গল্পঃ বাজি

রাইসুল জজ্ ২০ জুলাই ২০১৩, শনিবার, ০৩:৪৬:১৬পূর্বাহ্ন গল্প, সাহিত্য ১৬ মন্তব্য

একটা দোকানের ঝাপির নিচে আটকা পড়েছি । বৃষ্টি হচ্ছে, আজকের বৃষ্টিটা অদ্ভুত । এখন রাস্তার ঐপাশে বৃষ্টি হচ্ছে । কিছুক্ষন আগে এই পাশে বৃষ্টি হয়েছে । অভিজ্ঞতা বলছে কিছুক্ষন পরে ওপাশে বৃষ্টি থেমে যাবে, তখন এপাশে বৃষ্টি হবে । রাস্তার পাশের চা দোকানী প্রানপনে বৃষ্টির ছাট আটকাচ্ছে । একটা হলুদ মোটরসাইকেল বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে যাচ্ছে । ঠিক করেছি একটা চাকুরি পেলেই মোটর সাইকেল কিনবো । কালো রং্যের ডিসকভারি । হলুদ আবার মৃদুলার একদম পছন্দ না । মৃদুলার লাল আর কালো পছন্দ । কালো কোন রঙ না । কোন রঙই না থাকাটাই কালো, আর সব রং থাকাটা হল সাদা । একজন বিখ্যাত মানুষ এই সহজ সুত্রটি আবিষ্কার করেছিলেন । উনার নাম নিউটন, পুরো নাম স্যার আইজ্যাক নিউটন । স্যার নামের অংশ না । সবাই তাকে সম্মান দিয়ে নামের আগে স্যার যোগ করেছে । সম্মান আর ভালোবাসা এক জিনিস না । সম্মান দিলে নামের আগে কিছু যোগ করতে হয় । কিন্তু ভালোবাসলে নামের কিছু অক্ষর বাদ যায় । মৃদুলাকে আমি মৃদু নামে ডাকি । আমার নামের অবশ্য কোন খন্ড অংশ নাই । কেন নাই তা এক বিরাট রহস্য । ফেলুদা থাকলে তাকে জিজ্ঞেস করা যেত । ভদ্র লোক খুব বুদ্ধিমান, যে কোন কিছু শুধু মাথা খাটিয়েই বের করতে পারেন । মাথা খাটাতে পারে এমন মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে কম । বেশি হলে সমস্যা হয়ে যেত । সবাই মাথা খাটালে বুদ্ধিমানের প্রশংসা কে করবে । তাই যুগে যুগে আমার মত মানুষের জন্ম হয় । এরা মাথার চেয়ে কপাল খাটাতে বেশি স্বাচ্ছ্বন্দ বোধ করে । কথাটা শুনতে খারাপ লাগলেও এদের সংখ্যায় দুনিয়ায় বেশি ।

 

মৃদলার সাথে পরিচয় অডিটরিয়ামে, নাটক দেখতে গিয়ে । নাটকের নাম মনে নাই । খুব হাসির নাটক ছিলো । নাটক দেখে বের হয়ে পড়লাম বৃষ্টিতে । টিপটিপ বৃষ্টি, টিপটিপ বৃষ্টি আমার ভালো লাগে না । এই বৃষ্টিতে ভেজাও যায় না, আবার গা বাচানোও যায় না । বিব্রতকর একটা ব্যাপার । একে একে অডিটরিয়াম খালি হয়ে যাচ্ছিল, শুধু কয়েকটা কাপল বসে বসে ফিস ফাস করছিলো । কাপলদের ফিসফাসের প্রতি আবার আমার দুর্বলতা আছে । তবে আগ্রহ নিয়ে শোনা হয় নি কখনো । কেমন জানি লজ্জা লজ্জা লাগে । দেখতে দেখতে অনেক বন্ধুই গার্ল ফ্রেন্ড জোগাড় করে ফেললো । আমাদের লম্বু কামরান, যাকে আমরা ভালোবেসে কামু ডাকি একদিন দেখলাম সেও রিকশাতে জরসড়ো হয়ে বসে আছে । মুখে লজ্জা লজ্জা হাসি । মাঝে মাঝে পাশের মেয়ের সাথে ফিসফাস করছে । কামুর কাছে জিজ্ঞেস করতে হবে, ফিস ফিস করে কি কথা বলে । সবকিছুতেই অভিজ্ঞতা থাকা ভাল । মেয়েদের ব্যাপারেও আমার অভিজ্ঞতা কম । জানার ভেতর শুধু জানি একটাই । মেয়েদের সাথে সব সময়ই একটা ছাতা থাকে, আর থাকে এক বোতল পানি । কিছুক্ষন পর পর সেই বোতল থেকে পানি খাওয়া মেয়েদের অভ্যাস । তবে ছেলেদের দেখিয়ে পানি খায় কিনা এই ব্যাপারে সন্দেহ আছে । অধিকাংশ সময়েই দেখেছি, বোতল সব সময় ভরা থাকে । আশ্চর্য হলেও সত্য মৃদুলার সাথে সেদিন ছাতা ছিলো না । আমার মত অডিতে আটকা পরে বিব্রত হচ্ছিল । আমার চেয়ে বেশিই বিব্রত হওয়ার কথা । মেয়েরা সব সহ্য করতে পারে শুধু অন্য মেয়ের বয়ফ্রেন্ড আছে এটা ছাড়া ।

