
রংপুর জেলার প্রাচীনতম শিল্প ও গৌরবময় ঐতিহ্য হচ্ছে শতরঞ্জি। ইতিহাস থেকে জানা যায় ত্রয়োদশ শতাব্দীতেও এ এলাকায় শতরঞ্জির প্রচলন ছিলো। রাজা বাদশাহদের গৃহে এর ব্যাপক কদর ছিলো। মোঘল সম্রাট আকবর এর দরবারে শতরঞ্জি ব্যবহার করা হতো বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। ত্রিশ দশকের জমিদার জোতদারদের ভোজের আসন হিসেবে শতরঞ্জির ব্যবহারের কথা শোনা যায়। সে সময় শতরঞ্জি রাজা বাদশাহ ও বিত্তবানদের বাড়িতে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো। বিট্রিশ শাসনামলে শতরঞ্জি এতো বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে যে সমগ্র ভারতবর্ষ ছাড়া বার্মা, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো। এখন প্রায় ৩৬ টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। দিন দিন বাড়ছে এর চাহিদা।
শতরঞ্জি হলো এক ধরনের কার্পেট। শব্দটি ফারসি শতরঞ্জ থেকে এসেছে। শতরঞ্জ হলো দাবা খেলার ছক। দাবা খেলার ছকের সঙ্গে শতরঞ্জির নকশায় এর মিল আছে বলে নামটি সেখান থেকে এসেছে।
রংপুর শহরের উপকণ্ঠে সেনানিবাস এর পশ্চিমে একখানি গ্রাম নিসবেতগঞ্জ। এই গ্রামটি শতরঞ্জি নামক শিল্পের ইতিহাস ও ঐত্যিহের উষর ভূমি। ১৮ শ শতকের কথা। ব্রিটিশ নাগরিক মি. নিসবেত তৎকালীন রংপুর জেলার কালেক্টর ছিলেন। সেই সময়ে মোটা মোটা ডোরাকাটা রং বেরঙের সুতার গালিচা তৈরি হতো। মি. নিসবেত এসব দেখে মুগ্ধ হয়ে এর গুণগতমান উন্নয়ন এবং শিল্পের প্রচার ও প্রসারের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তাঁর ভূমিকার জন্য এ গ্রামটির নামকরণ হয় নিসবেত।
বর্তমান বিশ্বে বুনন শিল্পের মধ্যে শতরঞ্জি বুনন সবচেয়ে প্রাচীনতম। এতে কোন যন্ত্র ব্যবহার হয়না। কেবলমাত্র বাঁশ ও রশি দিয়ে মাটির উপর সুতো দিয়ে টানা প্রস্তুত করে প্রতিটি সুতা গণনা করে হাত দিয়ে নকশা করে শতরঞ্জি তৈরি করা হয়। কোন জোড়া ছাড়া যে কোন মাপের শতরঞ্জি তৈরি করা যায়। এর সৌন্দর্য ও রঙের বাহার অতুলনীয়। নিসবেতগঞ্জের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই শতরঞ্জি তৈরির ঘটাং ঘটাং শব্দ। এক বর্গফুট শতরঞ্জি নির্মাণে সময় লাগে এক থেকে তিন ঘণ্টা। ডিজাইনে লাল নীল বা কালো রঙের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত আয়তাকার হয়ে থাকে তবে, বর্গাকার, ডিম্বাকার সহ যে কোন আকৃতির হতে পারে। সর্বনিম্ন দৈর্ঘ্য ৩০ ইঞ্চি থেকে প্রস্থে ২০ ইঞ্চি এবং সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ৩০ ফুট ও ২০ ফুট প্রস্থ পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে, যে কোন পরিমাপেই বোনা যায়।
এক পরিসংখ্যানে প্রাপ্ত তথ্য মতে বর্তমানে বাংলাদেশে রপ্তানি বাণিজ্য হস্তশিল্পের ৬০ শতাংশই রপ্তানি হয়ে থাকে রংপুরের শতরঞ্জি। বিগত তিন বছরে গড়ে প্রতিবছর প্রায় ৪০ লাখ ডলার দেশে আনা সম্ভব হয়েছে এই শতরঞ্জির মাধ্যমে।
নিসবেতগঞ্জ একটি নাম নয়। এক বিশাল কারুপণ্য। গ্রামের প্রতিটি হাতে আছে নিপুণতার ছোঁয়া আর বৈচিত্র্যময়তা। চঞ্চল পাহাড়ি ঝরণার মতো চপলতা নিয়ে প্রবাহিত হোক রংপুরের শতরঞ্জি সারা বিশ্বে।
৩০টি মন্তব্য
বোরহানুল ইসলাম লিটন
আমাদের নওগাঁ থেকে রংপুর অতি বেশি দূরত্বে না।
অথচ অদ্যাবধি এই তথ্যাবলীর সাথে আমি যথেষ্ট পরিচিত ছিলাম না।
টিকে থাকুন অনন্ত কাল এমন শিল্প ঐতিহ্যের ধারা গরবে বহন করে।
সুন্দর লেখায় মুগ্ধতা ও ভালোলাগা রেখে গেলাম একরাশ।
আন্তরিক শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা জানবেন সতত।
আরজু মুক্তা
প্রথম জানলেন, এটাই আমার লেখার প্রাপ্তি।
শুভকামনা ভাই।
সাখাওয়াত হোসেন
আপনার লেখনীর জাদুময়তার মত শতরঞ্জির মহিমা সারাবিশ্বে বাংলার ঐতিহ্য নিয়ে ছড়িয়ে পরুক। শুভকামনা রইল অবিরত।
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ অশেষ সাখাওয়াত ভাই।
