চিঠি – চতুর্থ অংশ

এস.জেড বাবু ৩ এপ্রিল ২০২০, শুক্রবার, ০৩:৪৬:২০অপরাহ্ন চিঠি ১৮ মন্তব্য

সেদিন সজলের জন্য মেয়ে দেখতে যাচ্ছি- দুজনের গায়ে মাসীমা (সজলের মা) এর কিনে দেয়া পাঞ্জাবি, দুজনের চোখে গেল বছর দুর্গা পূঁজায় কল্পনা (সজলের বোন) এর গিফট, রোদ চশমা।
মামা বলেছিলেন, বারোটার মধ্যে মেয়ে বাড়ি পৌঁছাতে। দুপুরের নিমত্রন, খেতেই হবে। সবকিছু গোছানোর জন্য মামা ভোর সকালে মেয়ে বাড়ি চলে যাবেন। আমি আর সজল সময় মতো উপস্থিত থাকার সদ-ইচ্ছায়, আধা ঘন্টা বাসে করে, দুই ঘন্টা ভ্যান গাড়িতে চড়ে, কানাইসা বাড়ির ঘাটে, খেয়া নৌকার অপেক্ষায়।
মাত্র দু তিন মিনিটের জন্য নৌকাটা আমাদের না নিয়েই বিশাল নদীতে প্রচন্ড কচুরিপানা ঠেলে কচ্ছপের গতিতে সামনে যাচ্ছে। কখন যাবে আর কখন ফিরবে সেই চিন্তায় গোলমাল লেগে আছে মাথায়। নদীপাড়ে বটগাছের তলায় ছোট্ট টংঘরের সামনে চায়ের কেটলির চারপাশে ধোঁয়া দেখে একটা চায়ের তেষ্টা পায়-
ঢকঢক করে সজল তৃপ্তি নিয়ে চা খাচ্ছে আর আমি ধোঁয়ার গন্ধে আর অতিরিক্ত গরমের কারণে চা মুখে নিতে না পেরে, দোকানীর উপর প্রচন্ড রাগ আর সজলের প্রতি হিংসায় সবটুকু চা পাশের রাস্তায় ছুঁড়ে দেই।
আয়েশ করে সিগারেট ধরিয়ে পিছনে তাকাতে যা দেখলাম-
একটা স্বরস্বতী মূর্তি, চোখ দুটো কালী মূর্তির মতো বড়বড় করে সজলের হাতে সদ্য শেষ করা খালি কাপটার দিকে তাকিয়ে আছে। পড়বি তো পড় এক্কেবারে মেয়েটার পায়ের উপর। বুঝলাম চা ফেলেছি আমি, মেয়েটা সন্দেহ করছে সজলকে। ধবধবে সাদা কেডস আর সেলোয়ারের কিয়দংশ বারোটা বেঁজে গেছে। এরপর যা ঘটল আমার চোখে সত্যি ভয়ংকর, রোমাঞ্চকর ও বটে-

ডান কাঁধ থেকে বইয়ের ব্যাগটা বামকাঁধে রেখে- ডানহাত তুলে মেয়েটা সজলকে ডাকছে-
এই যে শ্রীকৃষ্ণ,
—জ্বী আমাকে বলছেন ?
জ্বী আপনাকেই বলছি। এক মগ জল এনে দেবে?

শুনেছি রণভূমি থেকে ফিরে আসা যোদ্ধা, দুটো জিনিষ প্রিয়জনের চোখের আড়াল করে। এক- ওদের শরীরের যুদ্ধক্ষত আর দুই- প্রিয়জনের প্রতি মানষিক টান।

একুশ বছরের সদ্য কৈশর পাড় করা যোদ্ধা সজল আজ মেয়েটার সামনে আমার চিরকালের দেখা তার খুনশুটে স্বভাবের বারোটা বাঁজিয়েছে, যে ছেলে আট দশটা মেয়েকে কলেজ জীবনে হাসাতে হাসাতে গড়াগড়ি খাওয়াতো, আজ সে মাথা নিচু করে মেয়েটার কেডস এর উপর পানি ঢালছে-
আঙ্গুলে সিগারেটের আগুনে ছ্যাঁকা লাগলে হুঁশ ফিরে পাই-

