কার্তিকের চাঁদ

উর্বশী ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, শনিবার, ১০:২১:৩৮অপরাহ্ন গল্প ৪০ মন্তব্য

সায়ন্তনির ঘুম খুব পাতলা। জানালার বাইরে মৃদু  ঠুক-- ঠুক  শব্দ কানে আসায় সে চোখ মেলে তাকায়। বাইরে দাড়িয়ে খুব সাবধানে জানালার কপাটে কেউ টোকা দিচ্ছে।সায়ন্তনি খুব সাহসী মেয়ে। দেরি না করে বিছানায় উঠে বসে ভিতর থেকে টিটকিনি  তুলে এক পাশের কপাট মেলে ধরে। গভীর রাতে এভাবে ছিটকিনি খোলাটা বেশ ঝুকিপূর্ণ। গ্রামের বখাটে ছেলেপেলেরা প্রেমে দাগা খেয়েগভীর রাতে   জানালা খোলা পেলে এসিড ছুঁড়ে মারে। এসিড কার গায়ে ছুড়লো তা মূখ্য বিষয় নয়।ছোঁড়ার পরে আর জানালার কাছে দাঁড়িয়ে  থাকেনা।  এসিড ছুঁড়ে তাদের প্রতিশোধের জ্বালার উপশম ঘটায়। এটাই  তাদের কাছে মুখ্য বিষয়। গ্রামে দেখতে শুনতে একিটু ভাল হলে,বিয়ের কথাবার্তা চলাকালীন সময়ে ব্যাপার গুলো বেশী ঘটে। যিদিও বেশীরভাগ ছেলেরই প্রেম থাকে এক তরফা। মেয়ের দিক থেকে কখনোই কোন সাড়া পায়নি।তবুও সেই মেয়েটিকেই নিজেদের সম্পত্তি হিসাবেই গন্য করে। গত বছর টিনার বিয়ের সময় এমন টাই হয়েছিল। টিনা  সায়ন্তনির খুব ভাল বান্ধবী।  দেখতে সায়ন্তনির থেকে অনেক সুন্দরী। গ্রামের প্রায়  তিন ভাগের দুইভাগ ছেলেরাই টিনার পিছনে ঘুরতো। সে যাই হোক এসিড টিনার মুখে পড়েনি।পড়েছিল টিনার মায়ের কোমরে দিকে। কদিন বাদে মেয়ে পরের বাড়িতে চলে যাবে,তাই শেষ কটা দিন মা -- মেয়েতে এক সাথে ঘুমাচ্ছিল। দিন তিনেক বাদে পোড়া কোমর নিয়েই মেয়েকে পার করেছিলেন টিনার মা।

সায়ন্তনির বিয়ের কথাবার্তা চলছে। পাত্রের লম্বা লিষ্ট কাট-- ছাঁট করে তিনজন  ছেলেকে বাছাই করা হয়েছে। সায়ন্তনিকে সুযোগ দেয়া হয়েছে তার মতামত জানাবার জন্য। সচারাচর গ্রামের মেয়েদের এরকম সুযোগ দেয়া হয়না।   সায়ন্তিকে দেয়া হয়েছে তার বাবা তাকে অত্যন্ত আদর করেন,এটা বড় কারণ।

সায়ন্তনি জানালা খুলে দেখে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সোপান।  তার বাবা-- মায়ের ঠিক করা তিনজন  পাত্রের একজন। সোপান ওদের গ্রামের ই ছেলে।বাকি দুজন পাশের গ্রামের ছেলে তারা। সোপান কিছুটা উড়নচণ্ডী প্রকৃতির। পাত্র বাছাইয়ের  ক্ষেত্রে এখনো চুড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি সায়ন্তনি। তবে পাত্র হিসাবে সোপানের নাম টি সবার উপরেই রেখেছে। ছেলেটাকে সে ছোট বেলা থেকেই চেনে। তা ছাড়া সোপান উড়নচণ্ডী হলেও সে বি এ পাশ করেছে। সদরে গিয়ে বই কিনে নিয়ে আসে। গ্রামের উঠতি ছেলে মেয়েদের বই পড়ার উতসাহ যোগায়। সোপান গ্রামে একটি পাঠাগার করতে। যাতে গ্রামের মানুষ বই পড়ে  সারা বিশ্বকে জানতে পারে। অনেক টাকা পয়সার অভাবের জন্য তা আর করে উঠতে পারছেনা।  গ্রামে মুরুব্বীদের পাঠ্য বইয়ের  বাইরে কোন বইয়ের প্রতি তাদের কোন আগ্রহ নেই। সোপান নিজের ঘরেই ব্যাক্তিগত ভাবে একটি পাঠাগার চালু করেছে। সায়ন্তনি পাঠাগারের শুরুর দিকের সদস্য। গত সপ্তাহে দুটো বই এনেছিল পড়ার জন্য। বই দুটো এখনো ফেরত দেয়া হয়নি। এত রাতে সোপান কি বই চাইতে এসেছে?  বলা যায়না  আসতেও পারে। গ্রামের সবাই বলাবলি করে সোপানের মাথার স্ক্রু নাকি খানিকটা টিলা। সোপানের সাথে সায়ন্তনির বিয়ে হলে সে স্ক্রু ভালভাবেই টাইট দিবে।

