কেবিন নং ৫০৭

মনোয়ারা সুলতানা সোনিয়া ৯ জুলাই ২০২০, বৃহস্পতিবার, ০১:২৪:৪৩অপরাহ্ন গল্প ১৯ মন্তব্য

কেবিন নং ৫০৭

পরপর দুটো বাচ্চার পর ছোট মেয়েটা যখন পেটে এলো, সত্যি বলতে কি, তেমন কোন অনুভূতি আমাকে ছুঁয়ে যায়নি। নিয়তির এ অবধারিত রীতিকে অবশ্যম্ভাবী বলেই ধরে নিয়েছিলেম। পিঠেপিঠি দুটো ছেলেকে বড় করে তুলতে গিয়ে আমি সত্যিই খুব ক্লান্ত ছিলাম। আমার স্বামী ডাক্তার। কাজের ক্ষেত্রে সফল তিনি। হাসপাতাল চেম্বার মিলিয়ে সারাদিন বাইরেই থাকেন। আমাকে একা হাতে বাচ্চা দুটোকে সামলাতে হয়েছে। তাই ছোট মেয়েটা যখন পেটে এলো মিথ্যে বলবো না আমি খানিকটা মুষড়ে পড়েছিলাম। আমার স্বামী বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি অভয় দিয়েছিলেন। হাসপাতাল থেকে ফিরে দুপুরের খাবার একসাথে খেতে শুরু করলেন। ওদের বাবাকে রোজ দুপুরে ঘরে ফিরতে দেখে বাচ্চারা খুশী হলো খুব। খাবার পর খানিক বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যের মুখে চেম্বারে যেতেন তিনি। চেম্বারে রোগী দেখাও কমিয়ে দিলেন। রাত দশটা নাগাদ ঘরে ফিরতে শুরু করলেন।

অথচ, এর কিছুই আমার ভেতরের স্বস্তি আনতে পারছিলো না। পেটের বাচ্চাটা বড় হচ্ছে আর আমার শরীরে অদ্ভুত একটা অশরীরী অস্বস্তি দানা বেঁধে উঠছিলো। সময় থেমে থাকে না। দেখতে দেখতে ন মাস পেরিয়ে এলাম। রোজার মাস শুরু হয়ে গিয়েছিলো। শারীরিক কোন সমস্যা না থাকলেও, কেমন একটা থমথমে মানসিক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হলাম।

পেইন নেই। কোথাও কিছু অনুভব করছিলাম না। অথচ, ডেট ওভার হয়ে গেছে। যথারীতি হাসপাতালে ভর্তি হবার পর থেকে একজন ডাক্তার সারাদিন চেষ্টা করলেন। কিছুতেই নরমাল ডেলিভারি হলোনা। অবশেষে সিজার করার সিদ্ধান্ত হলো। বিকেল পাঁচটায় সিজারিয়ান করে আমার মেয়েটার জন্ম হলো। আমার কোল আলো করে একটা ছোট্ট ফুটফুটে রাজকন্যা এলো। এনেস্থেসিয়ার কড়া ডোজের জন্য সে রাতে খুব একটা জ্ঞান ছিলো না। ডেলিভারি নরমাল হবে ভেবে একদিনের প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলাম। সিজারিয়ান হ‌ওয়াতে দিন পাঁচেক থাকতে হবে।

দ্বিতীয় দিন ঘোর ঘোর চোখে মেয়েটাকে দেখলাম। কে যেনো একটা ছোট পুতুল আমার হাতে এনে দিলো। অবাক হয়ে আমাকে দেখছে পুতুলটা। আমার চোখে জল এলো। আল্লাহ এ কেমন মায়ায় মানুষকে বেঁধেছেন! সে রাতে মাঝে মাঝেই জেগে মেয়েটাকে দুধ খাওয়াতে হলো।  ঘুম ভালো হলো না। খাপছাড়া ঘুম হলো।