এই যে কার্তিক মহাশয়; আমার দিকে আঙ্গুল তুলে ডাকছে মেয়েটা, একেবারে হিসাব বিজ্ঞানের মেডাম এর মতো। আমি সামনে পা বাড়াতেই বললো- আর এক মগ জল নিয়ে এসো। আমি সজলের হাতে মগ ধরিয়ে দিতেই মেয়েটা ধমকের সুরে সজলকে বলল-
সেলোয়ারে জল দাও। একদম হাত লাগাবে না। বিড়বিড় করে বললো- কলেজ জীবনের স্মৃতি হিসেবে ড্রেসটা তুলে রাখবো ভেবেছিলাম- হনুমানগুলি বারোটা বাঁজিয়ে দিলো।

কাকে হনুমান বলছেন ? ক্ষীণ স্বরে বললো সজল।
—তোমাদের বলছি- লেজ কাটার দল। বলেই মেয়েটা দ্রুতগতিতে ঘাটের দিকে প্রস্থান করলো। আমিও নৌকা ফিরেছে দেখে মেয়েটার পিছু নিলাম।

ইতিমধ্যে আরও চারজন খেয়াযাত্রী আগেই উঠে বসেছে, মেয়েটা আর আমি উঠার পর নৌকার বাতা পানি ছুঁইছুঁই করছে- আমি পিছনে ফিরে দেখলাম সজল সিগারেটে আগুন দিচ্ছে, নামবো না থাকবো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই মেয়েটা খেয়া চালকের উদ্দেশ্যে বললো- নৌকা ভাসাও কাকা, এমনিতে দেরী হয়ে গেছে। বিড়িখোর নৌকায় আসতে অনেক সময়।
বলেই আমাকে ওভারটেক করে এক পা গলুইয়ে রেখে অন্য পা মাটিতে নামিয়ে এক ধাক্কায় নৌকা ভাসিয়ে দিলো।
কি বলবো ! এমন ঘটনাবলির মধ্যে কি বলার থাকে!
যাক ভাবলাম ওপাড় গিয়ে সজলের জন্য অপেক্ষা করবো। তর্কে জড়ালে মেয়েটা হনুমান থেকে বাঁদর বানিয়ে ছাড়তে দেরী করবে না।

থমকে যাচ্ছে খেয়া- কচুরীপানার প্রচন্ড চাপে বুড়ো মাঝি ইঞ্চি ইঞ্চি করে সামনে যাচ্ছে।

—আপনারা সবাই শক্ত হয়ে বসেন, ঢেউ দিলে নৌকা যাবে। আদেশের সুর মেয়েটার গলায়। ভয় পেয়ে গেলাম খেয়া/নৌকায় অনভ্যস্ত আমি।
এক বিন্দু সময়ও দাড়িয়ে থাকতে পারবো না। অনেকটা জোড়েই বললাম।
—তাহলে পাটাতনে বসে থাক।
পাঞ্জাবি নষ্ট হবে।
—এররে বাবা- ঘুরে গিয়ে মেয়েটা নৌকা দোল খাওয়ানোর শারীরিক প্রস্তুতি নেয়।
আমি সত্যিই পানিতে পড়ে যাবো বলছি-
—রাম রাম। বেটাছেলে বলে কি ! বলেই নিজের কথার ঢংয়ে হাসছে মেয়েটা, হাসছে খেয়ার অন্য সব যাত্রী- হাসছে বৃদ্ধ মাঝি।

পিছনদিকে হাতদুটো সামাণ্য ঠেলে দিয়ে বললো মেয়েটা- গলুই’য়ে দাঁড়াও। আমার হাত ধর।
হতবাক আমি, চমকিত, ভীত- ভাববার মতো সময় নষ্ট না করে আজ্ঞা পালন করলাম।

