বাঙ্গালী ভোজন রসিক। নারীরা রাঁধতে ভালোবাসে, আর পুরুষরা খেতে ভালোবাসে। ভালোবাসা সেই বউয়ের জন্য ততোই গভীর; যে বউ রান্নাঘরে ভোজন রন্ধনে অধিকক্ষন। কারন পুরুষের ভালোবাসা নাকি পেট থেকে শুরু হয়!!

আমরা ভোজনরসিক জাতি নামে পরিচিত হলেও ঈদানিং ‘ স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’ একথাও ভাবছি। আর অনলাইনের বদৌলতে জিরো ফিগারের নানা পদের পরামর্শে আমরা অস্থির। সচেতন হতেই হবে। তাই কারিনা কাপুরের সেই জিরো ফিগারের ‘কিটো ডায়েট’ বর্তমান খুবই জমজমাট। সেটা কার শরীরের জন্য উপযোগী আর কার জন্য নয় এটা ভাবারও ফুরসত নেই।

কদিন আগে দুপুর বেলার ঘটনা। আমার মামীমা দোতলা থেকে  নেমে আর উঠতে পারেন না। আমাকে কেউ এসে খবর দিল দৌড়ে গিয়ে দেখি, বেচারী সিঁড়ির পাশের রুমে পরে আছেন। বহুসময় মাথায় পানি ঢালার পর কিছুটা স্বাভাবিক হলে উপরে নিয়ে গেলাম। বাপরে বাপ! একশ কেজির ভারী মানুষ কি কষ্ট; কি কষ্ট। তিনদিন আমার কোমর ব্যথা যায় না।

শরবত খাওয়ানোর পর তার কাছে আসল ঘটনা জানা গেল। মামীমার বয়স ষাটের কাছাকাছি। কে বা কাহার শলা-পরামর্শে তিনি কিটো ডায়েট শুরু করেছেন। যার পরিনতি আজকের অজ্ঞান হওয়া। ষাট বছরের একজন মানুষের পক্ষে কিটো ডায়েট কতটুকু প্রযোজ্য।এটা আমরা দেখার প্রয়োজন মনে করি না কিংবা ভাবিও না। জীবনভর খেয়ে খেয়ে এখন একশ কেজি ওজন হয়েছে আর নরতে- চড়তে পারি না তাই বাঁচার আশায় কিটো ডায়েট করতে নেমে পরি। একবার ভাবিও না যে, অবশ্যই একজন জাক্তারের পরামর্শ নেবার পরই তা শুরু করা দরকার।

আমার খুব প্রিয় ছোটবোন বিয়ের বছর খানেক হবে। কিছুদিন আগে দেখা, সে ছয়মাসের প্রেগন্যান্ট। সবাই অনেক খুশি। কদিন বাদ শুনি সে অসুস্থ, হাসপাতালে। জানা গেল, এবরশান হয়ে গেছে এবং তার অবস্থাও ভালো না। শরীরে  মা হবার জন্য যা যা দরকার তা একেবারেই কম। সেজন্যই এমন হয়েছে।খুব কষ্ট পেলাম।

আমরা তার বিয়ের দাওয়াতে ছিলাম। হলুদের অনুষ্ঠানে ছিলাম। জমজমাট হলুদ অনুষ্ঠান তাকে খুব সুন্দর লাগছে। মেয়েরা নাচানাচি করছে। শুধু একটা কারনে আমার কাছে ফিকে মনে হল। হলুদের অনুষ্ঠানে কনের সামনে থাকবে বহুপদের মিষ্টি। তা নেই এমনকি একটু পায়েশও নেই। মিষ্টির বদলে শশা, গাজর, পেঁপে, আনারস, আপেল আঙ্গুর এসব। মনটা পানসে হয়ে গেল। একটু মিষ্টিমুষ্টি খেতাম তা আর হল না।

একফালি শশা খেয়ে তাকে হলুদ পরিয়ে বিদায় নিলাম। বোনটি একজন বোটানির শিক্ষক তার আমার চেয়ে জ্ঞান বেশিই থাকার কথা। শরীরে কি কি খাবার কেন, কখন, কি পরিমাণ দরকার হয়!

বয়স ধরে রাখার জন্য এই বোনটি আগে থেকেই নরমাল ডায়েট করত। যেমন- চিনি ছাড়া চা, ভাত কম,সবজি বেশি, অযথা খাবার দাবার এডিয়ে চলত। এসব মেনেই চলত বলেই ফিজিক্যাল ফিটনেস মাশাআল্লাহ সুন্দর তারপরও বিয়ের আগে সে ‘কিটো ডায়েট’ শুরু করল। একমাসে না কতদিনের মধ্যে পাঁচকেজি ওজন কমে যাবে এ আশায়। আমি খেয়াল করলাম তার ঠোঁট শুকনো ও ফ্যাকাশে হবার পরও সে খাচ্ছে না। এ অবস্থায় কলেজও করছে এবং সেদিন তার সবজি ডে ছিল। আমি মনে মনে হাসলাম।