সোপান ভাই, আপনি এত রাতে? বই  ফেরত নিতে আসছেন?

না,বই নিতে আসি নাই। সায়ন্তনি তুমি একটু বাইরে আসতে পারবা?

" এত রাতে?  সোপান ভাই আপনি জানেন না আপনার সাথে আমার "

জানি,

তাহলে এত রাতে বাইরে ডাকেন ক্যান?  কেউ দেখলে কি ভাববে?

খেতের দিকে যাচ্ছিলাম। যাবার পথে ভাবছিলাম তোমাকে একবার বলে দেখি।যদি তুমি আমার সাথে যেতে চাও।

এত রাতে খেতের দিকে যাচ্ছেন মানে?

একটা মনোমুগ্ধকর   দৃশ্য দেখতে যাচ্ছি।ভাবলাম দৃশ্যটি তোমাকেও দেখাই।একা একা সুন্দর দৃশ্য দেখে জুত পাওয়া যায়না। তৃপ্ত মানুষের মুখ দেখতে আমার খুব ভাল লাগে। নিজের মুখ নিজে দেখা যায়না বলেই তোমাকে ডাক দিছি। তা ছাড়া এই দৃশ্য দেখে বোঝার মত মন সবার  নাই।তোমার আছে।

নিজের তৃপ্ত মুখ দেখা যায়না, আপনাকে  কে বলেছে?  এরপর থেকে সাথে আয়না  নিয়ে যাবেন। তৃপ্ত মুখ আয়নায় দেখবেন।  যাই হোক আমার যে,  মনোমুগ্ধকর দৃশ্য বুঝার মত মন আছে,  সেইটা আপনি বুঝলেন কিভাবে ?

তুমি কবিতার বই পড় তাই ভাবলাম---- তুমি কি আসবা?

সায়ন্তনি হুট করে কিছু বলেনি।খানিকটা চিন্তা করে।এই যুবক টির মাথায় ব্যাপক পাগলামি আছে। এই ধরনের মানুষ দের বিয়ে করলে  নানান অসুবিধায় পড়তে হয়। দেখা যাবে মাছ কিনে আনতে বললে শুধুই সব্জি নিয়েই হাজির। কেন মাছ আনা হলোনা, কারণ হিসাবে হয়তো বলবে মাছের চোখ দেখে এত মায়া লাগলো তাই আর আনা হলো না।

সায়ন্তনি  তারপরও শেকল উপরে তুলে উঠোনে বেরিয়ে এলো। এই পাগল মানুষটাকেই তার চাই। মানুষটার পাগলামি গুলো তার ভালই লাগে।

চলেন, তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে হবে।কেউ দেখে ফেললে   বারোটা বাজাবে।

সায়ন্তনিদের বাড়ি থেকে খেতের দুরত্ব বেশী দূর নয়।  কারতিক মাসের শেষের দিকে।খেতে ধান পেকে বাদামী রঙ  ধারন করেছে। আর দু, এক দিনের ভিতরেই ধান কাটা শুরু হবে। মাথার উপর কাঁসার  থালার মত  পূর নিমার চাঁদ। তার আলো পাকা ধানের উপর  পড়ায় অসম্ভব সুন্দর দৃশ্যের অবতারণা  হয়েছে।

সোপান মুগ্ধ দৃষ্টিতে একবার খেতের দিকে তাকায়,আবার সায়ন্তনির মুখের দিকে।  টের পেয়ে সায়ন্তনি জিজ্ঞাসা করে কি দেখেন?

