দক্ষিন কোরিয়া গিয়েছি কোনো ইলেকট্রনিক্স পণ্য কিনবো না তা কি হয়? দেশে বসে তো চাইনিজ ইলেকট্রনিক্স পণ্য কিনতে কিনতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি। কেনাডা, অষ্ট্রেলিয়া সহ কয়েকটি দেশ ভ্রমন করে অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, ঐ সমস্ত দেশেও চাইনিজ ইলেকট্রনিক্স পণ্য বিক্রয় হয়, তবে অবশ্যই তা সরকারের দেয়া নির্ধারিত গুনগত মান অনুযায়ী হতে হয়। যে কারণে একই প্রডাক্টের দাম আমাদের দেশে কম, অন্য দেশে বেশি। আমাদের দেশে বিক্রিত চাইনিজ প্রডাক্টের গুনগত মান কোন পর্যায়ে আছে এতেই বুঝা যায়।
কোরিয়ার তৈরী মোবাইল সেট কেনার জন্য সফর সঙ্গী এবং সিউলে চাকরী করেন এমন একজনকে নিয়ে চলে গেলাম ইয়াংসান ইলেকট্রনিক মার্কেটে। বিশাল এলাকা জুড়ে মার্কেট। যাবতীয় ইলেকট্রনিক্স এর সবচেয়ে বড় মার্কেট এটিই। সমস্ত ভবন গুলোই বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স এর পণ্য বিক্রয়ের বড় ছোট মার্কেট। একদিনে সব দেখা সম্ভব নয় ভেবে আপাতত মোবাইল কেনার দিকেই গেলাম।
বিশাল মার্কেটের দু ধারে সারি সারি মোবাইলের দোকান। দু একটি দোকানে ঢুকছি, কিছু সেট নাড়াচাড়া করে আবার বের হয়ে আসছি। একটি দোকানের সাইনবোর্ডের দিকে চোখ আঁটকে গেল।
13669817_199323823803639_7757000560880862491_n
বিসমিল্লাহ্ ডট কম। অন্য দোকানগুলোর চেয়ে একটু বেশিই ক্রেতার ভিড় এখানে। বিসমিল্লাহ্ বলে এখানেই ঢুকে পড়লাম। ৬-৭ জন ক্রেতা বিভিন্ন মডেলের মোবাইল, ট্যাব দেখছেন। বাইরের সাইনবোর্ড এবং ভিতরের আরবী লেখা দেখে বুঝলাম যে অন্তত একটি মুসলিম দোকানে এসেছি। ছোট খাট একজন লোক একসাথে সবাইকেই মোবাইলের কনফিগারেশন, মূল্য বলে যাচ্ছেন, কখনো ইংরেজীতে, কখনো আরবিতে হাসি হাসি মুখে। ফর্সা এবং কিছুটা লালচে চেহারা,মায়াবী চোখ, সেভ করেননি অন্তত দুই/তিন দিন। একবার তাকিয়ে দেখলেন আমাদের দিকে। আবার মনোনিবেশ করলেন ক্রেতাদের দিকে। কোরিয়ান তো নয়ই, বুঝতে পারছিলামনা কোন দেশের লোক। একবার মনে হল পাকিস্তানি, পাকিস্তানি হলে এ দোকান হতে কিনবো না। আফগানরাতো আরো লম্বা হবার কথা, ইরানী, ইরাকী নয় তো? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মনে মনে মিলাচ্ছি কোন দেশের হতে পারেন? দুষ্ট বুদ্ধি এলো মাথায়, সেই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়ে চলে গেলাম। স্পষ্ট এবং কিছুটা জোর দিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললাম ' ক্যামুন আছুইন ভাইজান ? '
চমকে আমার দিকে তাকালেন উনি, বললেন ' জি ভাল আছি আলাহামদুলিল্লাহ, আপনি কেমন আছেন? আপনার সাথে সবাইকে বিদায় দিয়ে কথা বলবো, বসুন কফি খান। '
আচ্ছা ঠিকাছে বসলাম 🙂 বলে বসে পড়লাম। ট্রিক্স এ কাজ দিছে, নইলে কতক্ষণ তার সাথে ইস্পিশাল ইংরেজীতে ভ্যাগর ভ্যাগর করতে হইত। পরিচয়ের পরে না হয় বুঝতো আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আমার সাথের দুজন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে। দোকানের এক সেলস ম্যানকে বললাম, ভাই কফিতে চিনি দিয়েন আলাদা করে।
13718777_199323737136981_2962066362543582637_n

