চিঠি পর্ব- প্রিয় অভিমান

রিতু জাহান ১৮ আগস্ট ২০২১, বুধবার, ০১:০২:৫৩অপরাহ্ন চিঠি ১৬ মন্তব্য

#চিঠি পর্ব-২

প্রিয় অভিমান,

তোমাকে প্রিয়ই বলি, কারণ একমাত্র তোমাকেই যেনো যত্নে পুষি রাখি দুঃখ বিলাসী হতে চাই বলে। আজ আষাঢ়ের কতো! দিন পঞ্জিকার সব হিসেব বড় গোলমেলে শূন্য এ ঘরের। তবে বৃষ্টিভেজা স্যাঁতসেঁতে শ্যাওলা ধরা পুরাণ মন্দিরের কোন ঘেষে স্নিগ্ধ আশীর্বাদ নিয়ে চাঁদ উঠেছে, মনে হয় শুক্লপক্ষ। কবে থেকে আমি এ শূন্য ঘরের নতুন প্রহরী তা যেনো মিলাতে পারি না এখন আর,, এ ঘরে তালা আছে, জানলা আছে, দরজা আছে কিন্তু দরজার কব্জি নেই কোনো। তালা খুললেই লুটিয়ে পড়বে কব্জিবিহীন দরজা। তাই মাঝে মাঝে জানলায় উঁকি মেরে তালা টেনে উর্ধ্বমুখী হয়ে রিপোর্ট দেই সব ঠিকঠাক আছে,আমি কোথাও যাই নি। আমি তোমার নির্দিষ্ট করা ঘরের নতুন প্রহরী। আমার বয়স থেমে গেছে এ ঘরে,, আমি স্থির এখন এখানেই। পোকামাকড়েরও ভোজন পর্ব শেষ। অস্থিমজ্জা যতো কিছু নেই অবশিষ্ট। দেহের পঞ্চভূত মিশে গেছে আকাশ, জল মাটি, বায়ুতে।

দরজার এপারে আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি, যদি ঢুকে পড়ে কোনো নামহীন পাখি, বড় ইচ্ছে হয় খানিকটা পথ হেঁটে আসি,, ভালো লাগায় ছুঁয়ে আসি ঘাসবুক। যে বুক আমার ভাগ হয়েছে বার বার। কথা রাখা না রাখার দোলাচলে সে হেরে গেছে বার বার। সে চেয়েছে এক চিলতে আকাশ, আমি দিতে চেয়েছি আমার পুরো আকাশ। চাওয়া পাওয়ার মধ্যে চিরন্তন এক অসহযোগ যেনো। সে চায় জীবনের যজ্ঞশালায় অমৃত বিতরণের আমন্ত্রণ।

নষ্টদের দখলে চলে যাওয়া ঘাসবুকে একবুক নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে ব্যাকুল আমি ক্লান্ত হয়ে নতুন এ ঘরের প্রহরী।
তবু প্রিয় সে মুখ মিলনের স্মৃতি ভাণ্ডার সাথে নিয়ে ঘাসবুকে উষ্ণতা নিতে খানিকটা পথ চলি, চলতে চলতে তাকিয়ে দেখি নিঃশব্দে ঝরে পড়ে যায় আমার মুহূর্ত-পূর্বের পুঞ্জীভূত গ্লানি আর বিরক্তির বোঝা। তুমি অভিমান তখন আষ্টেপৃষ্টে ধরো আমায়। কেনো যে শক্ত কচ্ছপের খলসে আবারো ঢাকো!

এ পথ আমার চেনা পথ। নিজের মতো করেই সাজানো গোছানো। দেবতার পায়ে ঠাই না পাওয়া কেতকী সুবাস নিয়ে অপেক্ষায়। এখানে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভরে থাকে বাসন্তি জ্যোৎস্নার নীলাদ্রির নীল প্লাবন। নীলাদ্রি, আমার প্রচন্ড ভালবাসার সে নীল কষ্ট কষ্ট সুখ। আমার নিস্তব্ধ রাত্রির সর্বদেহে বিরাজ করে শোভা, সম্ভ্রম ও শুভ্রতা। জীবন সংসারে দিনের আলোয় যা ছিলো তুচ্ছ ও রূপহীন। জ্যোৎস্না আর কেতকীর মায়াস্পর্শে তাকেই দেখি সুন্দর মহিমাময়। কি অদ্ভুত ভালবাসার উদাত্ত আহ্বান! নীল আলোর স্পর্শে কেতকীর এ কাটা ঝোপটা যেনো মায়াকানন হয়ে ওঠে।

কে বলবে? যুগ থেকে যুগে কেতকীর হৃদয়মথিত আকুল কান্না গলিত ধারায় লুটিয়ে পড়েছে বাসন্তী জ্যোৎস্না নিশীথিনীর বুকে। এ যে তার ক্লান্ত করুণ বেহাগের ব্যাকুলতা। সব ফুলে বসন্ত আসে না আসলেই সত্য বাণী। যেমন নীলাদ্রির সুরের ভূবনে সেজে উঠে নতুন নতুন কতো সুর! সে ভালবেসেছে সুর,, মুখপক্ষী মূখঅধম আমায় ফেলেছিলো বড্ড যতনে বার বার। সেখানে ভালোবাসারা তুচ্ছ বড্ড।

দু'কদম হাঁটতেই শিউলীর বাঁধানো চত্বর। আর এক অভিমানী পারিজাত। এখনো লুটিয়ে পড়েনি। বোটাগুলো আটকে আছে এখনো গাছের সবুজ পত্রপল্লবজুড়ে। মোহকালের সমস্ত ভারি বস্তুর এক এ আমি দু'দণ্ড বসে গল্পে মেতে উঠি পারিজাতের সাথে। পৌরাণিক কাহিনীমতে পারিজাত নামে স্বর্গে শোভা হয়ে নিজের ঘ্রাণে মুগ্ধ করতো দেব দেবীকে। রাণী সত্যভমা ও রুক্মিণীর খুব ইচ্ছেতেই তাদের বাগানে সুবাস ছড়াতো স্বর্গের পারিজাত।

বেদনার প্রতীক স্বল্পায়ুর পারিজাতের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক ব্যর্থ প্রেমের করুণ গল্প। পারিজাত নামের রাজনন্দিনী ভালোবেসেছিলেন সূর্য দেবকে। কিন্তু ব্যর্থ হলো তার প্রেম। প্রচন্ড অহংকারী সূর্য ফিরেও তাকায়নি পারিজাতের দিকে। অবশেষে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিল রাজকন্যা। দেবতাদের আশীর্বাদে তার চিতাভষ্ম থেকে জন্ম নিল একটি গাছ। যে গাছে তার বেদনা ফুল হয়ে ফুটে। রাতের আঁধারে ফোটা সে ফুল প্রচন্ড অভিমানে সূর্যের আলোর স্পর্শ পাওয়ার আগেই ঝরে পড়ে যায়।

শিউলিই একমাত্র ফুল যা মাটিতে ঝরে পড়ার পরও দেবতার উদ্দেশে নিবেদন করা যায়। শিউলীকে বললাম ব্যর্থ হলেও তুমি বড় ভাগ্যবতী। মাটিতে লুটালেও মুখে তোমার সূর্যের দীপ্ত আলো ফুটে ওঠে তোমার প্রেমের গৌরব নিয়ে। হালকা হয়ে আবার এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিরে আসি শূন্য ঘরের নতুন প্রহরী হয়ে।
এখানে আমার অনন্ত বাস।

,,রিতু,, রংপুর।
আজ আষাঢ়ের ঊনিশ।
শুক্লপক্ষ।

0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