মাস কয়েক হলো শাকের চাকরি পেয়েছে। চট্টগ্রামের হালিশহরের একটি মেসে থাকে।এখনো বিয়ে করা হয়ে উঠেনি।ছোট বোনের বিয়ে দিল গত মাসে।এখন নিজের ঘরে একটা মানুষ চাই।না হয় আর কিছু দিন পর মেয়েরা আঙ্কেল ডাকা শুরু করবে।
নাস্তা সেরে এসব ভাবতে ভাবতে একটা সিগারেট ধরাচ্ছিল দোকান থেকে। হঠাৎ সামনে দিয়ে একটি মহিলা গেল। যেন প্রচন্ড ভূমিকম্পের কবলে পড়েছে,তখন তেমনই লাগছিল মাথার ভিতর! নাকি শরীর খারাপ করেছে? জানেনা সে।শুধু জানে এই মহিলা একদিন তার খুব কাছের একজন ছিল।খুব কাছের।সিগারেটে ফুক দিতে দিতে কত কথাই তখন মনে উঠে আসতে লাগলো।
মানুষের জীবনে কিছু ব্যক্তি আসে,যাদেরকে ধরে রাখতে প্রচণ্ড ইচ্ছে করে।কিন্তু কোন কারনে একবার হারিয়ে ফেললে তাকে আর ফেরত চায় না মন।তখন কিছু মানুষকে চিরতরে ভুলে যাওয়াই উত্তম মনে হয়। সে রকম যদি কেউ ফিরে আসে,তবে তখনই জীবন আবার এলোমেলো লাগে।সব কিছু তুচ্ছ লাগে।এখন যেমন একটু লাগছে।
একদিন এই মেয়েটার;যখন আমার কাছের মানুষ ছিল; নাম ধরে ডাকতে কত ভালো বাসতাম।যখনই ডাকতাম “নীলা,এই নীলা,আরো কাছে এসে বসো”।নীলা বলতো”আরো কাছে? বুকের ভিতর চলে যাই?” নীলা ধীরে ধীরে বুক চিরে একদম আমার সিনার ভিতর চলে গেছে।শিরায় শিরায় তার মায়া ঢুকে গেছে।আমিও নীলার খুব প্রিয় মানুষ হয়ে উঠেছিলাম।নীলা ক্লাসে অনিয়মিত ছিল,কিন্তু পরে ক্লাসের গুরুত্ব তার কাছে বেড়ে গেছিল। বাড়ি ফেরার সময় আমি দেখা করতাম তো,তাই আনোয়ারা থেকেই নিয়মিত ক্লাসে আসতো।
আমরাও বুঝতে পেরেছিলাম যে এই পৃথিবীর বিভিন্ন সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেছে।আদ জাতি,সামুদ জাতি আজ শুধু নাম।সিরিয়া,মিশর, কলকাতা হাজার বছরের পুরোনো সভ্যতার শহর, এসব ও একদিন শুধু নামেই পরিনত হবে।কিন্তু রয়ে যাবে ভালোবাসা। এইসব শহর কিছু মানুষের ভালোবাসার শহর। এই শহরে বসেই স্বপ্ন দেখে মানুষ। স্বপ্ন দেখে একটা আশ্রয়ের,ভালোবাসা নিয়ে একই ছাদের নিচে থাকার।
আমরাও সবার মত স্বপ্ন দেখতাম একই ছাদের নিচে বসবাসের।উত্থান পতনের প্রতিটি সময় একই ছাদের নিচে থাকার স্বপ্ন।বায়ু দূষণের মত আমাদের স্বপ্ন একটু একটু করে বেড়েই চলছে। তারপর আব্বুর চাকরির বয়স পার হয়ে গেল।আমার উপর যেন একটা বিশাল দায়িত্বের ভার চলে এলো।আমাকে কেউ কখনো প্রেসার করেনি যে এখনই চাকরি করে বাড়ির সিনিয়র সদস্যের দায়িত্ব পালন করি।কিন্তু সবকিছু মানুষকে বলে দিতে হয় না।বাড়িতে আমার ছোট বোন আর আব্বু আম্মু ছাড়া তো কেউ নেই।তবুও আমার তখন মনে হল যে আমিও কিছু একটা করে তাদের আয়ের একটা অংশের অংশীদার হই।আমি একটা পার্ট-টাইম জব করা শুরু করি।তখন নিজেকে খুব বড় লাগছিল ভেবে যে আমি আব্বুর সামান্য পেনশনের টাকা দ্রুত খরচ হবার পথে একটা স্পীড ব্রেকার হলেও দিতে পারলাম।