জীবনভর খেয়ে খেয়ে হঠাৎ করে আপনি কিটো শুরু করলেন। ঝাঁক করে শরীরের পাঁচ-সাত কেজি ওজন একমাসে কমে গেল। যা সবসময় আমার কাছে অসম্ভব একটা ব্যাপার বলে মনে হয়। তারপর কিটো শেষ করে আবার আগের জীবনে ফিরে গেলেন। মানে শুরু হল আগের খাওয়া- দাওয়া। একই টেবিলে খেতে বসা অনেক মানুষকে দেখেছি এক চামুচ ভাত আর একটা করে পদ খেতে খেতে অনেক খেয়ে ফেলে। কিছু মানুষ প্রতিদিনই ভাবে আজই শেষ এরপর আর খাবো না। তারপর আবারও খায়।

কিটো ডায়েট করে আবার আগের অবস্থায় গিয়ে লাভের লাভ কিছুই হয় না; শুধু শরীরটাকে কষ্ট দেয়া আর মারাত্বক কিছু ঘাটতি শরীরে তৈরি করা হয়। যার পরিনতি বয়স যত বাড়ে, ততই শরীরে অনেক জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়।

এখন আসি আসল কথায়। আমি কিটো ফিটো বুঝি না আর আমি ডাক্তারও না। একজন সচেতন মানুষ হিসেবে যতটুকু বুঝি তা হল ‘রুটিন’। আমার কাছে জীবন একটা সহজ হিসাব; সহজ রুটিন। জীবনকে সুন্দর রাখতে কিটো নয়, সহজ রুটিন মেনে চলি।

বিশ পেরোবার সাথে সাথেই আমাদের জীবনাচরনে একটা রুটিন করে নেয়া উচিত। হালাল প্রত্যেকটা খাবারই আমরা খাব কিন্তু সেটা পরিমান মত। বিয়ে, দাওয়াত যেটাতেই যাই না কেন সবটাই অল্প অল্প খাব। দাওয়াত বাড়িতে কুকুর পেটা করে খেয়ে পরে তিনদিন না খেয়ে থাকা এটা অনুচিত।

ঘুমের বিষয়টি মাথায় রাখা জরুরী যেমন- সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠা, নামাজ আদায় করা।কারন নামাজ একটি কার্যকর ব্যায়ামও বটে।তা না হলে কিছুক্ষন হাটাহাটি করা। সকালে অবশ্যই খালি পেটে কিছু  পানি পান করা জরুরী; যা না করে আমরা সরাসরি কড়া চা কিংবা কফিতে চলে যাই। বরং হাল্কা বিস্কিট এর সাথে আদা চা শরীরের জন্য উপকারী। সারে সাত থেকে আটটার মধ্যে নাস্তা সেরে নেয়া। অনেকেই আছেন প্রচুর চর্বিযুক্ত মাংস, ডাল এসব দিয়ে ছপছপে তেলে ভাজা পরোটা খান, খিচুড়ি খান এগুলো এডিয়ে চলা উচিত। আমাদের অনেকের রুটিতে এসিডিটি হয় তারা সবজি ডাল,ডিম,মাছ এসব দিয়ে কাপখানেকের মত ভাত খেতে পারি। পেট টইটুম্বুর করে কখোনোই খাব না, পেটের এক তৃতীয়াংশ খালি রেখে খাওয়া উচিত। প্রতিদিন একই সময় খাবার খাওয়ার চেষ্টা করব। রাতের খাবার অবশ্যই আটটার মধ্যে শেষ করব এবং দশটার মধ্যে ঘুমুতে যাব।

আমরা অনেকেই সকালের খাবার দেরিতে , দুপুরেরটা বিকেলে, রাতেরটা দশটা এগারোটায় খাই। এবং মধ্যরাত পর্যন্ত জেগে, একটা- দুটোতে ঘুমুতে যাই। পরদিন উঠি দশটা- বারোটায়। এমন কাজ কখোনোই করা উচিত নয়।

সুস্বাস্থ্যের জন্য একটা সুন্দর রুটিনই যথেষ্ঠ অযথা কিটো ফিটো করে নিজেকে কষ্ট দেবার কোন প্রয়োজন নেই!!!! ‘কিটো ডায়েট’ ইয়াং এবং বয়স্ক সবার জন্যই ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে বলে আমি মনে করি। যার শরীরে যতটুকু খাবার প্রয়োজন ততটুকুই খাওয়া উচিত।তরুনরা জিরো ফিগার বানাতে গিয়ে অনেক সময় শরীরের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ছে আর যাদের ওজন বেডে একাকার তারাও হুট করে কমাতে গিয়ে নানা সমস্যায় পরে যাচ্ছেন।বরং আমরা সবসময় পরিমিত ও সুষম খাবার খাব এবং নিয়ম মাফিক জীবন যাপন করব।

সবাই ভালো থাকুন! সুস্থ থাকুন এই কামনা!!!!!

ছবি- নেট থেকে।

0 Shares

২৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