চাঁদের আলোর প্রতিফলণ।

সেইটা বাদামী ধানের ডগার দিকে তাকায়া দেখেন।

আমি দুইটাই দেখতেছি।

তুলনা করতেছেন নাকি কোন অটা বেশী সুন্দর?

সুন্দরের কোন তুলনা হয়না,এক্টা কবিতা শুনবা?

সায়ন্তনি আন্মনা কন্ঠে  বলে কি কবিতা?

সোপান প্রশ্নের জবাব না দিয়ে  বলে ওঠে

কবে কার এলোকেশ ছুঁয়েছিল মুখ,ভেবে তা আজও যেন কাঁপে এই বুক।

সায়ন্তনি অপ্রস্তুত হয়ে চুল ঠিক করে বসে। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় চুল বাধার কথা মনে হয়নি৷ কারতিকের লু হাওয়ায়  চুল উড়ে সোপানের মুখে গিয়ে পড়েছে।

এইভাবে বললেন কেন? সায়ন্তনির অনুযোগ।

এমনি।  যদি আর কোনও দিন বলার সুযোগ না পাই?  সোপান ম্লান হেসে বলে, আচ্ছা চলো, তোমাকে বাড়ি দিয়ে আসি। গ্রামের কেউ দেখে ফেললে তোমার বদনাম হয়ে যাবে।

এত রাতে কেউ দেখবে না।  আর একটু থাকি, সায়ন্তনির অনুনয়ের সুর।

 

দোপান কিছু বলে না। তবে এরপরে চলে যাওয়ার জন্য আর তাড়া দেয়নি।  সায়ন্তনি সোপানের কাছে ঘেষে বসে।সোপানের বাহুর সাথে।  নরম ঘাসের উপর, চাঁদের আলো,বাদামী রঙের ডগায় চাঁদের আলো,লু হাওয়ায়,কখন যে সোপানের কাধে মাথা এলিয়ে দেয়  সায়ন্তনি নিজেও জানে না।

দুইঃ---

দিন তিনেক পরে খবর আসে সোপানের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। খবর পেয়ে  সায়ন্তনি উদ্ভ্রান্তের মত ছুটে চলে যায় সোপান কে দেখতে। সোপান তাকে চিনতে পারেনা। ফ্যাল ফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে থাকে।

উন্নত চিকিৎসার আশায় সোপান কে সদরে নিয়ে যাওয়া হলো।সদরের ডাক্তারেরা কোন আশা দিতে পারলেন না। রোগীকে তারা ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেন।সোপাবের বাবা সামান্য স্কুল শিক্ষক। তারপরও তিনি চেষ্টা করে ঢাকায় নিয়ে গেলেন। টানা ছয় মাস নিবিড় ভাবে  চিকিৎসা করার পরেও কোন আশা দেখা না দেয়ায়,সোপানের বাবা তাকে নিয়ে গ্রামে ফিরে এলেন।না ফিরে অবশ্য কোন উপায়ও ছিলনা। হাতের টাকা পয়সা  সব আগেই ফুড়িয়ে গেছে,বিনা টাকায় চিকিৎসা হয়না।  ঢাকায় তাদের কোন আত্মীয় স্বজন ছিলনা৷ থাকলে থাকা খাওয়ার খরচ বাঁচত।

একমাত্র ছেলের চিকিৎসা করাতে গিয়ে সোপানের বাবা ফতুর হয়ে গিয়েছেন।গ্রামের সব জমি জমা বন্ধক রেখে,ধার দেনা করে ঁছেন। সেই টাকা পরিশোধ করবেন কোথা থেকে তিনি  ভেবে পান না।

মেয়ের জেদের কারনে সায়ন্তনির বাবা সোপানের জন্য মাস তিনেক অপেক্ষা করেছিলেন।যদিও পাগল ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দেয়ার কোনও ইচ্ছাই ছিলনা তার।সুস্থ হলে ফিরলেও না তার ধারনা, পাগল কখন পুরাপুরি ভাল হয়না। যে কোন সময় আবার পাগল হয়ে যেতে পারে। এমন মানুষের কাছে যে মেয়ে বিয়ে দেয়, সে তো নিজেও পাগল  ছাড়া কিছু নয়।

