মানুষের আত্ম-ত্যাগের মধ্যেই রয়েছে কোরবানির মূল শিক্ষা। কেননা কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, “আল্লাহর কাছে এর গোশত কিংবা রক্ত পৌছায় না; বরং তাঁর দরবারে তোমাদের তাকওয়া পৌছায়”।  (সূরা হাজ্জ: ৩৭)। কোরআনের আলোকে বলা যায়, যারা তাকওয়ার সহিত কোরবানি করবে, তাদের কোরবানির পশুর রক্ত জমিনে পড়ার পূর্বে আল্লাহ সুবাহানা তায়ালা কবুল করে নিবেন। তাকওয়ার অর্থ হচ্ছে –আল্লাহ্‌র সঙ্গে শিরক ত্যাগ করে আল্লাহ্‌র প্রতি অন্তরে ভীতি, প্রেম এবং আনুগত্য প্রদর্শন করা। আল্লাহ্‌র রহমত এবং মেহেরবানী পাওয়ার জন্য, আল্লাহ্‌কে খুশ রাজী করার জন্য, মহান আল্লাহ্‌র প্রীতি ও ভালোবাসা লাভের উদ্দেশ্যে কোনো কিছু উৎসর্গ করা বা বিসর্জন দেয়াকে কোরবানি বলা হয়। আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান প্রত্যেক ব্যক্তির উপর কোরবানী হুকুম পালন করা ওয়াজিব। কোরআন এবং হাদীসের আলোকে জানা যায়, “১০ জিলহজ সকাল থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত যেকোনো সময় যাঁরা নিসাব পরিমাণ সম্পদ (সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা অথবা এ উভয়ের যেকোনো একটির মূল্য সমপরিমাণ) ব্যবসাপণ্য বা নগদ অর্থের মালিক থাকবেন বা হবেন, তাঁদের কোরবানি করা ওয়াজিব। হাদিসে রয়েছে, কোরবানি হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সুন্নত। এখানে সুন্নত অর্থ তরিকা, পদ্ধতি, আদর্শ, অনুসৃত বিষয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘ফা ছল্লি লিরব্বিকা ওয়ানহার’ অর্থাৎ হে নবী (সা.)! আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন। (সুরা কাওসার, আয়াত: ২)। রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারেকাছেও না আসে।’ (ইবনে মাজা)। হাদিসে আছে, কোরবানির দিনগুলোতে পশু কোরবানির চেয়ে শ্রেষ্ঠ আমল আর নেই”।

একমাত্র এবং শুধুমাত্র আল্লাহ্‌ সুবাহানা তায়লাকে খুশী রাজী করার জন্য, আল্লাহ্‌র প্রতি তাকওয়া প্রদর্শনের জন্য কোরবানি। মাংস খাওয়ার জন্য বা লোক লজ্জা বা চক্ষু লজ্জার ভয়ে কোরবানি দিলে তা আল্লাহ্‌র দরবারে কবুল হবেনা। কেননা কোনো দোয়া কবুলের জন্য বা ফলাফল লাভের জন্য তা মানুষের নিয়ত এবং আন্তরিকতার ওপর নির্ভরশীল। পাশাপাশি কোরআনে ইরশাদ হয়েছে ‘আপনি বলুন, আমার নামাজ, আমার কোরবানিসমূহ, আমার জীবন এবং আমার মৃত্যু সবই আল্লাহর জন্য, যিনি প্রতিপালক সমগ্র বিশ্বজাহানের।’ (সূরা আনআম:১৬৩)। উল্লেখ্য প্রত্যেক নবী-রাসূলদের সময়ে কুরবানীর বিধান প্রচলিত ছিলো।  ইহা মোটেই নতুন কিছু নয়। প্রত্যেকটি কোরবানির পশু মহান আল্লাহর নামে জবাই করতে হবে এবং এর ব্যাতিক্রম কোনো কিছু হলে কোরবানির পশুর মাংস খাওয়া জায়েজ হবেনা। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কোরবানির বিধান দিয়েছি। তিনি তাদেরকে জীবনোপকরণ স্বরূপ যে সকল চতুস্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর উপর যেন তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে, তোমাদের ইলাহতো এক ইলাহ।’ (সূরা হজ্জ:৩৪)।

