কথোপকথন

রাতুল ৪ নভেম্বর ২০১৩, সোমবার, ১২:০৬:১২পূর্বাহ্ন গল্প, সাহিত্য ১২ মন্তব্য

কলম হাতে নিয়ে সামনেই টেবিলে রাখা উন্মুক্ত ডায়েরি নিয়ে প্রায় ঘণ্টা-খানেক কাটিয়ে দিয়েছে মৃন্ময়ী। যদিও মাথায় কিছু আসছিলো না এমনিতেও, তারপরও কিছু একটা লিখতে হবে মনে হচ্ছিল। এখন পর্যন্ত এই অনুভূতি কাজ করছে বিধায় কলম হাত থেকে রাখেনি সে। বেশ কিছুদিন হয় কিছু লিখতে পারছে না সে। এই নিয়ে এক ধরণের হতাশা কাজ করা শুরু করে দিয়েছে, সেই হতাশা আজ এমন ভাবে জেঁকে ধরেছিল যে ফাঁকা মাথা নিয়েই কলম হাতে নিতে বাধ্য হয় মৃন্ময়ী। সে যে কোন নামকরা লেখক বা পেট এর দায়ে লিখে এমনটি না। তাকে লেখালেখির জন্য কোন প্রকাশক এসে চাপ দিতে থাকে না। বা পাঠক রা তার লেখা পাবার আশায় অপেক্ষার প্রহর গুণে না। নিজের জন্য লিখে মৃন্ময়ী, নিজের ভালো লাগে বলেই কলম হাতে নেয়, লিখে চলে যা ইচ্ছে তা। কখনও দুটি চরণ মাথায় ঘুরছে, বসে পড়ে কবিতা লিখতে সময় পেলেই। কখনও কোন একটা চরণ কে লিখায় রূপ দিতে গিয়ে হয়ে যায় গল্প। কোন কোন রাতে মনের যত কথা, লিখে যেতে থাকে আনমনেই। মৃন্ময়ীর ভেতরে কাজ করতে থাকে তখন এক অপরিমেয় তেষ্টা। সে তেষ্টা মেটানোর দায় পড়েনি ওর। তবুও লিখে যায়, আনন্দে হারিয়ে যায়। যত লিখে তত তেষ্টা বাড়তে থাকে, একটা সময় ক্লান্ত হয়ে ডায়েরি বন্ধ করে, কলম হাত থেকে রেখে ঘুমোতে যায় মৃন্ময়ী। কিন্তু ব্যস্ততা বা অন্য বিভিন্ন চিন্তা মাথায় ঘুরছে বিধেয় সে বেশ কিছুদিন যাবত লিখতে বসেনি, সময় পেলেও মাথায় কিছু ছিল না বা তেষ্টা কাজ করলেও লিখতে বসে কিছু মাথায় আসছিলো না। মনে বিরাজ করে অন্যরকম শূন্যতা। বর্ণমালা গুলো বেমালুম ভুলে গিয়ে সেখানে জায়গা করে নেয় এক থলে শূন্যতা। সে শূন্যতা মাঝে অজানায় হাতরে বেড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে মৃন্ময়ী অবশেষে।

আজকে মাথায় একটা নাম ঘুরছিল সারাদিন ধরে। সকল দৈনন্দিন কাজ এর ফাঁকে ফাঁকে সে নাম মনে পরছিল বারবার ওর। তাই এখন লিখতে বসেছে। কিন্তু শুরু করতে পারছে না।

-কি ব্যাপার মৃন্ময়ী ? কতক্ষণ বসে থাকবে এভাবে ?

চমকে উঠে মৃন্ময়ী এ কণ্ঠে। এ তো নিজের কণ্ঠস্বর। ভয় ও চমক এর সংমিশ্রণে চভয় নামের একটা অনুভূতি কাজ করতে থাকে ওর মাঝে। কিন্তু কৌতূহল এর কাছে চভয় অনুভূতি হেরে যায়, কৌতূহল থেকেই জিজ্ঞেস করে মৃন্ময়ী,

-কে ? কে তুমি ?

-আমি মৃন্ময়ী। আমাকে চিনতে পারছ না ??

এবার একটু বেশিই ভয় পায় সে, মাথার ভেতর নিজের কণ্ঠস্বর ! আবার নিজের কথার উত্তর দিচ্ছে। কি করে সম্ভব এটা। মানুষ এর ভেতর বহুরূপী স্বত্বা কাজ করে, এটা সে জানে। কিন্তু একই সাথে দু রকম সত্ত্বায় ভাগ হয়ে একজন আরেকজন কে চমকে দিতে পারে কি না, এটা ওর জানা ছিল না। তবে ও কিছু তা আশ্বস্ত হল যে, কণ্ঠ তা ভৌতিক কোন কিছু না, ওর ভেতর থেকেই আসছে। ও জবাব দিলো,

-আমিই তো মৃন্ময়ী।

-হুম,আমি আর তুমি একজন।

-এটা কি করে সম্ভব ?