তত আগে টাইটানিক মুক্তি পায়নি, পরে যখন টাইটানিক দেখছিলাম, মনে পড়ছিলো মেয়েটাকে। আমি জেক এর মতো দাড়িয়ে ছিলাম মেয়েটার পিছন থেকে তার দুহাত ধরে, পাটাতনের উপর। চোখ বন্ধ করে দেশী নারিকেল তেলের মিষ্টি গন্ধ নিচ্ছিলাম নিঃশ্বাস ভরে। মেয়েটা পা দুটো সামাণ্য ছড়িয়ে নৌকায় ডানে বামে দোল দিয়ে যাচ্ছে পারদর্শীতার সাথে। প্রথম দুই এক মিনিট নিজেকে কন্ট্রোল করে থাকতে কষ্ট হলেও অজানা অভিজ্ঞতায় নিজেকে দোল খাওয়ার সাথে মানিয়ে নিয়েছি ততক্ষনে। মেয়েটার কব্জিতে ধরে রাখা আমার হাত নরম হয়ে আসে ততক্ষনে।
কোথায় যাচ্ছেন? যেন কেউ প্রশ্ন করে কেড়ে নিলো স্বপ্ন। বাম দিকে সামাণ্য ঘাড় বাঁকা করে আমার উত্তরের অপেক্ষায় সে।
-নেপাল সাহার বাড়ি।
কেন ?
-মেয়ে পছন্দ করতে।
কে মেয়ে পছন্দ করবে ? কৃষ্ণ না কার্তিক ? হাসছে মেয়েটা।
-না, মানে আমি। উত্তর দিলাম। সজলের বৌ তো আমাকেই পছন্দ করতে হবে তাই ভেবে এমনটা বলা।

পিছনের চুল দিয়ে আমার মুখে একটা ঝাপটি লাগিয়ে, আমার মুখোমুখি ঘুরে সরাসরি চোখের দিকে তাকাল মেয়েটা। সে হাত ছেড়ে দিয়েছে আমার।
নাহ্ ; ততটা খাটো নয় সে। আমার দৃষ্টির দুইঞ্চি নিচে ওর চিকন ঘামে ভেজা ললাট, টানা ভ্রু- লম্বা পাপড়ির নাচুনিতে চমৎকার টলমলে একজোড়া চোখ- ভুল বলেছিলাম, সে স্বরস্বতী মূর্তি মতো সাদাসিধে সুন্দর নয়- তার চেয়েও আকর্ষণীয়, লক্ষ্মীর মতো নির্ভেজাল।
ভ্রু দুটোতে প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে, মেয়েটার মুখে অস্পষ্ট প্রশ্ন- পছন্দ হয়েছে ?
আমি প্রশ্নটা শুনেছি, তবে বুঝিনি- এ বয়সে আমার মতো একজন অবিবাহিত যোদ্ধা, এমন কঠিনতম পরিস্থিতিতে আরও কত কি জ্ঞান/বুঝ অজানা কারনে, অজান্তে লুকিয়ে রাখে জানিনা।

তড়িৎ দোলে উঠে পাপড়ি, আবারও প্রশ্ন-
কি ? পছন্দ হয়েছে ?
—আমার সহজ/সত্য উত্তরঃ দেখিনি তো- তাই জানি না!

সাঁতার জানো তো ? মেয়েটার মুখ থেকে প্রশ্নটা বের হতেই, হটাৎ বেড়ে গেল নৌকার দোলুনী_____

চলবে___

বিঃদ্রঃ চিঠিতে কি করে গল্প বলতে হয় আমি জানিনা। তবে সংগত কারণে বাধ্য হয়ে গল্প টা চিঠিতেই লিখতে হচ্ছে/ চেষ্টা করছি।

কেন ? এই প্রশ্নের উত্তর অন্য কোনও পর্বে- ইনশাআল্লাহ।

0 Shares

১৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