে বলল, ঠিক আছে দেব এখন থাম!
মায়ের আশ্বাস পেয়ে কান্না থামিয়ে পড়তে বসল তুলি। বলল, মা আমি এইচ পর্যন্ত না দেখে পড়তে পারি।
তুলির মা বলল, বাকি অক্ষগুলোও মুখস্ত করে ফেল। তুলি খুব উৎসাহের সাথে পড়তে লাগল।
*********************************
রাতে তুলির ঘুম হল না ঠিকমত। ওর চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠছে খেলনা গাড়িটি । তুলি ভাবতে লাগল, খেলনা গাড়িটি পাওয়ার পর কি করবে, কোথায় গিয়ে রিমোটকন্ট্রলারের সাহায্যে চালাবে, আর গাড়িটা থেকে কেমন শব্দ শোনা যাবে এসব। বস্তির একপাশে একটা পানির চাপকল আছে। ওখানে গিয়ে গাড়িটি চালানর কথা ভাবল তুলি। আর ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পরল।
**********************************
সকালে তুলির মা তুলিকে নিয়ে একটি খেলনার দোকানে গেল। দোকানটিতে হাজার হাজার খেলনা সাজান অবস্থায় রয়েছে।
তুলির মা দোকানদারকে একটা খেলনা গাড়ি ইশারা করে বলল, ওই গাড়িটা দেখি।
দোকানদার গাড়িটা তাক থেকে নামিয়ে তুলির মায়ের হাতে দিল।
তুলির মা দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল, দাম কত?
দোকানদার বলল, ৫০ টাকা।
তুলি বলল, এই গাড়িটা না।
তুলির মা বলল, তাহলে কোনটা?
তুলি উপরের তাকে সাজিয়ে রাখা বড় লাল রংয়ের একটা খেলনা গাড়ি ইশারা করে বলল, ওই গাড়িটা মা।
দোকানদার গাড়িটা নামিয়ে তুলির মায়ের কাছে দিল।
তুলির মা হাসি হাসি মুখে বলল, এইটার দাম কত?
দোকানদার বলল, ১১০০ টাকা। খেলনাটির দাম শুনে অবাক হয়ে গেল তুলির মা।
তুলিকে ৫০ টাকা দামের খেলনা গাড়িটি দেখিয়ে বলল, এই গাড়িটা নাও, এটাও দেখতে দারুন সুন্দর।
তুলি ১১০০ টাকা দামের গাড়িটা দেখিয়ে বলল, আমি ওইটা নেব। ওটা রিমোটকন্ট্রলার দিয়ে চালান যায়।
তুলির মা বলল, ওটার দাম অনেক বেশি, কিনতে অনেক টাকা লাগবে। তুমি এইটা নাও।
তুলির মা ৫০ টাকা দামের গাড়িটি এমনভাবে ধরল যাতে গাড়িটি তুলির কাছে সুন্দর বলে মনে হয়।
তুলি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি ওইটা নেব। আমি ওইটা নেব।
তুলির মা নরম গলায় বলল, কিন্তু ওই গাড়িটা ভালনা, পঁচা।
তুলি আরো জোড়ে চিৎকার করে দোকানের মেঝের উপর গড়াগড়ি খেতে শুরু করল।
তুলির মা ওকে কোলে তুলে নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এল। তুলির কান্নার শব্দ আস্তে শোনাতে লাগল। বস্তিতে ফিরে এসে তুলির কান্না থামানর চেষ্টা করতে লাগল তুলির মা।
বলল, চকলেট খাবে, বিস্কুট খাবে?