তৃতীয় দিন থেকেই অশরীরী অস্বস্তিটা আবার ফিরে এলো। গা ছমছম করছিল। থেকে থেকে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিলো। চোখ বন্ধ করতে পারছিলাম না। চোখ বন্ধ করলেই ভয় করছিল। আমার দুই ননাস হাসপাতালে আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন। মেজো জনকে কাছে ডেকে ভয়ের কথাটা খুলে বলি। উনি সেহেরী খেয়ে নামাজ পড়ে আমার হাত ধরে দোয়া কালাম পড়লেন আর আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানিনা। ঘুমের মধ্যে দেখলাম আমি একটা বড় উঠোনে দাঁড়িয়ে আছি। চারপাশে কিছুই চেনা যাচ্ছে না। আমি এখানে কি করে এলাম? কার সাথে এলাম? আমি একা কেনো? এতসব ভাবতে ভাবতেই আচানক টের পেলাম একটা অদৃশ্য শক্তি আমাকে ঘূর্ণির মত সজোরে ঘোরাতে ঘোরাতে ছুঁড়ে ফেলে দিল। দারুণ আতঙ্কে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আর চোখ মেলার সাথে সাথে দেখলাম আমার মেজো ননাস চেয়ার থেকে পড়ে গেলেন। আমি ভয়ে থরথর করে কাঁপছিলাম। তিনি উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি আমার স্বপ্নের কথা আপাকে বললাম। অদ্ভুত! আপা বললেন, তিনিও এক‌ই স্বপ্ন দেখেছেন! এবং ছুঁড়ে মারার কারনেই তিনি চেয়ার থেকে পড়ে গিয়েছিলেন।

পরদিন দিনের বেলায় আর তেমন কিছু অনুভব করিনি। সন্ধ্যায় আপারা ইফতার করে নামাজ পড়ে গল্প করছিলেন। এমন সময় আবার সেই গা ছমছম করা অনুভূতি। আমি নড়াচড়া বা কোন আওয়াজ করতে পারছিলাম না। স্পষ্ট দেখছিলাম একটা গলিত রক্তাক্ত হাত আমার উপর আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছিল। হাতটা থেকে টস টস করে চুইয়ে পড়ছে রক্ত। ভীষণ আতঙ্কে আমার সারা শরীর কাঁপছিল। সারা গা  ঘামে ভিজে জবজব করছে। আমি কিছুই করতে পারছিলাম না। ঠিক এমন সময় কেবিনের দরজা খুলে আমার দেবর ঢুকলেন। দেখলাম সাথে সাথে হাতটা পিছু হটে গেলো। দেবরের হাতে সিগারেট ছিলো। তিনি পরে আসছি বলে চলে যেতে চাচ্ছিলেন। তখনই হাতটা আবার আমার দিকে এগিয়ে আসছিলো। আমি অস্ফুট শব্দ করে দেবরকে বলেছিলাম সিগারেট নিয়ে ভিতরে আসতে। তিনি আমার কথা শুনলেন। তিনি আসার সাথে সাথে হাতটা কোথায় মিলিয়ে গেলো।

আপাকে সব খুলে বললাম। তিনি কেবিনে মোমবাতি জ্বালানোর ব্যবস্থা করলেন। একজন হুজুর ডেকে কেবিনের সব কোনে আজান দেয়ালেন। সে রাতে নিজের বিছানায় না শুয়ে মেয়েকে বুকে নিয়ে এটেনডেন্সের বেডে রাত পার করলাম। সারা রাত আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে মেয়েটার প্রাণ ভিক্ষে চেয়েছি। সকালে ডাক্তার আসতেই অনেক অনুরোধ করে বাসায় চলে গেলাম। বাসায় যাওয়ার পর মেজো ননাস আপা খুব অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন।

মেয়েটা যখন ছ মাস বয়সী, তখন আমার এক দূর সম্পর্কের মামী আমাদের বাসায় বেড়াতে আসেন। মামীকে দেখে আমি খুব অবাক। পুরো কঙ্কালসার হয়ে গেছেন উনি। তাঁরও এক মেয়ের জন্মে হয়েছে কিছুদিন আগে। আর তারপর থেকেই জ্বরে ভুগছেন তিনি। তাঁকে দেখেই আমার ভেতরটা কেঁপে উঠেছিলো। একথা সেকথার পর জানতে চাইলাম, ডেলিভারি কোন হাসপাতালে? হাসপাতালের নামটা বলতেই আমার সারা গা জমে শক্ত হয়ে গেলো। তারপর তিনি অভিশপ্ত কেবিনটার কথা বললেন। তিনি বলেই চলেছেন। কিছুই আমার কানে আসছে না। আমি যেনো তাঁর পাশে থেকেও দূরে কোথাও চলে গেছি। তিনি বলেই চলেছেন। আমি শুনছিলাম না। আমি জানি তিনি কি দেখেছেন। আমি জানি তিনি কোন কেবিনে ছিলেন। কেবিন নং ৫০৭।

0 Shares

১৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ লেখা

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