আমরা জানি, গ্রিসের ক্রীতদাস প্রথা অনেক পূরনো। ব্রোঞ্জ যুগের সময় খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০-১১০০অব্দে ক্রীতদাস ছিল। দক্ষিণ গ্রিসের প্রত্নতাত্ত্বিক শহর মাইসনা খননকালে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রাচীন রোমান শহর পম্পেতে পাওয়া যায় এক মৃতদেহ, কালের আবর্তনে তা মূর্তিতে পরিণত হয়েছে। এই মৃতদেহের পায়ে ছিল বেড়ি। ধারনা করা হয় এই মূর্তিটির বয়স ২০০০ বৎসরের পুরনো। খ্রিস্টপূর্ব ৮ম ও ৭ম শতকে স্পার্টা ও মেসিনিয়ার মধ্যকার দুই যুদ্ধে স্পাটার্নরা মেসিনিয়ার সকল আদিবাসীকেই বন্দী করে বিশেষ ধরনের ক্রীতদাসে পরিণত করে। এসব আদিবাসী ক্রীতদাসরা হেলট নামে পরিচিত। প্রাচীন গ্রিক শহরে ক্রীতদাসদের সংখ্যামোট জনসংখ্যার ৩০% এর মত ছিল।
প্রাচীন রোমান সম্রাজ্যঃ গ্রিক ও ফোনেসিয়ান সভ্যতা (বর্তমান লেবানন থেকে সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত এক সভ্যতা যা খ্রিস্টপূর্ব ১২৪০-৫৩৯ অব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল) থেকে উত্তরাধিকার হিসেবেই ক্রীতদাস প্রথাকে পেয়েছে রোমানরা। রোমান রিপাবলিক বাইরেরর দিকে যতো বিস্তৃত হতে থাকে তত সেখানকার সকল আধিবাসীদের তারা ক্রীতদাস বানিয়ে তাদেরকে দিয়ে জোর করে রোমের কৃষিকাজ ও গৃহস্থালি কাজ করাতো। এলিট রোমানরা এভাবে প্রচুর ক্রীতদাস আনতে থাকায় একসময় ক্রীতদাসরাই সংখ্যালগিষ্ঠ জাতি হয়ে ওঠে এবং এক সময় শুরু হয় ক্রীতদাস বিদ্রোহ। স্পার্টাদের নেতৃত্বে তৃতীয় সারভিল যুদ্ধ ছিল তেমন এক ভয়াবহ বিদ্রোহ যুদ্ধ।
নানাপ্রকার এসব যুদ্ধে হেরে যাওয়া বন্দী আদিবাসী ক্রীতদাসদেরকে শুধু শ্রম দেওয়ার জন্যই ক্রীতদাস হতে হয়নি, তাদেরকে মালিক পক্ষকে আনন্দ ও দিতে হতো। যেমন তাদেরকে হতে হতো গ্লাডিয়েস কিংবা যৌনদাসী।
গ্লাডিয়েটর হলো এক ধরনের নির্মম পরিহাসের স্বীকার রোমান যোদ্ধা। তারা তরবারি নিয়ে আরেকজন গ্লাডিয়েটরের সাথে লড়াই করত যতক্ষন এক পক্ষ মারা না যায়। আবার কখনো হিংস্র পশুর সাথেও করতে হতো লড়াই। এসব ভয়াবহ মৃত্যু দেখে রোমানের এলিট শ্রেনীর লোকেরা চিত্তবিনোদনের সুখ খুঁজতো। প্রাচীন রোমান সম্রাজ্যের অন্তত ২৫ ভাগ জনসংখ্যাই ছিল ক্রীতদাস। রোমান সম্রাজ্যের সবচেয়ে উন্নত শহর রোমে বসবাস করত অন্তত ৪০০,০০ ক্রীতদাস। তখন যদি কোনো ক্রীতদাস পালিয়ে যেতো তবে ধরা পড়ার পর তাকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হতো। ক্রীতদাস প্রথা রোমের অর্থনীতিও উন্নতির অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে ছিল।
