কৃষক হয়ে ওঠার গল্প:

ছোটবেলায় কলাগাছের বাকল তুলে তুলে নৌকা বানাতাম। কলার পাতা কেটে ঘোড়া, হাতি, গরু এসবও বানাতাম। বাবা রাগ না করে বলতেন, “কলা রুয়ে না কেটো পাত, তাতেই কাপড় তাতেই ভাত।” কলা মানুষ খায়ই না আবার ভাত কাপড় সব হবে! এমন মনোভাব আর কলা গাছ কাটতে না পেরে মন খারাপ হতো। আজ খণার বচন সত্যি হয়েছে কারন কলার হালি ৩০ টাকা।

ভাইয়া পাশের ছোট্ট নদীতে আমাকে পিঠে নিয়ে যেতেন মাছ ধরতে। বালতি ভরা মাছ পেলে খুশিতে তার চোখমুখ ঝলকে উঠতো। বাবা মাছ দেখে বলতেন- “মৎস্য মারিব খাইবো ভাত, লেখাপড়া আমার কিসের উৎপাত।” আমিও খুশিতে টগোমগো বাহ্ আর পড়াশুনা করতে হবে না। বাবা হেসে বলতেন ওটা কথার কথা। পড়াশুনা করেই ভালো মৎস্য শিকারী হওয়া যায়। তাতেই লাভ বেশী। তোমার ভাইয়াকে দেখছো না!

-বাবা আমি তো মেয়ে।

-ছেলে মেয়ে বলে কোন কথা নেই। এই খনাও তো একজন মহিলা। আজ থেকে কত বছর আগে কত জ্ঞানী জ্ঞানী কথা বলে গেছেন।

-তোমাকে লোকে ‘ফকির’ ডাকে চাষবাস করো বলেই!

-‘খন্দকার’ তাই মজা করে ডাকে। ওটাও ভালোবাসা।

তখন সারাবছর অনেক মানুষ আমাদের বাসায় কাজ করত। মা তাদের জন্য রান্না করেন, বাবা স্কুলে আমি তাদেরকে খেতে দেই। কি পরম তৃপ্তিতে ঢেঁকুর তুলে, গোগ্রাসে খায়। খাবারেই যেন পৃথিবীর সকল শান্তি!

-বাবা আমিও কামলা হবো? তখন এমন করে খাব। -উমহুম! তুমি খাদ্য যোগানদাতা হবে। কৃষকের সন্তান খাদ্য উৎপাদনকারী হবে।

ভালোলাগা ছোঁয়াচে। তাই ভালোলাগার মানুষ থেকে পাওয়া তার কাজ আমাকে পেয়ে বসলো। তারপর একসময় উত্তরাধিকারে কৃষক। মামারা কি সুন্দর খুশি হয়ে বিকেলে লুঙ্গির কোচায় মজুরীর চাল নিয়ে যায়। পরদিন আবার হাসতে হাসতে সকালে চলে আসে। এমন সৌহার্দ্যপূর্ন সাহচর্যও যেন ভালো লাগে। তখনকার সময়ে শ্রমিকরা টাকার চেয়ে সম্মান করতে জানতো। আন্তরিকতা ছিল ঢের বেশি। কাজ না থাকলেও এসে ভীড় করতো। মা খেতে দিতেন। খুব সামান্য হলেও ভালোলাগায় খেত। সবসময় পাশে পাশে থাকার চেষ্টা ছিলো।

একসময় খেয়াল করলাম গ্রামের মানুষ, তাদের কথা , আচরণ সর্বোপরী সাহচর্যও ভালো লাগতে শুরু হলো। আমরা তাদের মামা- চাচা ডাকি। তারাও মা ডাকে।

বাকিটুকু পূর্ণ হলো পড়াশুনা শেষ করে। প্রথম জব নিলাম ‘কেয়ার বাংলাদেশ’ এ। একই জমিতে কিভাবে মাছ ও ধানের চাষ করা যায় সেই প্রজেক্ট। লোকজনকে শেখাতে শেখাতে সেখান থেকে দুবছরে পরিপূর্ণ শিক্ষা হয়ে গেল।

এমনি করে মাটির সাথে, জমির সাথে প্রেম হয়ে গেলো। প্রেম হলো ছোট্ট চারা গাছটির প্রতি, কিভাবে সে মা হয়। তাকে যখন জমিতে লাগানো হয় ফুলশয্যার ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মতো তিনদিন হলুদ হয়ে চুপটি করে জমিতে থাকে। চতুর্থদিন প্রেম হয় মাটির সাথে, এরপর অনেকগুলো বাচ্চা হয়। বাচ্চাগুলোও কিশোরী থেকে যুবতী হয়ে ওঠে। ১০০/১১০ দিনে পরিপুষ্ট কনকনে পেট উগরে জন্ম দেয় ধানের।

বেশ কিছু বছর পরে এসেও জমির সাথে সেই সখ্যতা, সেই প্রেম থাকলেও প্রেক্ষাপট বদলেছে। শ্রমিক শ্রেণীও অনেকটা হিসেবী, কমার্শিয়াল হয়েছে। সময়ের সাথে বদলে গেছে নিম্নশ্রেনীর মানুষের আচরন। তাদের ছেলেমেয়েরাও শহরমুখী হয়েছে, গার্মেন্টসে চাকুরী করে। আয়- ব্যয়ে তারা বেশ সচেতন।

এখন আর আগের অসচ্ছল অবস্থায় তারা যেহেতু নেই। তাই সেই সম্মান, সেই বোধ তাদের আর কাজ করে না। মন বাদশা হয়ে চলে। ফলে কৃষক ধান মাডাইয়ের সময় পড়ে যায় চরম বিপদে। অতি উচ্চমূল্য দিয়েও শ্রমিক পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও তারা বেশি সময় কাজ করতে চায় না। অতিযত্নে সন্তানের মতো করে লালন করা জমির ধান অনেকসময় নষ্ট হয়। যদিও অনেক কষ্টে বেশিমূল্যে ধান ঘরে তোলা হয়। তারপর দেখা যায় তার ন্যায্য মূল্য কৃষক পায় না। বছর বছর লসের খাতায় নাম লেখাতে লেখাতে, তাই বাধ্য হয়ে এখন অনেক বনেদী সম্ভ্রান্ত কৃষক জমিজমা বিক্রি করে শহরে পাড়ি জমিয়েছে।

চলবে——

ছবি আমার

0 Shares

২১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