করোনাভাইরাস সংক্রমনের হার বিবেচনা করে বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে বলা যায়। কিছুদিন আগেও করোনাভাইরাস সংক্রমণ কমে যাচ্ছে মনে করা হলেও বর্তমানে তা আবার ভয়ঙ্কর রুপ নিচ্ছে।

গত ২৯ মার্চ ২০২১ গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত আরও পাঁচ হাজার ১৮১ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। এটিই এখন পর্যন্ত দেশে এক দিনে সর্বোচ্চ শনাক্ত। একই সময়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন আরও ৪৫ জন।

এর পেছনে যদি সরকারকে দায়ী করেন তাহলে আপনাকে গন্ড মুর্খ ছাড়া আর কিছুই বলতে পারছিনা। কথাটি শুনে হয়তো আপনার রাগ হতে পারে, কিন্তু একবার বুকে হাত দিয়ে বলুনতো স্বাস্থ্যবিধি মেনেছেন কতজনে? নাকি আপনিও তাদের দলের যারা বলেন-

- করোনা যার হবার এমনিও হবে, মাস্ক পড়লেও হবে না পড়লেও হবে।

- আল্লাহ যদি এভাবেই মৃত্যু দেন তাই ই হবে।

- আপনি মাস্ক পড়ে বাইরে যাচ্ছেন ঠিকই কিন্তু অন্যান্য হাইজিন প্রটেকশন মানছেন না। যেমন- যে কাপড় পরে যাচ্ছেন সে একই কাপড় বাসায় এসে না ধুয়ে ওভাবেই তুলে রাখছেন। কিছু নেড়েচেড়ে দেখার পর বারবার হাত সাবান দিয়ে ধুয়েছেন কি? ।

- আপনি কোন জিনিশ (গেটের হ্যাসবল, সিঁড়ির হাতল, বাইরের সুইচ, গ্যাস লাইটার) নাড়াচাড়া করে সেনিটাইজ করেননি।

- টাকাতো হরহামেশাই নাড়ছি, প্রতিবার হাত ধুয়েছেন কতজনে? চিরুনি, মানিব্যাগ, হাতব্যাগ, বেল্ট, চশমা, ঘড়ি বাইরে থেকে এসে সেনিটাইজ করছেন কতবার?

- মোবাইল যে এতশতবার বাইরে বের করেছেন বাসায় এসে প্রতিদিন সেনিটাইজ করেছেন?

- একমাস্ক না ধুয়ে কতদিন থেকে পড়ছেন? বাইরে থেকে এসে মাস্ক ঘরে ঝুলিয়ে রাখছেন পরেরদিন পরার জন্য তাহলে? সার্জিকাল মাস্ক এর মেয়াদ থাকে ব্যবহারের পরে ৮ ঘন্টা। অথচ আটদিন থেকে একটা মাস্কই পরছেন। দশ টাকায় তিনটি মাস্ক হাতে নিয়ে হাটেবাজারে বিক্রি হচ্ছে খোলা, সেগুলো কেনেননি এমন লোক এদেশে আছে?

- টিকা গ্রহণে অনীহা এবং অযাচিত ভয়ভীতি।

আমি গত কয়েকদিনে পঞ্চাশোর্ধ একজনকেও বোঝাতে পারিনি করোনার ভয়াবহতা। তাদের বোঝাতে পারিনি সর্দি-কাশি, জ্বর থাকলে আপাতত মসজিদে আসার কেন প্রয়োজন নেই। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দেয়া এই সতর্কতা পরামর্শকেও অনেকেই সরকারের রাজনৈতিক চাল বলে বিদ্রুপ করেছেন যা আমার কানে এসেছে।

আধাঘণ্টা করোনাভাইরাস সম্পর্কে যখন বলছিলাম আমি লক্ষ্য করেছি- ৪ জন হাঁচি আর কাশি দিয়েছে। মুখে কনূইতো দূরের কথা হাত বা রুমাল পর্যন্ত দেয়নি। ১০ জন হ্যান্ডশেক করেছে একে অপরের সাথে। বাকী জনাকয়েক যেন গায়ের সাথে গা ঘেঁষে না দাঁড়ালে, বসলে আত্মীয়তা বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

এরপরে আছে ধর্মীয় গোঁড়ামী। আল্লাহ যা করেন করবেন, এই মনোভাবে মাস্ক পরেন না অনেকেই। অযাচিত এবং অতিরিক্ত কথা বলা আমি আগাগোড়াই অপছন্দ করি। মনে মনে শুধু একটি কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিলো- ধর্ম ব্যবসায়ীরা এদেশে কেন জনপ্রিয় আর ধর্মান্ধতা আমাদের আজও কেন আল্লাহর মাল আল্লাহই নিয়েছে এই ধারনাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে! তার কারন হচ্ছে আমাদের এইসব ধর্মীয় গোঁড়ামি আর নিজেদের গোঁয়ার্তুমি যা মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জন্ম থেকেই বিরাজ করছে।