কোরবানির মূল শিক্ষা এবং উদ্দেশ্য কী আমাদের বর্তমান সমাজে সুষ্ঠু সুন্দরভাবে এবং ধর্মীয় বিধিবিধান অনুযায়ী  প্রতিফলিত হচ্ছে কিনা তা আমাদের বিবেচনা করার সময় এসেছে। কেননা কোরবানি এবং কোরবানির পশুর মাংসের মধ্যে মহান আল্লাহ্‌ সুবাহান তায়লার অফুরন্ত নেয়ামত এবং কল্যাণ রয়েছে। নিহিত রয়েছে গরীব দুঃখী এবং আত্মীয় স্বজনের মধ্যে পারস্পরিক এবং সামাজিক বন্ধনের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কোরবানির পশুর মাংস নিজেরা খাওয়ার পাশাপাশি গরীব অসহায় আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশির মধ্যে বিলি-বন্টন করে দিতে হয়। ইসলামে ধনীর সম্পদের উপর যেমন এতিম অসহায় দুঃস্থদের হক আছে। ঠিক তেমনিভাবে কোরবানির পশুর মাংসের মধ্যেও গরীব দুঃখী, দু:স্থ আত্মীয় স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশির হক রয়েছে। কোরবানির পশুর মাংস দুঃস্থদের মধ্যে বিলি-বন্টনের মাধ্যমে ধনী-গরীবের ঈদ আনন্দের মধ্যে বৈষম্য হ্রাস পায়, উভয়ের মধ্যে আনন্দের ভাগাভগি হয়ে থাকে।  আর্থিকভাবে সক্ষম বা সামর্থ্যবানদের সঙ্গে গরীব দুঃখী অসহায় মানুষের পারস্পরিক এবং সামাজিক বন্ধন, ভ্রাতৃত্ব সৌহার্দ্য বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি কোরবানির পশুর চামড়ার টাকা এতিম অসহায় দু:স্থদের মধ্যে বাড়তি আনন্দ  প্রদান করে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় বর্তমানে ব্যবসায়ীদের অসাধু সিণ্ডিকেটসহ বহুমাত্রিক কারণে পশুর চামড়ার ন্যায্য দাম সুনিশ্চিত করা যাচ্ছে না। চামড়ার দাম নেই বললেই চলে। এটি গরীব দুঃখী অসহায় মানুষের অসহায়ত্বকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের পাশাপাশি গরীবের হক নিয়ে ছিনিমিনি খেলার মতো। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর কোরবানির উটকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন বানিয়েছি; তোমাদের জন্য তাতে কল্যাণ রয়েছে। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান অবস্থায় সেগুলির উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করো যখন সেগুলি কাত হয়ে পড়ে যায় তখন তা থেকে খাও। যে অভাবী, মানুষের কাছে হাত পাতে না এবং যে অভাবী চেয়ে বেড়ায়-তাদেরকে খেতে দাও। এভাবেই আমি এগুলোকে তোমাদের অনুগত করে দিয়েছি; যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।’ (সূরা হাজ্জ:৩৬)।