রোম রাজতন্ত্র শুরু হওয়ার দুই শতক পূর্বে রোমানরা খুব বেশী সংখ্যায় ক্রীতদাস নিয়োগ করা শুরু করে এবং সে সময় ক্রীতদাসদের সাথে বর্বরতা বাড়তে থাকে। খনিতে ওভারসিয়াগণ ক্রীতদাসদের আরো বেশি কাজ করানোর জন্য চাবুক দিয়ে প্রহার করত, এক কথায় বলতে গেলে এ হতভাগ্য ক্রীতদাসগণ সারাক্ষনই চাবুকের উপর থাকতো। কৃষিতে কর্মরত ক্রীতদাসদের অবস্থাও অনেকটা এমন ছিল। ক্রীতদাসদের সব থেকে ভয়াবহ ছিল গ্লাডিয়েটর হিসেবে কাজ করা। রোমান সম্রাজ্য যতোই বিস্তৃতি লাভ করছিল বিজিত দেশগুলোর প্রায় সকল অধিবাসীকেই ক্রীতদাস হিসেবে ইউরোপ ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বিক্রয় করা হতো।
পশ্চিমে রোমান সম্রাজ্যের পতন হলেও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ক্রীতদাস প্রথা চালু থাকে। সাহারার লবন খনিতে ক্রীতদাসের বিশাল বহর কাজ করত।
ক্রীতদাস প্রথা আরো বিকোশিত হতে থাকে এবং এর বড় একটি কেন্দ্র হয়ে ওঠে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল। কারন, অন্য যে কোনো স্থানের চেয়ে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ভৌগলিক অবস্থান ও অর্থনৈতিক কারনে ক্রীতদাস ব্যবসাকে চাঙ্গা করে তোলে আর এর কেন্দ্রবিন্দু অঞ্চলগুলোর লোক ছিল শিক্ষিত ও সভ্য সমাজের! অন্যদিকে এর উত্তর ও দক্ষিণে তীরবর্তী অঞ্চলে ছিল অপেক্ষাকৃত কম সভ্য ও বিভিন্ন আদিবাসীদের বসবাস। সীমান্ত অঞ্চলে যুদ্ধবিগ্রহের কারনে বিজয়ীরা লুটপাট করে যুদ্ধবন্দিদের জোরপূর্বক ধরে নিয়ে ক্রীতদাস বানাতো।
প্রাচীন রোমান আইনে ক্রীতদাস ছিল পণ্য। অন্য যেকোনো বস্তুর মতো ক্রীতদাস সহজেই ক্রয় বিক্রয় করা যেতো। রোমান ক্রীতদাসদের জন্য তার মালিকের ইচ্ছেই ছিল সবকিছু। যার বিরুদ্ধে তাদের কোনো কিছুই করার অধিকার ছিল না। রোমে প্রথমদিকে ক্রীতদাসদের বড় একটি অংশই আসে। গ্রীক থেকে। প্রচুর সংখ্যক গ্রিককে ক্রীতদাস হিসেবে আনা হয়। ক্রীতদাস ব্যবসায়ীরা তারা তাদের ক্রীতদাসদের বিশেষ যোগ্যতা ও গুণাবলি লিখে তাদের গলায় ঝুলিয়ে রাখতো। আর নারী ক্রীতদাস ও পুরুষ ক্রীতদাস কোনো ভেদাভেদ ছিল না তাদের পোশাকের ক্ষেত্রে। নারীদেরও সম্পূর্ণ বিনা কাপড়ে উঁচু একটি স্টেজে নানা ভঙিমায় দাঁড় করিয়ে রাখতো। অনেক ক্রেতা এসব নারী ক্রীতদাসদের শরীরে বিভিন্ন অংশে স্পর্শ করে দেখতো। অধীকাংশ নারীরা সম্রাটের হেরেমের উদ্দেশ্যে ও রাজ কর্মচারিদের জন্য ক্রয় করা হতো। হেরেমে গেলে তাদের নামও পাল্টে ফেলা হতো।
১৯টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
ক্রীতদাসদের নিয়ে এসব সত্যি জানা ছিলনা আমার,
অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমাকে এমন বিষয় নিয়ে পোষ্ট দেয়ায়।
সভ্যতা নির্মাণে এই ক্রীতদাসদের অবদানই সবচেয়ে বেশি,
যুদ্ধে পরাজিত জনগনকে তাহলে তখন থেকেই ক্রীতদাস হিসেবে ব্যবহার করা শুরু?
