স্কুল জীবনের কথা মনে করে আতংকিত হই আজো।
বন্ধের পর স্কুল খুলবে সেই আতংকে কি ভীষণ ভীত সন্ত্রস্ত দিন কাটাতাম। অন্যদের কথা জানিনা। তবে, আমার এমনটি হত। মনে আছে ক্লাস টু'তে পড়বার সময় আমার পচা হাতের লেখার খাতাটি ম্যাডাম ক্লাসভর্তি সকলকে উঁচু করে দেখিয়ে বলেছিলেন, " তোমরা কি কেউ বুঝতে পারো এখানে কি লেখা আছে ?" সকলে একযোগে হোহো করে হেসে উঠে। আর ছোট্ট আমি সেদিন লজ্জা, অপমানে আরও ছোট হয়ে গিয়েছিলাম। সেই সংকোচে নিজের ভেতরেই একরকম হীনমন্যতা কাজ করতো। অন্যদের সাথে মিশতে আড়ষ্ট হয়ে থাকতাম। পিছনের বেঞ্চিতে চুপটি করে বসে থাকতাম।
খ্রিষ্টান মিশনারি স্কুল শেষ করে যখন মাতৃপীঠ গার্লস হাই স্কুলে ভর্তি হলাম, সেখানেও ছিল ভয়াবহ আতংক। রওশন ম্যাডাম পড়া না পারলে বেত নিয়ে সামনে আসতেন। কখনো ডান হাত, কখনো বাঁ হাত মেলে ধরতে হতো। হৃদস্পন্দন বেড়ে যেত ভয়াবহ ভাবে।বুকের ভেতরটায় যেন কেউ খামচি দিয়ে ধরেছে। চোখ মুখ খিঁচে থাকতাম। অতঃপর ম্যাডাম তাঁর শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ঠাস্ঠাস্ মারতেন। ক'দিন সেই হাত ফুলে থাকতো, ব্যথায় গোঙাতাম সকলের অগোচরে। কখনো বা বারান্দায় রোদে দাঁড় করিয়ে রাখতেন একপায়ে। পা যদি এক পলকের জন্যেও মেঝেতে লাগতো, অমনি উঠে এসে ঠাস্ঠাস্।যেহেতু পড়া পারিনি বলে মার খাওয়া, তাই বাড়িতেও কাউকে বলা যেতো না এ অমানবিক নির্যাতনের কথা। সব শিশুর তো আর একই সমান মেধা কিংবা পড়া বুঝবার ক্ষমতা থাকে না। আমি সেই কম বুঝা কিংবা দেরিতে বুঝা টাইপের ছাত্রী ছিলাম। তাই স্কুল জীবন আমার কাছে দুঃসহ যন্ত্রণাময় একটি জীবন ছিল। খুব দুঃখ কষ্ট নিয়ে আজ শিক্ষক দিবসে বলতেই হচ্ছে __ ক্লাসের অন্যতম খারাপ ছাত্রীটির পাশে পরম মমতায়, নির্ভরতায় কোন শিক্ষক এগিয়ে আসেনি।কোনদিন কোন শিক্ষক জানতে চায়নি কেন পড়া পারছিনা, কিংবা কি সমস্যা।
সেদিনের শিশু আমি আজ দুই সন্তানের মা।
এখানে নিউইয়র্কের স্কুলগুলোয় প্যারেন্ট-টিচার কনফারেন্স হয় বছরে তিনবার। প্রতিবার রিপোর্ট কার্ড হাতে নিয়ে ছেলের শিক্ষকদের সাথে সেইসব মিটিং এ আমি তাঁর হাতের লেখা নিয়ে আলোচনা করি।সপ্তম ক্লাসে পড়া বড় ছেলে রিয়াসাত, যার হাতের লেখা এত ছোট, যা পড়া এবং বুঝা আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব।খানিক বিরক্তি, উদ্বেগ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করি কেমন করে সে রাইটিং এ ৯৮% নাম্বার পায় ! কিন্তু শিক্ষকরা প্রতিবারই আমায় আশ্বস্ত করে এই বলে যে__ "এখন টাইপিং এর যুগ, হাতের লেখা নিয়ে এত চিন্তিত হবার কোন কারন নেই, তাছাড়া আমাদের বুঝতে কোন সমস্যা হচ্ছে না। তুমি যদি এটি নিয়ে তাঁকে মানসিক চাপে রাখো, তাহলে সে মূল বিষয়টি লিখতে ভুল করবে কিংবা অমনোযোগী হবে।"
বছরের দুই মাস যখন স্কুলগুলোয় গ্রীষ্মের ছুটি থাকে, সেই সময়টাতে প্রতিটি পরিবার নিজেদের সাধ এবং সাধ্যের সমন্বয় করে যার যার মতকরে বাচ্চাদের নিয়ে আনন্দে মেতে উঠে। কেউ শহরের ভেতরেই আনন্দ বিনোদনে সময় কাটায়। কেউবা দূরের শহরে। এই যে এত হৈ হুল্লোড়, লেখাপড়া বিহীন ঘুরে বেড়ানো, এর মাঝেও আমার ছয় বছরের ছোট্ট রিহান মাঝে মাঝেই উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করে যায় অবিরত__ "আমি স্কুলে যাবো না ? কখন আবার স্কুলে যাবো ? আমি আমার স্কুল মিস করি, টিচার মিস করি... " এমন প্রশ্নে আমি আমার পিছনে ফেলে আসা সময়ের কথা ভাবি। আমার এমন একটি শৈশব প্রয়োজন ছিল, এমন কিছু স্মৃতি বড় বেশি প্রয়োজন ছিল, যেখানে আজ গর্ব করে বুক ফুলিয়ে বলতে পারতাম__ " আমি আমার স্কুল মিস করি, আমি আমার শিক্ষকদের মিস করি।"