দেশ ভয়াবহ ভয়ংকর বৈশ্বিক মহামারি বা অতিমারি করোনাভাইরাসের দুর্যোগ এবং দুঃসহ ক্রান্তিকাল পার করছে। যা আমাদের জীবনধারা, আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে উলটপালট করে দিয়েছে। সংক্রমণ এবং মৃত্যু হার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতদসত্ত্বেও সমাজের কিছু ধনী, অর্থ-বিত্ত্বশালী মানুষ ইসলাম ধর্মের মূলবাণী, রীতিনীতি, অনুশাসন না মেনে সমাজে নিজেদের প্রাচুর্য, বিত্ত্ব-বৈভব, মিথ্যে দম্ভ, অহমিকা প্রকাশ করার লক্ষ্যে কয়েক লক্ষ টাকার পশু কিনে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নিজেদের জাহির করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। ফেইসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পশুর ছবি এবং ভিডিও প্রকাশের মাধ্যমে সবাইকে জানান দিচ্ছে কে কত বড় (?) এবং দামী পশু কিনেছেন।  ফলে তাঁরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা দিয়ে পশু কিনে কোরবানির মূল উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করছেন। অথচ এই অতিমারি বা মহামারি করোনাকালে অনেক গরীব দুঃখী অসহায় মানুষের পাশাপাশি নিম্ন-বিত্ত্ব বা নিম্নমধ্য-বিত্ত্ব মানুষ কর্মহীন হয়ে অনাহারে অর্ধাহারে দিনানিপাত করছে।  নিকট আত্মীয়-স্বজন,পরিবার-পরিজন, ভাই-বোন চক্ষুলজ্জার ভয়ে কারো নিকট হাত পাত্তে পারছে না, সাহায্য সহযোগিতা চাইতে পারছে না। এমন দুর্দিনে এসব অসহায় মানুষের কল্যাণে সাহায্য সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে এগিয়ে আসা মানবিক, নৈতিক এবং ধর্মীয় কারণে জরুরি এবং উচিৎ। আমরা সকলেই অবগত আছি যে, দান সাদাকা, যাকাত, ফিতরাসহ বিভিন্নভাবে গরীব দুঃখী আর অসহায় আত্মীয় স্বজনের সাহায্যে এগিয়ে আসা ইসলামের শিক্ষা। অথচ তা না করে বিরাট বিশাল পশু কিনে নিজেদের মধ্যে অশুভ অনভিপ্রেত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিযোগীতায় লিপ্ত রয়েছি। পাশাপাশি যারা নিজেদের অর্থ বিত্ত্ব বা সামর্থ্য অনুযায়ী ছোট আকারের পশু কিনছেন তাঁরা নিজেরা অনেকক্ষেত্রে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন বা হীনমন্যতায় ভুগছেন।  ধনীদের অনেকেই নিজের গরীব দুঃখী ভাইবোনসহ অন্যান্য আত্মীয় স্বজনদের খোঁজ-খবর নেয়ার গরজ বা দায়িত্ব পর্যন্ত পালন করছেন না যা ইসলামের ভিত্তি বা শিক্ষা নয়।

আল্লাহ্‌ সুবাহানা তায়ালার উদ্দেশ্যে কোরবানির পশু জবাইর মধ্যে আত্ম-ত্যাগের মহিমা শিক্ষার উৎকৃষ্ট উদাহরণ রয়েছে। নিজেদের সকল ধরণের আবেগ অনুভূতি লোভ লালসা মোহ মায়া মমতা অর্থের মায়া ও আমিত্বকে বিসর্জন দিয়ে মহান সৃষ্টিকর্তার দিকে বান্দাকে ধাবিত করাই কোরবানির উদ্দেশ্য। তাই পশু কোরবানির সঙ্গে সঙ্গেই নিজের ভেতর লুকিয়ে থাকা বর্বর, দানবীয় অপ পশু-শক্তিকে ত্যাগ করে নিজেদের প্রাত্যহিক জীবনে আমিত্ব, মিথ্যে দম্ভ অহমিকা বর্জনের কঠোর শিক্ষা নিতে হবে। পশু জবাইর মতো নিজের নফসকেও আল্লাহ্‌র প্রীতি ও ভালোবাসা লাভের উদ্দেশ্যে কোরবানি করে দিতে হবে। আমাদের কোরবানি ত্যাগ আর বিসর্জন তখনই সার্থক হবে যখন আমাদের মনের পশুকে সমূলে কোরবানী দিতে পারবো বা সক্ষম হবো। ফলশ্রুতিতে ব্যক্তি পরিবার সমাজ সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তি প্রশান্তি ভ্রাতৃত্ব সৌহার্দ্যের সুবাতাস বিরাজ করবে। সমাজ থেকে হিংসা, ঈর্ষা, বিদ্বেষ,  নিন্দা, ধর্ষণ, খুন, হানাহানি, রাহাজানি ও মারামারি দূর হবে। আত্ম-ত্যাগের মাধ্যমে আমরা একটি শুভ সুখী সুন্দর সমাজ এবং বাংলাদেশ কায়েম করতে পারবো। পাশাপাশি মহান আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিনের প্রীতি, ভালোবাসা, রহমত এবং নেয়ামত লাভ করতে পারবো ইন শা আল্লাহ্‌। আসুন কোরবানি ঈদের ত্যাগ এবং বিসর্জন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে প্রতিফলিত করি। 

0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