তুলি চকলেট আর বিস্কুট ছুরে মেরে ফেলে দিল। তুলির মা তখন রেগে গেল আর একটা লাঠি দিয়ে কয়েটা পিটান মারল তুলির পিঠের উপর। তুলি তখন আরো জোড়ে চিৎকার করে উঠোনের ধূলোময়লার মধ্যে গড়াগড়ি খেতে শুরু করল। পাশের ঘর থেকে দুজন লোক ছুটে এল। একজন তুলিকে কোলে নিয়ে শান্তনা দিতে লাগল আরেকজন তুলির মায়ের কাছ থেকে লাঠিটা কেড়ে নিল। তুলি দুপুর পর্যন্ত একটানা কাদল ও চোখদুটো ভয়ংকর ভাবে লাল হয়ে গেল। গোছল করানোর সময় তুলির মা তুলির পিঠের উপর চারটা লাঠির আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেল। কালো রংয়ের চিহ্নগুলো লম্বালম্বিভাবে উপর থেকে নিচে নেমে গেছে। দুপুরে তুলির মা তুলিকে অনেক বুঝিয়ে, আদর করে ভাত খাওয়াল।
কিছুদিনের মধ্যে খেলনা গাড়ির কথা ভুলে গেল তুলি।
**********************************
একদিন ভোর বেলা তুলির মা কলনীতে কাজ করতে আসল। সব কাজ শেষ করে ডাস্টবিনে ময়লা ফেলতে গেল। তুলির মা দেখল, একটা বড় লাল রংয়ের খেলনা গাড়ি ডাস্টবিনে পরে আছে, ভাংগা।
১০টি মন্তব্য
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
গরীব হলেও শিশুটির আবদার ছিল বড় লাল গাড়ী সামর্থ্যের জন্য যা মা কিনে দিতে পারেনি।এমন অনেক আবদার নীরবেই রয়ে যায়। -{@
আবু জাকারিয়া
হ্যা ঠিক বলেছেন। একটি গরিব শিশুর ও আনন্দে বেড়ে ওঠার অধিকার আছে। কিন্তু আমাদের সমাজ থেকে ওরা বঞ্চিত হচ্ছে। ধন্যবাদ।
স্বপ্ন নীলা
রাতে তুলির ঘুম হল না ঠিকমত। ওর চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠছে খেলনা গাড়িটি । তুলি ভাবতে লাগল, খেলনা গাড়িটি পাওয়ার পর কি করবে, কোথায় গিয়ে রিমোটকন্ট্রলারের সাহায্যে চালাবে, আর গাড়িটা থেকে কেমন শব্দ শোনা যাবে এসব। বস্তির একপাশে একটা পানির চাপকল আছে। ওখানে গিয়ে গাড়িটি চালানর কথা ভাবল তুলি। আর ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পরল। —-
একদিন ভোর বেলা তুলির মা কলনীতে কাজ করতে আসল। সব কাজ শেষ করে ডাস্টবিনে ময়লা ফেলতে গেল। তুলির মা দেখল, একটা বড় লাল রংয়ের খেলনা গাড়ি ডাস্টবিনে পরে আছে, ভাংগা।’’
মনটা কেমন যেন করে উঠলো গল্পটা পড়েে——-আমরা তো পারি একটা খেলনা দিতে –হোকনা একটু কম দামী !! একজন শিশুকে দিলেও তা কম কিসে —!!!
আবু জাকারিয়া
এমন অসংখ্য শিশু আছে আমাদের দেশে যাদের শৈশবের ছোট্ট ছোট্ট চাওয়াগুলো অপূর্ন থেকে যায়। মতামতের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
জিসান শা ইকরাম
গল্পটা পড়ে মন বিষন্ন হয়ে উঠলো।
ভালো লিখেছেন।
# শিরোনামে শুধু ” খেলনা ” লিখে, বিভাগ ‘ গল্প’ দিলেই হতো।
আমরা তো পড়েই বুঝবো এটি গল্প।
এটি আমার ব্যক্তিগত ভাবনা, প্রত্যক লেখকের ভিন্ন ভিন্ন ভাবনা আছে। লেখকের ভাবনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল আমি।
শুভ কামনা।
আবু জাকারিয়া
গল্পটা পোস্ট করার পর আমার ও তাই মনে হয়েছে। মতামতের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
প্রহেলিকা
মন্তব্য দেখে বুঝতে পারলাম ভালো লিখেছেন, তবে এই ভালো লেখাটিও পড়িনি, বলতে এসেছি যে আপনার লেখায় আর কখনো মন্তব্য করবো না কারণ আপনার আগের দুটো লেখাতে মন্তব্য করেছিলাম কিন্তু চার অক্ষরের শব্দে একটি ধন্যবাদ দেননি।
ভালো থাকুন, শুভকামনা।
আবু জাকারিয়া
আসলে অনেক ক্ষেত্রে ভেবে পাইনা যে মন্তব্যের কি উত্তর দেব। এরপর আশা করি কোন মন্তব্যের উত্তর বাদ থাকবেনা। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
শুন্য শুন্যালয়
প্রহেলিকা আমার কথাটি বলে দিয়েছে 🙂
যাক এখন থেকে মন্তব্যের উত্তর পাবো জেনে খুশি হলাম, আমার কাছে একজন পাঠকের মন্তব্যও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কেউ চাইলে লেখাটি পড়ে নিঃশব্দে চলে যেতে পারে, কিন্তু লেখকের লেখাটিকে সম্মান জানানোর জন্য যেকোন লাইন তিনি রেখে যান, এটাকে অবশ্যই শ্রদ্ধা করা উচিত।
যাই হোক, লেখাটি পড়েছি এবং ভীষণ ভালো লেগেছে। মনটা কষ্টে ছেয়ে গেছে, লেখার স্বার্থকতা এখানেই। লিখুন আরো অনেক।
আবু জাকারিয়া
অনেক কষ্ট করে লিখি। এমনকি সারা রাত ও কেটে যায় অনেক ক্ষেত্রে। তারপর ও লেখার মধ্যে অনেক ভুল থেকে যায়। এত কষ্ট করে লিখেও যখন দেখি অনেকে মন্তব্য করেছেন, সত্যিই খুব ভাল লাগে। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।