এখন রাস্তার এপাশে বৃষ্টি হচ্ছে । ঐপাশে একটা মেয়ে ভিজতে নেমেছে । আধভেজা হওয়ার পর এখন আর বৃষ্টি নেই । এখন মেয়েটার এখানে থাকার কথা না । সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার ভেতর হল বন্ধ হয়ে যায় । এরপরে ঢুকতে হলে পাস লাগে । এক বার পাস নিলে পনের কুড়ি দিন নিশ্চিন্ত । তখন রাত দশটাতে এলেও সমস্যা নেই । প্রেমিক প্রেমিকাদের সবাই সুযোগ দেয় । মেয়েটার আশে পাশে কোথাও তার বয়ফ্রেন্ড আছে । সম্ভবত ভিজতে ভয় পায় । এরকম বয়ফ্রেন্ড নিয়ে মেয়েদের যত বিপদ । সাথেও রাখতে পারে না, ছাড়তেও পারে না । পৃথিবিতে দুই শ্রেণীর মানুষ বৃষ্টিতে ভিজে না । একদল দুর্বল প্রকৃতির আর অন্যদল সবল । বৃষ্টিতে ভিজে মধ্যম মানের মানুষেরা, ভিজে ভিজে আনন্দ পায় । বৃষ্টির পানিতে থাকে হরেক রকমের মিনারেল আর ভিটামিন । সবলেরা বৃষ্টিতে ভেজে না, চাদের আলয় ভিজে । চাদের আলোয় ভিটামিন নাই । আমিও সবলদের দলে । চাদের আলোয় সিগারেটের ধোয়া উড়িয়ে হাটতে হাটতে মৃদুলার কথা ভাবি । আমার ভাবতে ভাল লাগে । ভাবতে ভালো লাগা বুদ্ধিমান প্রানির লক্ষন । সায়েন্স ফিকশনে ভিনগ্রহের বুদ্ধিমান প্রানিগুলো সারাদিন ভাবে । হাই লেভেলের চিন্তা ভাবনা । আমি কম বুদ্ধিমান, তাই লো লেভেলের চিন্তা ভাবনা করি । তৃষা  সায়েন্স ফিকশন পড়তে ভালোবাসে । গত মাসে একটা বই কিনে চেয়েছিল । ভুলে গেছি । কিছুতেই মনে থাকে না । আজকাল স্মৃতিশক্তি কমে যাচ্ছে খুব । মাঝে মাঝেই ভুলে যাচ্ছি খুব সহজ জিনিস গুলো । অবশ্য এই ভুলোমনা ভাবটা নতুন নয় । সেই ছোট বেলা থেকেই আমি ভুলে যাই । খুব সহজেই ভুলে যাই সব । যে রাতে হঠাত করে আব্বা অসুস্থ হয়ে গেলেন সেটা উনিশ তারিখ ছিল নাকি বিশ তারিখ ছিল মনে নাই । তবে এটুকু মনে আছে, সেদিন শুক্রবার ছিল । শুক্রবার আব্বা গরুর মাংস দিয়ে ভাত খেতেন । আমরা রাতে সবাই মিলে ভাত খেলাম । গরুর মাংস চালের গুড়া দিয়ে রান্না করা । খাওয়ার পর আব্বা আমাকে পড়াতে বসলেন । গরুর রচনায় ভুল ধরলেন । the cow gives us milk, আমি us লিখতে ভুলে গিয়েছিলাম । সম্পুর্ন সুস্থ মানুষ শুতে গেলেন, আর সকাল হতে হতেই হার্ট এটাক । পরের দিন সারাদিন আম্মার চেতনা ছিলো না । তাকে কিছুতেই বোঝান যায় নি আব্বা মারা গেছেন । চেতনা ফিরলো সন্ধ্যার আগে আগে । ততক্ষনে লাশের জানাজা শেষে, দাফনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে । পেছন থেকে কেউ একজন করুন কন্ঠে আবেগ ঢেলে বলেছিলো, দেখ বাবা, শেষবারের মত দেখে নাও । আর কখনো দেখতে পারবে না । তার কথার অর্থ না বুঝেই দেখেছিলাম কাফনে জড়ানো লাশ । মুখটা কেমন ছিলো এখন আর শত চেষ্টাতেও মনে করতে পারি না । অথচ সেই করুন আবেগী কন্ঠটা আজো মনে আছে । খুব গুরুতপূর্ণ জিনিস আমি ভুলে যাই সহজেই, কিন্তু গুরুত্বহীন কথা গুলো মনে থাকে সব সময় । তবে, সায়েন্স ফিকশন কেনার কথাটা আমার সব সময়েই মনে থাকে, তারপরও মিথ্যা বলি । মিথ্যা বলার কারন আছে । কারন্টা সাধারন, বেকারত্ব । একটা চাকুরী পেলেই তৃষা কে এক বুক শেলফ ভর্তি বই কিনে দেব । সায়েন্স ফিকশন, সাথে কিছু থ্রিলার । আগে থ্রিলার পড়তে ভালো লাগতো অনেক । অবসর সময়ে পড়া যাবে ।

