যে কারো মুখ মন্ডলে ঘন গোঁফ দেখলেই প্রথমেই যে প্রশ্নটি আমার মাথায় আসে তা হচ্ছে- ''এত ঘন গোঁফ! ওনার গোঁফে উকুন আছে? '' কেন এবং কিভাবে এই প্রশ্নটি  আমার মাথায় আঠার মত লেগে আছে তা আমি জানিনা। ঠিক কত বছর আগে থেকে এই প্রশ্ন মস্তিস্কে বাসা বেঁধে আছে তাও জানিনা। শুধু জানি, ঘন গোঁফ দেখলেই এই প্রশ্ন মনে জাগবেই জাগবে।

এমন তো নয় যে আমার আশেপাশের কারো ঘন গোঁফ ছিল, এবং কোন এক শতর্ক বা অ-শতর্ক মুহূর্তে তিনি তার গোঁফের মধ্য হতে একটি আস্ত উকুন এনে হাতের বুড়ো আংগুলে রেখে অন্য বুড়ো আংগুল দিয়ে কুট্টুস করে উকুন মেরে ফেললেন, আর তা আমি দেখে ফেলেছিলাম, ফলে এই প্রশ্ন আমার মস্তিস্কে চলে এসেছে। তাহলে ঘটনা কি?!

আমার নিজের, আমার ভাই, বাবা, চাচা, মামা, নানা, দাদা, কোনো বন্ধু, পাড়ার নিকট জন কারো কোন কালেই গোঁফ ছিল না। আমি যখন বিএম কলেজে ইন্টারে প্রথম বর্ষের ছাত্র, তখন প্রথম সেইভ করি। এর আগে হালকা গোঁফ ছিল। প্রথম সেইভ করার পর যে কি লজ্জা। সারাক্ষণ মুখে হাত দিয়ে গোঁফ এর স্থান ঢেকে রাখতাম। এই অবস্থায় এলাম বাড়িতে। যথারীতি সবার সামনে মুখে হাত। আব্বা আম্মা কিছু বলতেন না, হাসতেন তা বুঝতাম। বড়দার ( আমার বড় ভাই ) সামনে পড়লাম হঠাৎ , কেমন এক ভয় করতাম বড়দাকে। শুধু আমি নয়, জেলা শহরের যারা বড়দাকে চিনতেন, সবাই কেমন আড়ষ্ট হয়ে থাকতেন তার সামনে। রাস্তায় যখন তিনি বেড় হয়ে হেঁটে যেতেন, তাঁর চেনা জানা সার্কেলের সবার কথা বার্তা, কোলাহল, হইচই থেমে যেত তাঁকে দেখা মাত্র। তো এমন প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী বড়দার সামনে মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। একবার তাকিয়েই কিছুটা ধমকের সুরেই বললেন ' মুখে কি হইছে? হাত নামা '। ধমক দিলেও তাঁর মুখের চাপা হাসি ঠিকই দেখেছিলাম আমি। মুখ থেকে হাত না নামিয়ে পারলাম না। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। শান্ত কণ্ঠে জড়সড় আমাকে বড়দা বললেন 'সেইভ করছ তুই, কত ভালো লাগছে তোকে। মুখে হাত দিয়ে রাখলে তোর এত সুন্দর মুখটা মানুষ দেখবে কিভাবে?'
তাঁর কথায় কি এক যাদু ছিল। সেই যে মুখ থেকে হাত নামালাম আর মুখে হাত তুলিনি। মুখে হাত দিয়ে রাখলে আমার সুন্দর মুখ দেখবে কিভাবে মানুষ? যদিও আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর মানুষ ছিলেন আমার বড়দা। ঢাকা জগন্নাথ কলেজে পড়াকালীন সময়ে বড়দার কিছু সাদা কালো ছবি দেখেছিলাম আমি, একদম নায়কের মত ছিলেন আমার বড়দা।