শিক্ষকদের ছায়ায় পরম মমতায়, নির্ভরতায় ভাল থাকুক আমাদের শিশুরা।
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
Thumbnails managed by ThumbPress
১৭টি মন্তব্য
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
আজ শিক্ষক দিবস।এ দিবসে আপনার লেখা পড়ে আরো ভাল লাগল।জানলাম কিছু অজানা।সকল শিক্ষকের জন্য রইল সালাম।
রিমি রুম্মান
আপনার জন্য রইল শুভকামনা।
আবু খায়ের আনিছ
কিছু শিক্ষকের কথা মনে হলেই এখনো ভয়ে হাত পা শিতল হয়ে আসে যেমন তেমনি কিছু শিক্ষক এর কথা মনে হলে মনে হয় আবার যদি সেই সব শিক্ষকদের ছাত্র হয়ে পড়াশোনা করতে পারতাম।
রিমি রুম্মান
ভাল কিংবা মন্দ সবই গেঁথে থাকে আমাদের শিশুমনে।
ছাইরাছ হেলাল
যদিও আমার এমন অভিজ্ঞতা হয়নি (পড়া পারতাম), কিন্তু শিক্ষার নামে ভয়াবহ নির্যাতন
দেখেছি দিনের পর দিন, আতংকিত হয়েই।
এখনও সে সব দিনের কথা মনে হলে বাতাসে জালি জোড়া বেতের শিস কাটা আস্ফালন তুলে সামনে বসিয়ে
পড়া জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে। শিক্ষক নামের কলঙ্ক,
রিমি রুম্মান
ভালোদের সবাই ভালোবাসে, আদর করে। কিন্তু আমার মতন যারা মেধাবী নয়। কিংবা পড়া বুঝবার ক্ষমতা কম, তাঁদের কেউ ভালোবেসে মমতার হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে না, কেন পড়া পারছো না।
নীলাঞ্জনা নীলা
আমি লিখেছিলাম আগেও। ছাত্রজীবনে বেত দিয়ে দুটো মার খেয়েছিলাম। কিন্তু সেই স্যারদের আদর ও স্নেহও পেয়েছি। যার জন্যে কোনো অভিযোগ নেই। তবে আমি দেখেছি দেশে ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যেতে ভয় পায়। আর এখানে স্কুল খুলবে, সেটাই ওদের জন্য উৎসব। বরং স্কুল বন্ধ থাকলেই প্রচন্ড বোরড হয়ে যায়।
আমাদের দেশে শিক্ষালয়ে শাসন-ব্যবস্থা এমনই যে পড়া পারেনি, দাও মার। আর লেখার জন্য কতো যে কথা শুনতে হয় ছাত্র-ছাত্রীদের। যদিও আমাকে এমন অবস্থায় পড়তে হয়নি। কিন্তু আমার ভাই মুন্নার হাতের লেখা এতোটাই ভয়ঙ্কর যে সবাই ভয়ে থাকতো এক্সামিনার বুঝবে তো ওর লেখা?
রিমি আপু অনেকদিন পর নতূন পোষ্ট নিয়ে এলে। খুব ব্যস্ত? ভালো থেকো। -{@
রিমি রুম্মান
নীলা’দি, আমার মতন এমন বাজে অভিজ্ঞতা স্কুল জীবনে অনেকেরই আছে। ” লেখাটি প্রথমআলো ” পাবলিশ করেছে যে, তোমাকে সেই লিংকটি দিচ্ছি। অনেকেই তাঁদের ভয়াবহ সেইসব অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করেছে কমেন্টে। পড়ে দেখো। ভাল থেকো। ভালোবাসা ।
http://www.prothom-alo.com/durporobash/article/995447/%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%A8%E0%A7%8B-%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%A8-%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%A8%E0%A7%8B-%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%95-%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%A8%E0%A6%BF
নীলাঞ্জনা নীলা
পড়লাম আপু। হায়রে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আর আমাদের শিক্ষক!