সব ক্রেতাকে সন্তষ্ট করে বিদায় দিয়ে আমাদের সামনা সামনি হলেন এবার। নাম বললেন কিম আবদুল্লাহ
* ঘটনা কি ভাইজান, কিম লাগাইলেন যে নামের আগে?
# আমি কোরিয়ান নাগরিক। নাগরিকত্ব পেয়ে কিম হয়েছি 🙂
খুবই আন্তরিক একজন মানুষ। ১৮ বছরের বেশি সময় ধরে আছেন সিউলে। কোরিয়ান একজন হয়ে গিয়েছেন।
আন্তরিক ভাবেই বললেন কোন সেট ভাল, কোনটা কম ভাল। সিউলে যিনি জব করেন জহুর ভাই, তাঁর ইন্টারে পড়ুয়া দুই ভাগনির জন্য নিলেন দুটো সামস্যাং ট্যাব, যা আমাকেই বহন করে নিয়ে আসতে হয়েছে। সফর সঙ্গী হারুন আর রশিদ কিনলো দুটো সামস্যাং মোবাইল। আর আমি কিনলাম একটি ট্যাব এবং HTC মোবাইল, HTC সেট কিম আবদুল্লাহ ভাই নিজেই নিতে বললেন আমাকে। আলাপ এবং আমাদের ভাললাগার সূত্রে অন্যান্য দোকান থেকে বেশ কম মূল্যই নিলেন আমাদের কাছ থেকে। আমাদের কথা বার্তায় উনি এতই মুগ্ধ যে আবার দেখা হবার কথা জানালেন। তাকেও আমাদের ভাল লেগেছে। বিদেশ বিভুঁইয়ে এমন একজন আন্তরিক মানুষ পাওয়া ভাগ্যের বিষয়।
কেনাকাটা শেষ করে একটি সেলফিও তুললাম তাঁর সাথে। ব্লগ যে ফেইসবুক না এটা জেনেও নিজের ফটো আপলোডাইলাম 🙂
13769440_199323790470309_1208902592423702374_n

কাহিনী এখানেই শেষ হতে পারতো, কিন্তু হলো না। পরিচয়ের পরে দুই দিন ছিলাম আরো সিউলে। প্রতিদিন ফোন দিতেন উনি, কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা জানতে চাইতেন। দেশে ফেরার পূর্বের রাত ১ টায় ফোন দিলেন, আসবেন আমাদের হোটেলে। রাত একটা হচ্ছে আমাদের দেশের রাত দশটা। আমার শরীর এবং মন তো রাত দশটার মতই। বললাম চলে আসেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসলেন। প্রচন্ড পরিশ্রমী মানুষ। মোবাইলের দোকানের মালিক তিনিই। ইয়াংসান এলাকায় তাঁর আর একটি দোকান আছে। পজেশন সহই মালিক তিনি। ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসা আছে সিউলে। আছে সাপ্লাইয়ের ব্যবসা। ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালের অনেক মেডিকেল ইকুইপমেন্ট তিনি সরবরাহ করেছেন। কেমিকেলস রপ্তানিরকারক তিনি। একসাথে বিজনেস করারও প্রস্তাব দিলেন। বললেন ' ইকরাম ভাই, ভাল লাগার মানুষের সংখ্যা কম এই জগতে, কেন জানিনা আপনাকে ভাল লেগেছে আমার।' খুব আগ্রহ নিয়ে বলায় তাঁকে সরাসরি না করতে পারিনি। বলেছি ভেবে দেখি ভাই।
প্রতি বছর ঈদ দেশে করেন। চট্টগ্রাম এর মানুষ। কোরিয়ান কিম হলেও দেশকে ভোলেননি। দেশের রাজনীতির কথা বললেন। দেশকে নিয়ে তাঁর ব্যাকুলতা আমাকেও মুগ্ধ করেছে। কথা বলতে বলতে কখন ভোরের আলো ফুটে উঠেছে কেউই খেয়াল করিনি। শেষ কফির কাপে চুমুক দিয়ে স্বপ্ল সময়ের পরিচিত আত্মার আত্মীয় হয়ে ওঠা সোফায় এলানো সাদামনের মানুষটি বিদায় নিলেন আমাদের কাছ হতে।
13770275_199323833803638_5406993439265895127_n

আমি দেশে আসার পরেও প্রতিদিন কথা হয়। ঈদের পূর্বে তিনি দেশে এসেই ফোন দিলেন আমাকে। ইমোতে কথা হয় প্রায় রোজ। ভাল থাকুন প্রিয় মানুষ
কিম আবদুল্লাহ ভাইজান -{@

0 Shares

৫৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ

Thumbnails managed by ThumbPress