আল্লাহ্‌ না করুন- এমন অবস্থা যেন আমাদের না হয়। তিনিই একমাত্র রক্ষাকারী এবং সুমতি দানকারী।

দেশের করোনাভাইরাস সংক্রমণের বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রানঘাতী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয় থেকে ১৮ দফার প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত এটা মানতে হবে। আগামী অন্তত দুই সপ্তাহ এই নির্দেশনা মানতে হবে।

নির্দেশনাগুলো হলো :

১) সব ধরনের জনসমাগম (সামাজিক/ রাজনৈতিক/ধর্মীয়/অন্যান্য) সীমিত করতে হবে। উচ্চ সংক্রমণযুক্ত এলাকায় সব ধরনের জনসমাগম নিষিদ্ধ করা হলো। বিয়ে/ জন্মদিনসহ যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে জনসমাগম নিরুৎসাহিত করতে হবে;

২) মসজিদসহ সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে;

৩) পর্যটন/ বিনোদন কেন্দ্র সিনেমা হল/ থিয়েটার হলে জনসমাগম সীমিত করতে হবে এবং সব ধরনের মেলা আয়োজন নিরুৎসাহিত করতে হবে;

৪) গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবং ধারণ ক্ষমতার ৫০ ভাগের বেশি যাত্রী পরিবহন করা যাবে না;

৫) সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাতে আন্তঃজেলা যান চলাচল সীমিত করতে হবে; প্রয়োজনে বন্ধ রাখতে হবে;

৬) বিদেশ হতে আগত যাত্রীদের ১৪ দিন পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক (হোটেলে নিজ খরচে) কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে;

৭) নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী খোলা/উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি পরিপালনপূর্বক ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে; ওষুধের দোকানে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে;

৮) স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো মাস্ক পরিধানসহ যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে;

৯) শপিং মলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েরই যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে;

১০) সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাদরাসা, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়) ও কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকবে;

১১) অপ্রয়োজনীয় ঘোরাফেরা/ আড্ডা বন্ধ করতে হবে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া রাত ১০টার পর বাইরে বের হওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে;

১২) প্রয়োজনে বাইরে গেলে মাস্ক পরিধানসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে। মাস্ক পরিধান না করলে কিংবা স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘিত হলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে;

১৩) করোনায় আক্রান্ত/ করোনার লক্ষণযুক্ত ব্যক্তির আইসোলেশন নিশ্চিত করতে হবে। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসা অন্যান্যদেরও কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে;

১৪) জরুরি সেবায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব সরকারি-বেসরকারি অফিস/প্রতিষ্ঠান শিল্প কারখানাগুলো ৫০ ভাগ জনবল দ্বারা পরিচালনা করতে হবে। গর্ভবতী/ অসুস্থ/ বয়স ৫৫-ঊর্ধ্ব কর্মকর্তা/ কর্মচারীর বাড়িতে অবস্থান করে কর্মসম্পাদনের ব্যবস্থা নিতে হবে;

১৫) সভা, সেমিনার, প্রশিক্ষণ, কর্মশালা যথাসম্ভব অনলাইনে আয়োজনের ব্যবস্থা করতে হবে;

১৬) সশরীরে উপস্থিত হতে হয় এমন যেকোনো ধরনের গণপরীক্ষার ক্ষেত্রে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে;

১৭) হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোতে ধারণ ক্ষমতার ৫০ ভাগের বেশি মানুষের প্রবেশ বন্ধ করতে হবে;

১৮) কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ এবং অবস্থানকালীন সর্বদা বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরিধানসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে।

অর্থাৎ করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে আবারো কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সরকার। আইন প্রয়োগ তখনই সুফলতা বয়ে আনবে যখন তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা থাকবে। আইন আছে মানিনা, তাতে লোকসান আদতে আমাদেরই হয়।

তাই চলুন করোনা সংক্রমণ রোধে নিজে সচেতন হই, অন্যকে সচেতন করি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে নিজে ভালো থাকি, অন্যকে ভালো থাকতে সহায়তা করি। জীবন একটাই, আর এই জীবনকে সুস্থ্য রাখা আমাদেরই কর্তব্য।

সকলে ভালো থাকুন সুস্থ্য থাকুন।

0 Shares

২১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