তৃষা দেখতে অবিকল আব্বার গায়ের রং পেয়েছে । আমি হয়েছি মায়ের মত, কালো । মা অবশ্য শ্যামলা বলে । আমার কিছু এসে যায় না । কালো ফর্সা নিয়ে মাতামাতি করে মৃদুলা । তার বরের অবশ্যই ফর্সা হতে হবে, লম্বা হতে হবে, বুদ্ধিমান হতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি । আর অতি অবশ্যই আয় রোজগার ভাল হতে হবে । আয় রোজগার যাদের ভালো তারা অবশ্য সব সময় বুদ্ধিমানই হয় । বোকা হয় নিম্ন আয়ের মানুষ ।

আমার কি হবে তাহলে ? কিসের কি হবে ? আমি তো লম্বাও না ফর্সাও না । তো ? তুই কি আমাকে নিয়ে কিছু ভাবছিস ? ভাবা ভাবির দিন অনেক আগেই শেষ । আমি তো তোর প্রেমে হাত পা ভেঙ্গে পড়ছি রে । বেচারী ! দেখ, আমি লম্বা না হলেও মনটা কিন্তু অনেক লম্বা । তাল গাছের মাথা থেকে বড়ই পেড়ে আনতে পারবো । তাল গাছে বড়ই ? আরে কথার কথা বলছি তো । আর কি পারবি বলতো, পারলে একটা লিস্টও বানাতে পারিস । লিস্ট বানিয়ে জমা দিবি । আমি ভেবে দেখবো । যদি লিস্ট পছন্দ না হয় ? তাহলে কি আর করা যাবে, তুই গুড বাই হয়ে যাবি । আর আমি এতোদিন যে তোর পিছে পিছে ঘুরছি তার কি হবে ? বললাম তো ভেবে দেখবো ।  কি ভেবে দেখবি ? তোকে আমার বাচ্চার মামার পদ টা দেয়া যায় কিনা ! জানিস তো, মামার গুরুত্ব অনেক । দুইবার মা ডাকলে একবার মামা হয় ।

ভেবে দেখা দেখির কিছু অবশ্য ছিলো না । লিস্টে কিছুই নাই । আমি আসলে কিছুই করতে পারি না । কিছু করতে না পারাটা একটা অপরাধ । এই অপরাধের অপরাধীরা রাস্তায় হাটে । হাটতে হাটতে আকাশ দেখে । আকাশ নীল হলেও ভাল লাগে, মেঘলা থাকলেও ভালো লাগে । শুধু ভাল লাগে না আকাশের নিচের মানুষটাকে । যার সব কিছুই ভাল লাগে তাকে ভাল লাগে না কারও । ভাল লাগার ব্যাপারটা আপেক্ষিক হলেও, বেশির ভাগ মানুষের দেখার ধরনটা এক । এক দৃষ্টিকোন থেকেই বিচার করে মানুষ । আমি মানুষের মাঝে দুই পায়ে চলা অন্য কিছু, অদৃশ্য কিছু । অস্তিত্বের সংকট আমাকে খুবলে খেয়ে এঁটো করে যায় প্রতি মুহুর্তে । আমিও থেকেও নেই হয়ে দেখি মানুষের কোলাহল । হাজার মানুষের লক্ষ লক্ষ এক্সপ্রেশন আমাকে কাবু করে না আর । দেখতে দেখতে চেনা হয়ে গেছে খুব ।

