নিঃশ্বাসের বিশ্বাস নেই। প্রতিটি মানুষের ঘাড়ের ওপর করোনাভাইরাস মৃত্যুর নিঃশ্বাস ফেলছে প্রতিনিয়ত। গত ২৯ জুন’২০ পর্যন্ত ২১৫ আক্রান্ত দেশ ও অঞ্চলে মোট আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এক কোটি দুই লাখের ওপর এবং মৃত্যু হয়েছে পাঁচ লাখের বেশি। এই বৈশ্বিক প্রাণঘাতী মহামারী ক্রমশ ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। এখন জ্বর সর্দি কাশি হলেই মানুষ আতঙ্কিত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে। অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ছে। এমন দুঃসহ দম বন্ধ হয়ে যাওয়া  পরিস্থিতিতে যখন নারী ধর্ষণের কথা শুনি তখন নিজেদেরকে মানুষ ভাবতেই খুব কষ্ট হয়। এমন মানবিক বিপর্যয়ের সময় যখন মানুষ মানুষের পাশে বিভিন্ন সাহায্য ও সহযোগিতা এবং আর্ত মানবতার সেবায় দাঁড়ানোর কথা তখন এমন অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত, অশুভ, মর্মপীড়াদায়ক, নির্মম, নিষ্ঠুর ধর্ষণের ঘটনা হৃদয়মনকে রাগে দুঃখে শোকে ক্ষুব্ধ-বিক্ষুব্ধ, বাকরূদ্ধ, হতবিহবল করে তোলে। আমরা মা বোনদের ইজ্জত আভ্রু সম্মান নিয়ে সুন্দর এবং নিরাপদে বেঁচে থাকা নিয়ে শঙ্কিত, আতঙ্কিত হয়ে পড়ি যা একটি স্বাধীন দেশের মানুষের জন্য মোটেও শোভনীয় এবং কাম্য হতে পারেনা।

বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, বায়েজিদের ডেবারপাড় এলাকায় এক গার্মেন্টস কর্মীকে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত ধর্ষক ও তার এক সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত ২৭ জুন’২০ তারিখ শনিবার রাতে ডেবারপাড় ফরেস্ট পাহাড়ে এই ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। গত ৭ জুন’২০ তারিখে অক্সিজেন মোড় এলাকায় কর্মস্থলে যেতে অপেক্ষা করছিলেন এক নারী শ্রমিক। এসময় ইসমাইল ও তার এক সহযোগী ওই নারীকে জোরপূর্বক রাস্তার পাশে পার্ক করা একটি বাসে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে। গত ২৩ মে’২০ তারিখ শনিবার সকালে উপজেলার হারুয়ালছড়ির দুর্গম এলাকায় দুই স্কুল ছাত্রীকে তুলে নিয়ে গিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করে ১০ যুবক। গত ২৭ এপ্রিল’২০ তারিখে চেচুরিয়ার ঘোনা পাড়ায় গন্ডামারা বড়ঘোনা এলাকার এক তরুণী ধর্ষণের শিকার হন। গত ৬ ফেব্রুয়ারি’২০ তারিখ নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার ট্যানারি বটতল এলাকায় স্বামী-সন্তানকে জিম্মি করে এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগে মাসুদুল হাসান চৌধুরী জিকু (২৮) নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গত ২৬ জানুয়ারি’২০ তারিখ দিবাগত রাতে পতেঙ্গার কাঠগড় এলাকায় রাতে জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯ এ কল দিয়ে ধর্ষণ থেকে রক্ষা পেয়েছেন এক তরুণী।  চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে সাইফুল ইসলাম (২১) ও সোলাইমান (২২) নামে দুই যুবককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত ২৭ জুন’২০ তারিখ শনিবার রাত ৮টার দিকে নানার বাড়ি থেকে নিজের বাসায় যাওয়ার পথে চার যুবক ওই কিশোরীকে জোর করে নেশাজাতীয় কিছু খাওয়ানোর পর অচেতন করে ধর্ষণ করে। সমাজ বিশেষজ্ঞদের মতে ধর্ষকদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে বিচার করতে না পারার কারণে এ জঘন্য নারী ধর্ষণ খুন বন্ধ করা যাচ্ছে না।

“বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. অনুপম সেন বলেছেন, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা একটি সামাজিক সমস্যা। মানুষের মধ্যে যে আদিম প্রবৃত্তি, তা দমিয়ে রাখতে হলে শৈশব থেকে বা পরবর্তীতে স্কুল কলেজে যথাযথ জ্ঞানচর্চা, নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনার মধ্যে সাইকোলজিক্যাল একটি ব্যাপারও কাজ করে। কোনো স্থানে একজন করল। তা প্রচার হওয়ার পর দেখা যায় একনাগাড়ে এখানে ওখানে হতেই থাকে। এটা হয়, কারণ যাদের মধ্যে সেই আদিম মনোবৃত্তি দমানো যায়নি, তারা ঘটনার সংবাদটি জেনে উদ্বুদ্ধ হয়। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, নিউ ইয়র্ক শহরে প্রচুর খুনের ঘটনা ঘটে। কিন্তু তারা সেটা সেভাবে প্রকাশ করে না ওই একই কারণে। যখন কেউ ধর্ষণ করে বা হত্যা করে তখন সে আনকনশাস থাকে। অবদমিত প্রবৃত্তি তখন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এ ধরনের ঘটনা বাড়তে দিলে তো সামাজিকীকরণ থাকবে না। আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ হওয়া উচিত। পাশাপাশি পারিবারিক অনুশাসন ও মানুষে মানুষে সামাজিক সম্পর্কটা বাড়াতে হবে”। { সূত্র দৈনিক আজাদী, ২৯ জুন’২০}।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় আমাদের দেশে যে নারীটি নির্যাতন, খুন এবং ধর্ষণের শিকার হয়েছে আমাদের মিডিয়া থেকে শুরু করে সবাই তাঁর ছবি এবং পরিচয় প্রকাশের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কোথায় সেই নির্যাতিতা নারীকে চিকিৎসা, সান্ত্বনা দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। তাঁর নাম ঠিকানা গোপন রেখে আইনের আশ্রয় নেয়ার জন্য মানবিকভাবে সে পরিবারের পাশে দাঁড়াবে তা নয় বরং সবাই জগতের সব উৎসুক্য নিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারটির ওপর যেন হামলে পড়ে। আজ যদি সে মেয়েটির জায়গায় আপনার স্নেহের মেয়ের এমন অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ঘটতো তাহলে আপনি কি করতেন নিজের বিবেককে সে প্রশ্ন করেছেন কি কখনো ? আরো দুঃখের বিষয় হচ্ছে সমাজের একশ্রেণীর মানুষ অসহায় নির্যাতিতদের পাশে না দাঁড়িয়ে সমাজের দুষ্ট ক্ষত ধর্ষকদের পক্ষা নিয়ে কথা বলে। ন্যায় বিচারের পরিবর্তে উল্টো আপোষ করার জন্য ভিক্টিমের পরিবারের ওপর অনৈতিক চাপ আর প্রভাব খাঁটিয়ে থাকে। যা ন্যায় বিচার পাওয়ার ব্যাপারে একটা বিরাট অন্তরায়।

দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণ খুন হত্যা যৌন নির্যাতন ও নিপীড়নের ঘটনা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। আমাদের সামাজিক মানবিক নৈতিক এবং ধর্মীয় অবক্ষয়ের কারণগুলো চিহ্নিত করে তার প্রতিকার ও প্রতিরোধে কঠিন ও কঠোর শাস্তির বিধান করা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। আগ্রাসী আকাশ সংস্কৃতি, মাদকাসক্তি, মাদকের সহজল্ভ্যতা, বেকারত্ব , প্রেমে ব্যর্থতা, ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশা বা ফ্রি-মিক্সিং, নীল ছবির দংশন, বিদেশী অপ-সংস্কৃতির আগ্রাসন, প্রগতিশীলতা এবং নারী স্বাধীনতার নামে অতি আধুনিক জীবন যাপন, কিশোরদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ প্রাপ্তি, চাকুরিজীবি মা বাবার সন্তানের প্রতি যত্নের অভাব, তাঁদের সঙ্গে সন্তান সন্ততিদের কমিউনিকেশন গ্যাপ, কাজের মানুষের ওপর অতি নির্ভরশীলতা, সামাজিক বৈষম্য, শিক্ষাঙ্গনে যথাযথ নিয়ম শৃঙ্খলার অভাব, ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক ও মানবিক শিক্ষার ঘাটতি, সিনেমার হিরোদের মতো রোমাঞ্চকর দৃশ্যে অপ্রাপ্তবয়স্কদের চিন্তা ভাবনা করা, সঙ্গদোষ বা অসৎ সঙ্গের সঙ্গে মেলামেশা, সন্তান সন্ততিরা কোথায় যায়, কার সঙ্গে মেলামেশা করে এসব বিষয়ে অভিভাবকদের উদাসীনতাসহ আরো অনেক কারণ রয়েছে মানুষের নৈতিক স্খলন ও অধঃপতনের জন্য। সমাজ বিজ্ঞানী জনাব অনুপম সেনের কথাগুলোকে যথাযথ মূল্যায়ন এবং সেভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ বিবেচনার দাবী রাখে।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় শিক্ষিত থেকে অশিক্ষিত সমাজের কোনো অংশই মানসিক কুরুচিপূর্ণ বিকার এবং প্রভাব থেকে মোটেও মুক্ত নয়। ১৬ বছরের কিশোর থেকে ৭০/৮০ বছরের বুড়ো মানুষ পর্যন্ত এ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। অন্য সকলের কথা না হয় বাদই দিলাম যখন দেখি স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ মাদ্রাসার ধর্মীয় শিক্ষক, ইমাম, ময়াজ্জিনেরাও এহেন জঘন্য নিন্দনীয় কুরুচিকর আপত্তিজনক নির্মম নিষ্ঠুর ধর্ষণ, খুন, যৌন নিপীড়ন আর যৌন হয়রানীর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে তখন আমরা অসহনীয় অসহ্য ঘৃণায়, ক্ষোভে, দুঃখে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ি। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে যে কোনো বিবেকবান সুস্থ স্বাভাবিক মানুষকে। আরেকটি দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, আদলতে আইনজীবীরা ধর্ষিতাদের সঙ্গে অশোভনীয়, অশ্লীল, অসৌজন্যমূলক এবং অমানবিক আচরণ করে থাকেন। মাননীয় আদালতকে এ ব্যাপারে আইনজীবীদেরকে সদাচরণের বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা দেয়া উচিৎ। পাশাপাশি পুলিশের দুর্বল তদন্ত রিপোর্টের কারণেও ধর্ষিতারা অনেক সময় ন্যায্য বিচার থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে। এখানে পুলিশের ধর্ষণের মামলাগুলো তদন্তের জন্য সঠিক প্রশিক্ষণের এবং লজিস্টিক সাপোর্টের অভাব রয়েছে। আবার পুলিশের কতিপয় অসৎ অসাধু নীতি বিবর্জিত কর্মকর্তা অর্থের কাছে নতি স্বীকার করে আসামির পক্ষে তদন্ত প্রতিবেদন কোর্টে জমা দিয়ে থাকেন। পাশাপাশি অনেক ঘটনায় সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে আসেনা প্রভাবশালীদের ভয়ে অথবা টাকার কাছে বশ্যতা স্বীকার করে। তথাপি ধর্ষণের ঘটনাগুলোকে দেশের প্রচলিত আইনের পাশাপাশি বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে অতি দ্রুত বিচারের আওতায় এনে ফাঁসি বা ফায়ারিং স্কোয়াডে বা জনসম্মুখে পাথর নিক্ষেপ করে কঠিন এবং কঠোরভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতেই হবে। এখানে তথাকথিত মানবাধিকার কর্মীদের কথায় কান দেয়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।  কেননা ধর্ষণের সময় মানবাধিকার কোথায় ছিল? একজন নারীকে নির্যাতন বা খুনের সময় মানবাধিকার তো ঘুমিয়েই ছিল। বছরের গোড়ার দিকে জাতীয় সংসদের এক বিশেষ আলোচনায় সাংসদরা বলেছেন– ধর্ষকদের ক্রসফায়ার মাস্ট। আমরাও তাই মনে করি। বিচারের নামে দীর্ঘ সূত্রিতার কারণে নির্যাতিতরা ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পাশাপাশি মামালার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে আসামিরা জামিনে বেরিয়ে ভিক্টিমদেরকে উল্টো প্রাণনাশের হুমকি দেয়। ফলে সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। অতএব মা বোনদের ইজ্জত সম্ভ্রম সম্মান নিরাপত্তা বিধান রাষ্ট্রের সংবিধানিক দায়িত্ব এবং কর্তব্য। একজন মানুষ সে নারী হোক বা পুরুষ হোক তাঁর নিরাপদে বেঁচে থাকা রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক, নাগরিক, জন্মগত এবং মানবিক অধিকার।

ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।

0 Shares

২২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