এভাবে দিন চলতে লাগলো।আমাদের ব্যস্ততা বেড়ে গেল।দেখা কম হওয়াতে দিন দিন আমার প্রতি যেন নীলার টান কমতে শুরু করে। সে যেন বুঝতে পারছিল আমার দিন পাল্টে যাচ্ছে।আমি দিনকে দিন একজন পারিবারিক মানুষ হয়ে উঠছি।আমার দ্বারা প্রেম এখন মানায় না।সেও যেন আমার এই পারিবারিক জীবনের পথ থেকে আগলে দাড়াচ্ছিল।যেন বুঝতে পারছিল আমাদের এবার এম এ পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবার সাথে সাথে তার বিয়ের পিড়িতে মেহেদীর ছিটা পড়ার কাজ শুরু হবে।কিন্তু সেই মেহেদীর দাবিদার আমি হতে গেলে যে আরো তিন চার বছর লাগবে।ততদিন কি অপেক্ষা করে থাকা যাবে তার পক্ষে? আমার আশা ছেড়ে দেওয়ায় বরং ভাল হবে বোধ করেছে।আমাদের এই চট্টগ্রামে কেন,বাংলাদেশের প্রায় জায়গায় এমন করে ছেলেদের জন্য অপেক্ষা করে মেয়েরা।কিন্তু মেয়েরা অপেক্ষার পালা দ্রুত শেষ করে প্রতিষ্ঠিত কারো কাছে চলে যায়।নাকি যেতে হয় আমি ঠিক জানিনা।তবে বেশিরভাগ ই যায়।
সেও চলে গেল।আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিল নিয়ে ঘুরে ঘুরে আজ একজন ব্যাংকার।প্রায় সব আছে আমার। এখন শুধু একজন বুকে চেপে রাখার মত মানুষ চাই।যে আমার বুক চিরে সিনার ভিতর চলে যেতে পারে।জীবনানন্দ বলেছেন ” প্রেম ধীরে মুছে যায়,নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়।” কিন্তু এবার আমি আর কিছু মুছে যেতে দিব না।
নীলা আবার এলো,দোকান থেকে ডিম নিতে ভুলে গেছিলো।ভুলে গেছিলো নাকি আমাকে আরেকবার দেখে নিশ্চিত হবার জন্য এসেছিল? নাকি আমাকে বলতে এসেছিল” আমরা একই রুমে না তাতে কি,এক ছাদের নিচেই তো।দিন আমার ভালোই যাচ্ছে। এই যে দেখো আমার জামদানী শাড়ি,অনেক দামে কেনা।
আমার কাল একটা মেয়েকে দেখতে যাবার কথা আছে,দ্রুত মেস ছেড়ে ফ্যামিলি বাসায় উঠে যাব।আমার অতীত, একেবারেই অতীত হয়ে যাক।
১২টি মন্তব্য
মোঃ মিজানুর রহমান সুমন
অসাধারন একটা ছোট গল্প পড়লাম…
যা এ সমাজে প্রতিনিয়তই হচ্ছে। হাজারো নীলারা আজ তাদের প্রিয় মানুষ কিংবা ভালোবাসাকে বিষর্জন দিয়ে অন্যের সংসারের মূল দায়িত্বে আছে…
ভালো লিখছস, তবে মনে হচ্ছে তোর সাথে কিছুটা মিলে যাচ্ছে
এরশাদ খান
আমার এখনো এত খারাপ দিন আসেনি,দোয়া করেন যেন আর না ই আসে।
ধন্যবাদ ভাই
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ভালো লিখেন আপনি। শুভ কামনা রইলো আপনার জন্য
এরশাদ খান
ধন্যবাদ আপু
ত্রিস্তান
গল্পের ভেতর একটা কেবল লাইন আছে যা শিরোনাম নির্দেশক। নামকরণে আরেকটু সচেতন হন। যদি এটাকে অণুগল্প থেকে উপন্যাসে রূপ দেওয়া যেতো তাহলে মনে হয় ভালো হতো। কেননা গল্পের ভাণ্ডারটা অনেক বড়ই মনে হচ্ছে। দেখেন ধারাবাহিক ভাবে লিখতে পারেন কিনা।
এরশাদ খান
ধন্যবাদ ভাই,আপনার কথা মনে রাখব।
ফয়জুল মহী
অনন্য লিখনী
এরশাদ খান
ধন্যবাদ
এস.জেড বাবু
নাকি আমাকে বলতে এসেছিল” আমরা একই রুমে না তাতে কি,এক ছাদের নিচেই তো।দিন আমার ভালোই যাচ্ছে। এই যে দেখো আমার জামদানী শাড়ি,অনেক দামে কেনা।
মনটা কেমন করে উঠলো।
মিশ্র অনুভুতির মাঝখানে সুখ খুঁজে নেয়ার নিরন্তর চেষ্টা-
চমৎকার গল্প
এরশাদ খান
ধন্যবাদ ভাই
রেহানা বীথি
ভালো লাগলো। ভালো থাকবেন। শুভকামনা সবসময়।
এরশাদ খান
ধন্যবাদ