ঐতিহ্যের ধারক রংপুরের শতরঞ্জি

আরজু মুক্তা ২৭ জানুয়ারি ২০২১, বুধবার, ১২:২৪:৩৭পূর্বাহ্ন এদেশ ৩০ মন্তব্য

রংপুর জেলার প্রাচীনতম শিল্প ও গৌরবময় ঐতিহ্য হচ্ছে শতরঞ্জি। ইতিহাস থেকে জানা যায় ত্রয়োদশ শতাব্দীতেও এ এলাকায় শতরঞ্জির প্রচলন ছিলো। রাজা বাদশাহদের গৃহে এর ব্যাপক কদর ছিলো। মোঘল সম্রাট আকবর এর দরবারে শতরঞ্জি ব্যবহার করা হতো বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। ত্রিশ দশকের জমিদার জোতদারদের ভোজের আসন হিসেবে শতরঞ্জির ব্যবহারের কথা শোনা যায়। সে সময় শতরঞ্জি রাজা বাদশাহ ও বিত্তবানদের বাড়িতে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো। বিট্রিশ শাসনামলে শতরঞ্জি এতো বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে যে সমগ্র ভারতবর্ষ ছাড়া বার্মা, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো। এখন প্রায় ৩৬ টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। দিন দিন বাড়ছে এর চাহিদা।

শতরঞ্জি হলো এক ধরনের কার্পেট।  শব্দটি ফারসি শতরঞ্জ থেকে এসেছে। শতরঞ্জ হলো দাবা খেলার ছক। দাবা খেলার ছকের সঙ্গে শতরঞ্জির নকশায় এর মিল আছে বলে নামটি সেখান থেকে এসেছে।

রংপুর শহরের উপকণ্ঠে সেনানিবাস এর পশ্চিমে একখানি গ্রাম নিসবেতগঞ্জ। এই গ্রামটি শতরঞ্জি নামক শিল্পের ইতিহাস ও ঐত্যিহের উষর ভূমি। ১৮ শ শতকের কথা। ব্রিটিশ নাগরিক মি. নিসবেত তৎকালীন রংপুর জেলার কালেক্টর ছিলেন। সেই সময়ে মোটা মোটা ডোরাকাটা রং বেরঙের সুতার গালিচা তৈরি হতো। মি. নিসবেত এসব দেখে মুগ্ধ হয়ে এর গুণগতমান উন্নয়ন এবং শিল্পের প্রচার ও প্রসারের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তাঁর ভূমিকার জন্য এ গ্রামটির নামকরণ  হয় নিসবেত।

বর্তমান বিশ্বে বুনন শিল্পের মধ্যে শতরঞ্জি বুনন সবচেয়ে প্রাচীনতম।  এতে কোন যন্ত্র ব্যবহার হয়না। কেবলমাত্র বাঁশ ও রশি দিয়ে মাটির উপর সুতো দিয়ে টানা প্রস্তুত করে প্রতিটি সুতা গণনা করে হাত দিয়ে নকশা করে শতরঞ্জি তৈরি করা হয়। কোন জোড়া ছাড়া যে কোন মাপের  শতরঞ্জি তৈরি করা যায়। এর সৌন্দর্য ও রঙের বাহার অতুলনীয়। নিসবেতগঞ্জের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই শতরঞ্জি তৈরির ঘটাং ঘটাং শব্দ। এক বর্গফুট শতরঞ্জি নির্মাণে সময় লাগে এক থেকে তিন ঘণ্টা। ডিজাইনে লাল নীল বা কালো রঙের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত আয়তাকার হয়ে থাকে তবে, বর্গাকার, ডিম্বাকার সহ যে কোন আকৃতির হতে পারে। সর্বনিম্ন দৈর্ঘ্য ৩০ ইঞ্চি থেকে প্রস্থে ২০ ইঞ্চি এবং সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ৩০ ফুট ও ২০ ফুট প্রস্থ পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে, যে কোন পরিমাপেই বোনা যায়।

এক পরিসংখ্যানে প্রাপ্ত তথ্য মতে বর্তমানে বাংলাদেশে রপ্তানি বাণিজ্য হস্তশিল্পের ৬০ শতাংশই রপ্তানি হয়ে থাকে রংপুরের শতরঞ্জি। বিগত তিন বছরে গড়ে প্রতিবছর প্রায় ৪০ লাখ ডলার দেশে আনা সম্ভব হয়েছে এই শতরঞ্জির মাধ্যমে।

নিসবেতগঞ্জ একটি নাম নয়। এক বিশাল কারুপণ্য। গ্রামের প্রতিটি হাতে আছে নিপুণতার ছোঁয়া আর বৈচিত্র্যময়তা। চঞ্চল পাহাড়ি ঝরণার মতো চপলতা নিয়ে প্রবাহিত হোক রংপুরের শতরঞ্জি সারা বিশ্বে।

 

0 Shares

৩০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