-একজন মানুষ এর মাঝে পরিস্থিতি ভেদে বহুরূপী স্বত্বা কাজ করা সম্ভব। জানো না ?

-হুম, সেটা জানি। কিন্তু তুমি তোমার আর আমার মাঝে পার্থক্য কি? বা তুমি এভাবে আলাদা ভাবে চিন্তাভাবনা করার সামর্থ্য রাখো কি ?

-হুম, সবসময় হয়তো রাখি না, এখন পারছি বা বলতে পারো এখন পারছ। মানুষ যদি খুব বেশি নীরবতায় হারিয়ে যায়, তখন সে নীরবতা ভয়ংকর হয়ে ধরা দেয়। সে নীরবতা থেকে উদ্ধার পেতে মানুষ নিজের মাঝে একাধিক স্বত্বার আগমন ঘটাতে সম্ভব।

-ও আচ্ছা। কিন্তু একটা কথা, মানুষ এর মাঝে তো মূলত দুটি স্বত্বা কাজ করে। একটি ‘হ্যাঁ স্বত্বা’ এবং অপরটি ‘না স্বত্বা’ । তুমি কোনটা এখানে ?

-সেটা কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র। আমি মূলত এসেছি তোমাকে ভয়ংকর নীরবতা থেকে উদ্ধার করতে। ভালো মন্দ, হ্যাঁ অথবা না এগুলো আপেক্ষিক ব্যাপার। সে ক্ষেত্রে আমি এতটা শক্তিশালী থাকি না অথবা বলতে পারো আমি নিজেকে এখন একজন আলাদা মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করার সামর্থ্য রাখি, একেবারে তোমার মত কিন্তু আলাদা। কিন্তু ঐ ক্ষেত্রে পারতাম না।

-ও আচ্ছা, তুমি চাইলে এখন আলাদা হতে পারবে এটা বিশ্বাস করতে পারছি না আমি।

-সেটা তোমার ব্যাপার। বিশ্বাস অবিশ্বাস ব্যাপারটা অনেক বেশি অযৌক্তিক। দুনিয়াতে অনেক কিছু তোমাকে যুক্তির ঊর্ধ্বে উঠে শুধুমাত্র বিশ্বাস দিয়েই মেনে নিতে হয়। যেমন ধর্ম বা ঈশ্বর এর অস্তিত্ব।

-তুমি কি আস্তিক ?

-নির্ভর করে, আমি ঈশ্বর এ বিশ্বাস করি। শুধুমাত্র বিশ্বাস মানেই তো আস্তিক। কিন্তু ঈশ্বর এর বিধি মানি না, সেক্ষেত্রে আমার আস্তিকতা বজায় থাকবে কিন্তু আমি ধর্মভীরু বলে গণ্য হবো না। এবং তখন সাধারণ দৃষ্টিতে আমাকে নাস্তিক বলে ধরা হবে। নাস্তিক প্রতিষ্ঠা পাওয়া বর্তমান যুগে অনেক বেশি সহজ।

-হুম, এটা ঠিক। বর্তমানে আমাদের দেশে নাস্তিক উপাধি পাওয়া শুধু মাত্র ক্ষণিকের বা একটা বক্তব্যের ব্যবধান মাত্র। আমাকে অনেকেই নাস্তিক বলে। কিন্তু আমি মনেপ্রাণে ঈশ্বরে বিশ্বাস করি। মাঝে মাঝে তার পূজা করি। কিন্তু যৌক্তিক কথা বলার কারণে বা নিজস্ব ধারণা ভাগাভাগি করতে গিয়ে মাঝে মাঝেই নাস্তিক উপাধি পেয়ে যাই। খুব মন খারাপ হয় তখন।

-মন খারাপ করো না। ঈশ্বর যদি থেকে থাকেন। তবে তিনি জানেন কে তার প্রতি বিশ্বাস এনেছে, কে আনেনি। তুমি যদি এ ব্যাপারে বিশ্বাস কে যুক্তির ঊর্ধ্বে নিতে না পারো তবে স্বাভাবিক ভাবেই ঈশ্বর থেকে দূরে সরে যাবে।

-আচ্ছা, এসব কথা বাদ দেও। বিতর্কিত কথাবার্তা সবসময় ভালো লাগে না।

-আচ্ছা। তোমার ইচ্ছা।

-আচ্ছা, বলত আমি লিখতে পারছি না কেন কদিন ধরে ?

-কারণ আমি তোমাকে লিখতে দিচ্ছি না।

-কেন ? দিচ্ছ না কেন ? তুমি না এতটা শক্তি সবসময় পাওনা। তো এতদিন ধরে আমাকে লিখতে দিচ্ছিলে না, এটা কি করে ?

