দিনশেষে আমার প্রতিদিনই মনে হয় করোনা এসেছেই পুঁজিবাদের ভিতে কুঠারাঘাত করতে।
গত তিনমাসে এটা খুব স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, করোনার থাবায় পুঁজিবাদী বিশ্ব আজ টলটলায়মান।
কর্পোরেটবানিজ্য আর যুদ্ধবানিজ্য করে করে যে দেশগুলো আজ প্রাচুর্যপূর্ণ, ধনতন্ত্রের কৌশলী খেলা খেলে যারা পৃথিবীর সিংহভাগ দেশকে পর্যদুস্ত করে রেখেছিল, আজ তারা নিজেরাই করোনার থাবায় বিপর্যস্ত।

যুগ যুগ ধরে তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লুটতরাজ করে সম্পদশালী হয়েছে। তাদের লুটতরাজের কৌশলটা ভিন্ন বলে বিশ্ব তাদের চেহারা সবসময় সভ্যতার মুখোশেই দেখেছে। তারা লুটের উদ্দেশ্যে নিজেরা শত্রু তৈরি করে নিয়েছে। তারপর শত্রু দমনের উছিলায় শত্রু থেকে সম্পদ হরণ করে নিয়েছে। শত্রু দমনের কৌশল হিসাবে তারা টার্গেট করা দেশে অস্থিরতা তৈরির সমস্ত যোগান সরবরাহ করে সেখানকার পরিস্থিতি টালমাটাল করেছে। নানারকম শর্তের জালে দেশটিকে ফাঁদে ফেলে কব্জায় টেনে নিয়েছে। এরপর দেশটির রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অস্থিরতা যখন কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছেছে তখন সুযোগ বুঝে একসময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। শত্রু দমনের উছিলায় টার্গেট করা দেশের মাটিতে খুটি গেড়েছে। শত্রু দমনের আড়ালে দেশটির সমস্ত সম্পদ হরণ করেছে। হরণ করা শেষ হলে রসহীন আমের আঁটি বানিয়ে নিঃস্ব করে চলে এসেছে। না, শুধু চলেই আসেনি, পৃথিবীর বুকে নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখতে জবরদখল করা প্রতিটা দেশেই ছেড়ে আসার সময় গৃহযুদ্ধের বিষাক্ত বীজ বপন করে এসেছে। যে বিষের যন্ত্রণায় শতাব্দীর পর শতাব্দী দেশগুলো ছটফট করবে কিন্তু মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবেনা। নিজেরা নিজেরা মারামারি কাটাকাটি করাতেই ব্যস্ত থাকবে, মাথা তুলে দাঁড়াবে আর কই? এ কৌশল আরোপে তারা কোথাও জাতিগত বিদ্বেষকে কাজে লাগিয়েছে, কোথাও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে কাজে লাগিয়েছে। অন্যদিকে নিজদেশ, নিজজাতির কাছে সেজেছে পরম পূজনীয়।