তিন মাস অপেক্ষার পরে মাঘ মাসের শেষে পাশের গ্রামের অপেক্ষাকৃত ধনবান ছেলেটির সাথে সায়ন্তনির বিয়ে হয়ে যায়। বিয়েতে সায়ন্তনির বাবা অনেক টাকা খরচ করেন।যৌতুক চাননি তারপরও সায়ন্তনির বাবা দামি মটর সাইকেল উপহার দেন।ঘর সাজিয়ে দেন মেয়ের,এবং পঞ্চাশ শতক জমি রেজিষ্ট্রেশন করে  দেন ছেলেকে।

বছর ঘুরে আবার কারতিক মাস এসেছে।আজ পূরনিমা নয়। তবে আগামী দুই চারদিনের মধ্যেই হবে৷ আকাশের চাঁদ প্রায় গোল আকার ধারণ করেছে৷  সায়ন্তনি তার বাপের বাড়ি বেড়াতে এসেছে। রাসেলের সংসারে ভালই আছে।রাসেল দের যৌথ পরিবার। ভাইদের মধ্যে রাসেল ছোট। খুব আদরের সবার। সায়ন্তনিও সেই আদরের ভাগ পায়। ঘরের কাজ তেমন একটা করতেই হয়না। বড় তিন ভাবী ভাগাভাগি করে কাজ করেন।সোপানের স্কুল শিক্ষক বাবার সংসারে গেলে হয়তো তাকে সারাদিন কাজ করতে হতো।তবুও সেই সংসারে যেতে চেয়েছিল, অদৃষ্ট তা হতে দেয়নি। রাসেলের ঘুম খুব গাঢ়, ঘুমালে নাক ডাকে।

তারপরও বিছানা থেকে নামার সময় সায়ন্তনি খুব সাবধানে নামে। দরজার শেকল  উপরে তুলে, পা টিপে টিপে  বাইরে বের হয়। সায়ন্তনি নিজেও জানেনা সে কি করছে,। তার মন তাকে বিছানায় শুতে দিচ্ছে না। এই একটি বছরে অনেক কিছু পাল্টে গিয়েছে। আগের সেই সোপান আর নেই। সায়ন্তনি যদিও আছে,তবে আগের মত নয়। তবে কিছু জিনিসের পরিবর্তন আজও হয়নি।কাঁসার থালার মত চাঁদটা আজও আলো বিতরণ করে যাচ্ছে।    পাকা ধানের খেত গুলো মাথা উঁচু করে সে আলো চুষে চুষে খাচ্ছে।

বাড়ি থেকে বের হয়ে সে এক ছুটে খেতগুলোর কাছে যায়। সেই আগের মতই  চাঁদের আলো পাকা ধানের উপর  পড়ে অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য অবতারণা করেছে।

অসহ্য সুন্দর দৃশ্য, সেই চাঁদ,সেই ধান খেত, সেই কারতিক মাস,সেই সায়ন্তনি,।হোক সে আজ পরের ঘরের বউ,তবুও।যদিও জানে,ব্যাপারটা অসম্ভব,তবুও মনে মনে এখানে সোপান কে আশা করেছিল। তার আশা ভংগ হয়েছে। খেতগুলোর পাশে দাড়িয়ে হাঁউ মাঁউ শব্দে  কেঁদে ওঠে। এত গুলো দিন মন খুলে সে কাঁদতে পারেনি। আজ প্রান খুলে কেঁদেছে।এই কান্না তার আশা ভংগের কান্না৷ স্বপ্ন ভংগের কান্না। সোপান কে ঘিরে তার অনেক আশা ছিল।  ছিল অনেক স্বপ্ন।কোন টি পূরণ হয়নি।

খেতগুলো থেকে খানিক টা দূরে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সায়ন্তনির দিকে চেয়ে  আছে সোপান।  গ্রামের ছেলে  পেলের দল বাড়ির বাইরে দেখলে তাকে ঢিল ছুঁড়ে। পিছু ধাওয়া করে।  ইদানিং তাই মানুষ দেখলে তার ভয় করে। সায়ন্তনিকে দূর থেকে আসতে দেখে একটি গাছের আড়ালে লুকিয়েছে। ওকে দেখলে এই মেয়েটাও যদি তাকে ঢিল ছোঁড়ে। পিছু ধাওয়া করে। সোপান চাঁদের আলো  খেতে এসেছে।  মেয়েটা এখান থেকে চলে গেলে  খেতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হা করে  আকাশ পানে চাঁদের আলো খাবে। পেট পুরে খাবে।  এত রাতে গ্রামের কেউই তাকে বিরক্ত করতে আসবে না।

 

 

 

0 Shares

৪০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