ইসলামে যে গনিমাতের মাল বলা হয়, তা হয়ত এই ক্রীতদাস প্রথা থেকেই এসেছে।
শুভ কামনা।
মৌনতা রিতু
হুম, তা ঠিক। এরও একটা ইতিহাস সঠিক ইতিহাস আছে। নবিজীর সাহাবী ছিলেন খালীদ বীন ওয়ালিদ, তো তখন কোনো যুদ্ধে যখন সৈন্যরা শুনতেন যে যুদ্ধে, খালীদ বীন ওয়ালিদ সেনাপতির দায়িত্বে থাকবে তখন সৈন্যরা খুব খুশিমনে যুদ্ধে যেতেন। এর একটা কারনও ধরা যায় যে যুদ্ধে পরাজিতদের সম্পদ লোভের আশা।
তবে এই ক্রীতদাসদের ব্যপারে খ্রস্টানদের সব থেকে বেশি নির্মমতা লক্ষ্য করা যায়। এই বিষয়ে আমি পর্বগুলোতেই আলোচনা করব।
ধন্যবাদ ভাইয়া।
ছাইরাছ হেলাল
বাহবা, এটি আমার একটি প্রিয় বিষয়,
আপনি লিখছেন দেখে আরও ভাল লাগল।
খাটুনি যাচ্ছে খুব, বুঝিতো, চালু রাখতে হবে,
মৌনতা রিতু
খাটুনি আর কৈ তিনটা বই এর সমন্বয়ে লিখে যাচ্ছি। সব থেকে অসাধারন লেগেছে কি জানেন, অনেক বিখ্যাত মানুষও কিন্তু ক্রীতদাস ছিলেন। আসলে এই বিষয়ে বেশ কিছুদিন থেকেই পড়ছিলাম।
তাই ভাবলাম লিখে ফেলি।
ধন্যবাদ বরং আমিই দিতে চাই, কারন এই বিষয়টাকে পড়ার উপযোগি মনে করার জন্য।
নাসির সারওয়ার
অনেক ভালো একটা বিষয় যা পাঠকদের ইতিহাস জানতে সাহায্য করবে। উপরের মন্তব্যের জের টেনেই বলতে হয় – এ অনেক সময় এবং পরিশ্রমের কাজ যা আপনি ভালোই করছেন।
শুভেচ্ছা রইলো।
মৌনতা রিতু
তবে বেশ মর্মান্তিক বিষয়। তবে ইতিহাস আমির প্রিয় বিষয় তো এই জন্য লিখতে পারছি।
ধন্যবাদ ভাই।
পাশে থাকবেন।
শুন্য শুন্যালয়
এতকিছু সত্যিই জানা ছিলো না, যেমন সারভিল যুদ্ধ।
একটা মুভির দৃশ্য মনে পড়লো। কৃতদাসের নাম চেঞ্জ করে বসিয়ে রাখা হয়েছে সাড়ি করে। যখন নাম ডাকা হচ্ছিল, একজন নিজেও জানেনা তার এই নাম। নাম কল করা হচ্ছে, রেসপন্স না করায় তার উপর নেমে আসে অকথ্য চাবুক অত্যাচার।
ভয়াবহ ইতিহাস তুলে ধরছো, অবশ্যই তোমাকে অনেক ধন্যবাদ রাত বারোটা পর্যন্ত জেগে থাকলে জন্য 🙂
মৌনতা রিতু
তুমি Appocalipto দেখেছো? অসাধারন একটা মুভি। কিভাবে একদল আদিবাসী অন্য আদিবাসীদের বন্দি করে নিয়ে যায়। কি নির্মম সব দৃশ্য। এক সময় এমন কিছু সমাজ ব্যবস্থা ছিল তা ভাবা যায়!