ভোগবাদী বিশ্বে ভোগে মত্তরা কখনোই বঞ্চিতদের যন্ত্রণা দেখেও না, অনুভবও করতে পারেনা। নিজের পেটে টান পড়লেই না অনুধাবন করা সম্ভব ক্ষুধার যন্ত্রণা কেমন? এজন্য নিজদেশে ক্ষমতাবানরা হিরোই সেজে থেকেছে। সময়ের স্রোত বেয়ে অদৃশ্য শত্রু করোনা এসে আজ তাদের সে মুখোশটাকে উন্মোচন করেছে। সভ্যতার মুখোশে ঢাকা তাদের চেহারা আজ উলঙ্গ হয়ে খসে পড়েছে। পৃথিবীর সেরা দেশ বা শক্তি হয়েও তারা তাদের নাগরিকদের যথাযথ চিকিৎসাসেবা দিতে পারছে না। চিকিৎসাসেবা না পেয়ে লাশের লাইন পড়ছে। চিকিৎসার অভাবে তাদের নাগরিকরা হাহাকার করছে। প্রাচুর্য, সভ্যতায় শ্রেষ্ঠ বিশ্বের সেরা দেশ হয়েও তাদের চিকিৎসকেরা সুরক্ষা সরঞ্জামের দাবীতে রাস্তায় নেমে এসেছে। চিকিৎসা প্রদানে নিয়োজিতরা দিনে একটা মাস্ক দেয়া হয় বলে অভিযোগ প্রকাশ করেছে। নাগরিক বাঁচাতে তাই তারা একে অন্যের মাস্ক ছিনতাই পর্যন্ত করছে।
পুঁজিবাদী কোন দেশটি সে কাতারে নেই? যুক্তরাষ্ট্র, বৃটিশ, ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, অস্ট্রেলিয়া কে নেই এই কাতারে?
আজ তাদের এ পরিস্থিতির কবলে পড়ার একটাই কারণ, পৃথিবীজুড়ে আধিপত্য বজায়ের রসদ মজবুত রাখতে গিয়ে নাগরিক স্বাস্থ্যসেবায় অমনোযোগিতা। স্বাস্থ্যখাতে অবহেলা, সমরখাতে অধিক মনযোগ ।

করোনাভাইরাস অতি ক্ষুদ্রকায় এক জীবাণু হলেও বৃহৎ ক্ষমতাধরদের অনেক কিছুই এটি উন্মুক্ত করে দিয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরের উপর ভেসে বেড়ানো বিশ্বের সর্ববৃহৎ যুদ্ধজাহাজ 'থিওডোর রুজভেল্ট'ও আজ করোনার থাবায় পর্যদুস্ত। ৯০ টির মতো যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার বহনে সক্ষম পৃথিবীর সেরা এই যুদ্ধাজাহাজ ক্ষমতাবাজ যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার প্রতীক। সে যুদ্ধজাহাজেও অচেনা শত্রু করোনা হানা দিয়েছে। পাঁচহাজার সৈন্য নিয়ে চলা জাহাজটির শতাধিক সৈন্য আক্রান্ত, ঝুঁকিতে চার হাজার মার্কিন সেনা। জাহাজের ক্যাপ্টেন বলেছেন, দৃশ্যমান শত্রুর সাথে যুদ্ধ করা যায় কিন্তু অদৃশ্য শত্রুকে তো দেখাই যায়না, যুদ্ধ করবো কিভাবে। দেশে দেশে যুদ্ধ বাধানো আর প্রতিটি দেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতির ওপর কড়া নজরদারি রাখা সেই যুক্তরাষ্ট্রই এখন দেখতে পাচ্ছে তার জনতা আজ এক ভয়াবহ যুদ্ধের কবলে। বিশ্বব্যাপী ক্ষমতা নিরঙ্কুশ রাখা, পুঁজিবাদের প্রভাব বিস্তার, কর্পোরেট কোম্পানির স্বার্থ সংরক্ষণ আর যুদ্ধ অর্থনীতির প্রতি অতিমাত্রায় মনযোগ আজ তাদের এ বিপর্যয়ের মুখে এনে ফেলেছে। অথচ তারা পৃথিবী শাসন করে মঙ্গল গ্রহও নিয়ন্ত্রণের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে।

আজ বিশ্বের দেশে দেশে চিকিৎসা সরঞ্জাম পাঠানোর আবেদন জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কী উপলব্ধি হচ্ছে, এই পৃথিবী এক অখণ্ড ব্যবস্থা যেখানে মানুষ একে অন্যের পরিপূরক। পুঁজিবাদ ধনী-দরিদ্রের মাঝে যে সামাজিক ব্যবধানকে প্রকট করে তুলেছিল সেটা ডিঙিয়ে বিপদে মানুষই মানুষের পাশে দাঁড়ায়, দাঁড়াবে। তবেই মানুষ বাঁচবে।
এ বোধোদয় কী ঘটবে বিশ্বের সেরা দেশগুলোর?

0 Shares

১০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