খুব ছোট বেলার কথাও ভেবেছি, না! তেমন বড় গোঁফ ওয়ালা কাউকে মনে পড়ছে না। বাসার খুব কাছে থানা হওয়ায়, থানা এলাকায় যাতায়াত ছিল খুব। ওসি, দারোগাদের খুব সুন্দর কয়েকটি ওয়াল দেয়া টিনের চালের বাসা ছিল, এই সব বাসার পিছনেই ছিল একটি পুকুর। পুকুরে গোছল করতাম। প্রায়ই যাবার সুবাদে পরিচয় হয়েছিল থানার এক হাবিলদার এর সাথে। তাঁর গোঁফ ছিল, কিন্তু তেমন ঘন না। পরিবার পরিজন থেকে দূরে থাকায়, তিনি খুব শ্নেহ করতেন আমাকে, মাঝে মাঝে চকলেট দিতেন। তাঁকে ভয় পেতাম না মোটেই।

১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হলে এপ্রিল মাসের শেষ দিকে আমাদের শহর পাক সেনারা দখল করে নেয়। মাস খানেক পরে আমি শহরে আসি আমাদের বাসা দেখার জন্য। তখন ক্লাস ফোর এর ছাত্র আমি। বর্তমানে যেটি উপজেলা কার্যালয়, তখন সেটি আরসিও কার্যালয় ছিল, এবং পাকি সেনাদের ক্যাম্প ছিল। গ্রাম থেকে আসার সময় এই ক্যাম্পের সামনে দিয়েই আসতে হতো। প্রথম দিন আসার সময়ই ক্যাম্পে পাহাড়ায় থাকা এক পাকি সেনা ডাক দিল। কথা বুঝিনা, হাতের ইশারায় ডাক দেয়ায় কাছে যাই। ইংলিশ হাফপ্যান্ট, হাফশার্ট পরিহিত আমাকে তখন ভালোই দেখাত। ভয়ে ভয়ে তাঁর কাছে গেলে আমার মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। তাঁর মুখে কেমন এক কষ্টের অভিব্যক্তি দেখেছিলাম, যা এখনো আমার মনে আছে। তাঁর বড় গোঁফ ছিল। তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার ভয় চলে গিয়েছিল। কি সব বললো, বুঝলাম না কিছুই, তবে এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে তিনি আবার আমাকে আসতে বলেছিলেন। আমি কাঁধ কাত করে বুঝালাম যে আসব আবার। আমাদের বাসা রাজাকার আর শান্তি কমিটির লোকেরা ভেঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। আমি গিয়ে দেখি বাসাই নেই আমাদের। খুব মন খারাপ করে হেঁটে হেঁটে ফিরছিলাম। ফেরার সময় আবার ডাকলো ওই পাক সেনা। গেলাম কাছে, আমার মন খারাপ, কাঁদছিলাম আমি। মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিলো আমাকে। আমার কান্না দেখে এক স্থানীয় বাঙালিকে কি বলায়, কিছুক্ষন পরে দেখি সে এক প্যাকেট চকলেট নিয়ে এসেছে। পাকি গোঁফ ওয়ালা ওই চকলেট আমাকে দিলো। তাঁর চোখেও পানি দেখতে পেলাম। সম্ভবত তিনি পশ্চিম পাকিস্থানে থাকা তাঁর পুত্র সন্তানের কথা ভেবে কাঁদছিলেন। আমি তাঁর কাছ থেকে চলে আসার পর আর যাইনি কখনো। স্বাধীনতার পরে শুনেছিলাম যে তিনি কারো কোনো ক্ষতি করেননি, বাচ্চাদের ভালোবাসতেন খুব। তাঁর মুখেও বড় গোঁফ ছিল, কিন্তু তাঁকে ভয় পাইনি, বা ঘৃণাও করিনি।

গোঁফের মধ্যে উকুন থাকতে পারে, এই প্রশ্ন আমার মধ্যে কিভাবে আসলো তাঁর উত্তর আমার কাছে অজানাই থেকে গেলো। আপনারা কি বলতে পারেন এর উত্তর?

0 Shares

৩৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