 

কিরে, তোর লিস্টে তো কিছুই নেই ? সাদা কেন ? আমি না তোর জন্য কিছুই করতে পারবো না । একশো আটটা নীলপদ্মের খোজে যাওয়ার সময় আমা হবে না, আকাশ থেকে চাঁদ তারাও পেড়ে দিতেও পারবো না । যদি কোন গভীর রাতে বাচ্চার কান্নায় তোর ঘুম ভেঙ্গে যায়, যদি খুব বিরক্ত লাগে ফিডার বানিয়ে দিতে, অথবা রান্নার লবণ ঠিক হয়েছে কিনা তা দেখার লোক দরকার হয় তবে ঠিকই আমাকে পাশে পাবি সবসময় । কসম । পাশে থাকলে চলবে না । তোকেই সব করতে হবে । মানে ? মানে আমার একটা যমজ বাবু হবে, নাম টোনা আর টুনি । তাদের বাবা হতে চাইলে এখনি বেবিসিটার এর ট্রেনিং নে গাধা ।

 

তারপর থেকে মৃদু হয়ে গেলো টুন্টুনির মা । এটাও ভালোবাসার নাম । জমজ মেয়ের নাম হবে টোনা টুনি আর আমি তাকে ডাকি টুন্টুনির মা । টুন্টুনির মা আমাকে পিঠা খাওয়াতে ছেয়েছিলো আজ । চকলেট পিঠা । ইংরেজীতে যাকে বলে চকোলেট কেক । আমিও খাওয়ার জন্য উন্মুখ, চকোলেটের কেক বানায় কেমনে দেখার ইচ্ছা হচ্ছে । আমার এক বন্ধু হোটেল ম্যানেজম্যান্ট নিয়ে পড়ে একটা হোটেলে চাকুরী করছে । ওকে জিজ্ঞেস করা যায় । মনে হয় বলতে পারবে । আবার নাও পারে । বড় বড় শেফরা তাদের রেসিপি গোপন রাখে । আপাতত এগুলো না ভাব্লেও চলবে । চকলেট কেক খাবো, আর সাথে করে এক পিছ নিয়ে যাবো । তৃষাকে দিবো । ওর ভালো লাগ্লে চাকুরী পাওয়ার পর প্রতি মাসেই চকলেট কেক কিনে দেবো । কিছুক্ষনে আগে ফোনে জানালো সে আস্তে পারবে না । বাড়িতে ঝামেলা আছে । কোন দূর সম্পর্কের আত্নীয় নাকি একটা ছেলেকে নিয়ে এসেছে । ছেলে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী । মৃদুলাকে দেখে পছন্দ হলে আংটি পড়িয়ে রেখে যাবে । আর সামনের সপ্তাহে বিয়ে ।

 

দোকানের ভেন্টিলেটরে দুইটা চড়ুই বসে আছে । এতো রাতে চড়ুই জেগে থাকার কথা নয়, তবুও জেগে আছে । সম্ভবত বৃষ্টিতে ঘুম ভেঙ্গে গেছে । মাঝে মাঝে আমারো ঘুম ভেঙ্গে গেলে আর ঘুম আসে না । চেয়ে থাকি সারারাত । জানালা দিয়ে আসা আলো দেয়ালে পড়ে থাক নিশ্চুপ । ঘুমহীন চোখে তখন আলো ছায়া খেলি । আলো ছায়া খেলতে গেলেই টিক্টিকিটা ভুল করে বারবার । টিকটিকি সত্যি অদ্ভুত প্রানী । আমারো মাঝে মাঝে টিকটিকি হতে ইচ্ছে করে । দেয়াল বেয়ে উপরে উঠতে ইচ্ছে করে খুব । এই দোকানটার দেয়ালে কোন টিকটিকি নেই । তার বদলে আছে একটা দেয়াল ঘড়ি ।দেয়াল ঘড়িতে এখন সাড়ে নয়টা বাজে । দেয়াল ঘড়ির কাটা গুলো কেমন বিষন্ন । তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার উপরেও বিষন্নতা ভর করেছে । এর পেছনে অবশ্য একটা কারন আছে । কিছুক্ষন আগে মনে মনে বাজি ধরেছিলাম, ঠিক সাড়ে নয়টায় যদি রাস্তার ওপাশে বৃষ্টি হয় তাহলে মৃদুলার আজকের বিয়েটা ভেঙ্গে যাবে, আর যদি এপাশে বৃষ্টি হয় তাহলে এই মাসেই চাকুরী পাবো । এখন রাস্তার দুই পাশেই বৃষ্টি হচ্ছে ।

0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