মৌনতা রিতু
আমার অবশ্য এমন অভিজ্ঞতক হয়নি। আমিও পড়েছি মিশন স্কুলে। দুষ্টুর শিরোমনি ছিলাম আমি। কিন্তু আদর করত সবাই। অতিষ্ট হত স্যার ম্যাডামরা। হেডস্যার বলত,” ওমা পাস করবানে তো?” আমি শিড় দাঁড়া উঁচু করে বলতাম , “অবশ্যই স্যার”। এখন চোখে পানি আসে স্যারদের কথা মনে করে। তবে একজন স্যার ছিল বদ টাইপের। বোঝই তো।
অনেক ভাল থেকো আপু। ছেলেদের আদর রইল।
রিমি রুম্মান
ভাল এবং মন্দ সবকিছুই শিশুমনে দাগ রেখে যায়, তাই না ?
ইঞ্জা
আপনার লেখাটি আমাকে আমার স্কুল জীবনে ফেরত নিয়ে গেল আপু, বাচ্চাদের আমার আদর দিবেন।
রিমি রুম্মান
আমাদের স্কুল জীবন সবার মোটামুটি একই । একজনের সাথে অন্যজনের মিলেও যায় অনেক কিছু।
অনিকেত নন্দিনী
এবারে শিক্ষক দিবস উপলক্ষে একগাদা হাতে বানানো কার্ড পেয়েছি। সব কার্ডের মূল কথা একটাই – “আই লাভ ইউ মিস”। সেই কার্ডগুলো পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে আমার স্কুল আর শিক্ষকদের কথা। ক্লাস এইটে পড়ার সময়ে অংক শিক্ষক আমার ভালো নাম নিয়ে প্রায় প্রতি ক্লাসেই ইয়ার্কি মেরে অন্য সব ছাত্রদের সাথে নিয়ে খুব হাসতেন আর আমি লজ্জায় কুঁকড়ে থাকতাম। একটা পর্যায়ে নিজের নামটাকে ঘেন্না করতে শুরু করলাম। সেই ঘেন্না এতোটাই দীর্ঘায়ত হয়েছিলো যে কিছুদিন আগেও তা বলবৎ ছিলো।
মানিকগঞ্জ থেকে টিসি নিয়ে গাজীপুর আসার সময়ে আমার জন্মদিন লিখে দিয়েছিলো ৩১ শে জুন, তাও আমার আসল জন্মদিনের চেয়ে অনেকখানি এগিয়ে। এইটের স্কলারশিপ পরীক্ষার সময়ে এইটা কেউ খেয়াল করেনি, খেয়াল করলো নাইনের রেজিস্ট্রেশন করার সময়ে। তারপর ক্লাসভর্তি ছাত্রছাত্রীর সামনে দাঁড় করিয়ে, “কিরে, তুইতো অহনো হসই নাই” বলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন আর আমি লজ্জায় মাথা নুইয়ে এতোটুকুন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমাদের অধিকাংশ শিক্ষকই খুব অভদ্র ছিলেন। আমাদের লজ্জাকর অবস্থায় ফেলে দিয়ে মজা নিতেন। 🙁
রিমি রুম্মান
আমাদের সময় এমন কার্ডের প্রচলন থাকলে আমি নিশ্চয়ই মনের কষ্টগুলো গুছিয়ে লিখে দিতাম সেইসব কার্ডে। দুর্ভাগ্য আমার যে আমার সময়ে শিক্ষকদের সামনে গুটিসুটি মেরে থাকতাম ভয়ে ।
ব্লগার সজীব
আমার সাথে কোন শিক্ষক খারাপ ব্যবহার করেননি। বরং অনেক সময় সবাইকে পড়া জিজ্ঞেস করলেও আমাকে করতেন না। ফান করতাম ক্লাস মেটদের সাথে, স্কুলের সবাই এটি জানতো। তবে ক্লাস মেটদের সাথে শিক্ষকদের খারাপ ব্যবহার কষ্ট দিত আমাকে। অনেক কথা মনে পড়ে গেল আপু।
রিমি রুম্মান
হুম, পড়া না পারলেও অনেকেরই শিক্ষকদের মনে দাগ কাটার অসীম ক্ষমতা থাকে। আমি অথর্বটা কোনদিকেই ছিলাম না। 🙁