-আসলে আমি আমার উপস্থিতি তোমার কাছে প্রকাশ করার সুযোগ খুঁজছিলাম। আজকের এই পরিস্থিতি তৈরি করতে আমাকে এত কষ্ট করতে হয়েছে।

-কেন ?

-কারণ তোমাকে আমার সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন ছিল। তোমার কিছু ধারণা পরিবর্তন করা প্রয়োজন ছিল।

-কি ধারণা ?

-এতক্ষণ যেগুলো বলেছি, সেটা মূল আলোচনা ছিল না। এখন আসছি মূল কথায়। আমি তোমার বিপরীত স্বত্বা। তোমার যে ধারণা ছিল, তোমার কিছু বড় বড় সিদ্ধান্ত আমি তোমাকে ভুল নিতে বাধ্য করেছিলাম। এটা ভুল। আমি তোমাকে বাধ্য করিনি। আমাকে তোমার মাঝে ওভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। তুমি যা করবে, আমি ঠিক তার বিপরীত কাজ করার জন্য তোমাকে উদ্বুদ্ধ করবো। তোমার মূল স্বত্বার মানসিক শক্তির পরীক্ষা নেওয়ার জন্য আমি তৈরি।

-পরীক্ষা নেওয়ার কি আছে ? আমার ক্ষতি মানে তোমার ক্ষতি, সিদ্ধান্ত নিতে আমাকে সাহায্য না করে উল্টো আমার ক্ষতি কেন করেছ বা করে যাচ্ছ তুমি ?

-আছে। তোমার মূল স্বত্বার মানসিকতার সুষ্ঠু গঠন হওয়ার নিশ্চয়তা যাচাই করার দায়িত্ব আমার। তোমাকে মানসিক ভাবে শক্ত করে তোলার দায়িত্ব আমার।

-কিন্তু আমি যদি বারবার তোমার কাছে পরাজিত হতে থাকি?

-তবে তোমার জীবন হবে বিষাদময়। তুমি কখনও প্রকৃত সুখের দেখা পাবে না।

-আচ্ছা, তোমার আর আমার মাঝে মূল পার্থক্য কি, বলতে পারবে ?

-ওভাবে বলতে গেলে কোন পার্থক্য নেই আসলে। বলেছিই তো আমি মূল চরিত্রের বিপরীত। আমি কোন আবেগ অনুভূতি দিয়ে কিছু নির্ধারণ করি না। তবে তুমি যদি আবেগ থেকে দূরে সরে বাস্তবতা দিয়ে কিছু নির্ধারণ করতে যাও, তবে আমি হয়ে উঠবো ভীষণ রকম আবেগী। তবে এটা ঠিক যে বরাবরের মত তোমার আবেগ এর কাছে আমার আবেগ পরাজিত হবেই। তুমি অনুভব করতে পারো। আমি পারি না। আবেগ অনুভবের বিষয়। কোন নিয়ম, বা দায়িত্ব থেকে আবেগী হওয়াটা এত সহজ না। আমি নির্দিষ্ট নিয়মে চলি, যার ফলে আমি কখনও সত্যিকার আবেগ অনুভব করতে পারবো না।

-হুম। বুঝলাম। কিন্তু তুমি আজকে আমাকে এসব বলছ কেন ?

-তোমাকে সাহায্য করার জন্য। আসলে সত্যকথা বলতে আমাকে সাহায্য করার জন্য। তুমি আবেগ ভুলে বাস্তবতা, শুধুমাত্র বাস্তবতা নিয়ে আছো। আমি তোমার সে আবেগ কে অনেকদিন অনুভব করতে পারিনি। যার কারণে আমি নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছি। নিজেকে বাঁচাতেই তোমার কাছে ছুটে আসা এভাবে। অন্যথা আমার নিয়মে নেই তোমার কাছে এভাবে আমার পরিচয় দেবার। আমি বলেছি তো, আবেগ আমি অনুভব করতে পারি না। শুধু মাত্র তোমার মাধ্যমে স্বাদ নিতে পারতাম। যেটা অনেকদিন যাবত পারছি না। তুমি তোমার সত্যকার স্বত্বায় ফিরে যাও মৃন্ময়ী। দয়া করো আমার উপর, তোমার উপর। তুমি তোমার সত্যিকার স্বত্বায় ফিরে যাও।

-আমি বুঝতে পারছি না। ঘোলাটে লাগছে আমার। তুমিই আমার বিপরীত আবার তুমিই আমায় সাহায্য করছ, কিভাবে এটা সম্ভব ?

কোন উত্তর আসে না। মৃন্ময়ী ধীরে ধীরে অনুভব করে ওর সে শূন্যতা ফিরে এসেছে। তবে এতটা প্রকট না, যতটা লিখতে বসবার সময় অনুভব করেছিল। ক্লান্ত লাগছে মৃন্ময়ীর অনেক বেশি। সে কলম রেখে, ডায়েরি বন্ধ করে শুয়ে পড়ে।

0 Shares

১২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