আগামীকালের পর্বে নির্মমতা গুলো দিব।
ভাল থেকো।
-{@
নীহারিকা জান্নাত
ভয়ংকর কিন্ত সত্যি। ভাবতেই ভয় হয় তখন যেন পশু-পাখির চেয়েও অনিশ্চিত জীবন ছিলো মানুষের।
লিখতে থাকুন। সভ্যতার বিবর্তনের কিছু অজানা ইতিহাস আপনার মাধ্যমে জানা হয়ে যাক।
মৌনতা রিতু
পশু পাখিরও একটা স্বাধীনতা ছিল, ছিল ক্ষুধা নিবারনের পথ। কিন্তু এদের তাও ছিল না। খুবই নির্মম এক ইতিহাস সত্যি। আমি পড়তেই পারছিলাম না।
ইঞ্জা
খুব কমই জানতাম এইসব বিষয় যা আপনার লেখা পড়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ হচ্ছি, আপু আরো কিছু লিখুননা, আমরা জানি। 🙂
মৌনতা রিতু
আপনারা পাশে আছেন বলেই লিখার সাহস পাচ্ছি ভাইজু।
লিখার চেষ্টা করব।
ইঞ্জা
ধন্যবাদ।
নীলাঞ্জনা নীলা
আপু তোমার এই ধারাবাহিকটা খুব বেশী ভালো লাগছে। ইতিহাস আমার কাছে সবচেয়ে কঠিন একটা বিষয়, ইস তুমি যে কেন আমার শিক্ষক ছিলেনা? 😀
মৌনতা রিতু
ইতিহাস সত্যিছ খুব মজার বিষয়। আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক কঠিন ইতিহাসের উপর।
আপু, লজ্জা দিও না। আমি জানি তুমি অনেক পড়।
তোমার মতো একান্ত অনুভুতির প্রকাশ করার চেষ্টা করি কিন্তু পারি না।
ভাল থেকো আপু।
নীলাঞ্জনা নীলা
আরে কি যে বলো!
ইতিহাসে পাতিহাঁস
ভূগোলেতে গোল
অঙ্কেতে মাথা নাই
হয়েছি পাগল। বুঝেছো? 😀
শিপু ভাই
মানব সভ্যতা বিকাশে সবচেয়ে অসভ্য কাজ ছিল এই কৃতদাস প্রথা!
এই একুশ শতকেও কিন্তু কৃতদাস প্রথা রয়ে গেছে তবে ভিন্ন ফরমেটে, করপোরেট কালচারের মোড়কে!
তথ্যবহুল পোস্টে +++++
মৌনতা রিতু
হুম, কিন্তু এখন সেই ভয়াবহতা নেই।
নেই সেই রকম অত্যাচার। তবে মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মীদের উপর অত্যাচারের কথা শোনা যায়। মধ্যপ্রাচ্যের এই শ্রমিক ল চেঞ্জ হওয়ার কথা, হলে অনেকটা সহনীয় হবে এই শ্রমিকদের কাজের যায়গা।
ভাল থাকবেন ভাই।
সঞ্জয় কুমার
পড়া শুরু করলাম ।
দূর্বলের উপর সবলের অত্যাচার বোধহয় পৃথিবীর প্রথম থেকেই চলে আসছে