আলমগীর সরকার লিটন
খুব সুন্দর অনেক শুভেচ্ছা রইল মুক্তা আপু
আরজু মুক্তা
শুভেচ্ছার ফুলঝুড়ি থাকলো।
তৌহিদ
আমাদের ঐতিহ্যের অন্যতম বাহক এই শতরঞ্জি। কত শ্রমিকের ঘাম ঝড়া কাব্য গাথা রয়েছে এর বুননে তা নিজচোখে বানানো না দেখলে অনুভব করা যায়না। আমার সৌভাগ্য হয়েছিলো দেখার।
বিভিন্ন পৃষ্ঠপোষকতায় এই শতরঞ্জি এখন দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। চমৎকার লিখেছেন আপু। পাঠকদের শতরঞ্জির ইতিহাস জানানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ।
আরজু মুক্তা
জি ভাই। কতো লোকের ঘাম ঝরানো কাবিক্যতা। আর আমাদের অর্থনীতি তাদের কারণে সচল।
ভালো থাকবেন ভাই।
শুভকামনা
ছাইরাছ হেলাল
এত বিস্তারিত এই প্রথম জানলাম,
স্বাধীনতা পূর্বকালে আমাদের বাসায় সাধারণ মানের শতরঞ্জি আমরা ব্যাবহার করতাম।
পরে তা আর সংগ্রহ করা হয়নি। তবে এখন দেখেছি এর তো অনেক অনেক দাম, সাধারণের সাধ্যের বাইরে।
আমাদের পণ্য বিদেশে যাচ্ছে জেনে ভাল লাগল।
তথ্যের জন্য ধন্যবাদ।
আরজু মুক্তা
আসলেই অনেক দাম। তবুও অর্থনীতি সচল থাকে বলে, তাদের পরিশ্রমের জন্য আমরা গর্ব করতেই পারি।
ভালো থাকবেন সবসময়
তৌহিদ
পাইকারি দামে দিমুনে, নিবেন নাকি কন ভাইজান।
রোকসানা খন্দকার রুকু
খুব দাম, দেখতে সুন্দর এবং বিলাসবহুল বলা যায়। রাজা বাদশাদের ব্যবহারের বলেই হয়ত এমন ঐতিহ্য বহন করে।
অজানা অনেক জানা হল। শুভ কামনা🥰🥰
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ পড়ার জন্য। ভালো থাকবেন সবসময়
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আমাদের গ্রামের বাড়িতে শতরঞ্জি দেখেছি ছোট বেলায়। তবে এর ইতিহাস জানা ছিল না। ধন্যবাদ।
আরজু মুক্তা
শুভকামনা সবসময়
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
শুভেচ্ছা।
নবকুমার দাস
দারুণ তথ্যসমৃদ্ধ লেখা। ভালো লাগলো দিদিভাই ।
আরজু মুক্তা
আপনাদের ভালো লাগাতেই লেখার স্বার্থকতা।
শুভকামনা সবসময়
ফয়জুল মহী
মধ্যপাচ্যে শতরঞ্জির প্রচুর ব্যবহার হয়। সেখানে কাশ্মীর এবং তুর্কী শতরঞ্জি প্রচুর মার্কেট দখল আছে। আমাদের দেশের উন্নতমানের শতরঞ্জি তৈরি করে সেখানে রপ্তানির ব্যবস্থা করা উচিত
আরজু মুক্তা
নিশ্চয় সরকার এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিবে।
শুভকামনা মহি ভাই। অনেকদিন পর কমেন্ট করলেন। ভালো লাগলো
শামীনুল হক হীরা
অসাধারণ পোস্ট,,,বাংলাদেশে যদি সবজায়গায় এর ব্যাবহার হত ভাল হতো।।দারুণ লিখেছেন
শুভেচ্ছা জানবেন সতত।
আরজু মুক্তা
শুভকামনা ভাই। ব্যবহার বাড়লেই এর উৎপাদনও বাড়তো
সুপর্ণা ফাল্গুনী
শতরঞ্জি আমার খুব ভালো লাগে শুধু দামের কারণে কেনা সম্ভব হয়নি। অনেক কিছু জানলাম আপনার সুন্দর উপস্থাপনায়। এতো বিস্তারিত তথ্য জানানোর জন্য অফুরন্ত কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ আপু। শতরঞ্জির আরো উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি। দেশের অর্থনীতিকে আরো সমৃদ্ধ করুক। আপনার জন্য শুভকামনা ও শুভেচ্ছা
আরজু মুক্তা
অর্থনীতি চালু থাক এটাই কামনা।
শুভকামনা দিদি
রেজওয়ানা কবির
সত্যি খুব ভালো লাগে নিজ এলাকার এত সুন্দর শিল্প। আমার নানুবাড়ির পাশে এই শতরঞ্জিপাড়া।ধন্যবাদ আপু এই শিল্পকে তুলে ধরার জন্য।
আরজু মুক্তা
আপনাকেও ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
শুভকামনা সবসময়
জিসান শা ইকরাম
শতরঞ্জি রংপুরে তৈরী হয়!!
জানতামই না এই ইতিহাস।
রংপুর অঞ্চলে যাওয়া হয়নি কখনো, একবার যেতে হবে অবশ্যই। উত্তর বঙ্গে আমাদের সোনেলার ব্লগার অনেক, ব্লগীয় আড্ডা দেবো সবার সাথে।
অনেক ভালো পোষ্ট।
শুভ কামনা।
আরজু মুক্তা
আমার তো ভালো লাগছে, ইতিহাস জানালাম বলে।
রংপুর আসেন। বুঝবেন তারা কতোটা অতিথিপরায়ন। আমরা অপেক্ষায়।
শুভ ব্লগিং।
ভালো থাকবেন সবসময়
নার্গিস রশিদ
আরজু মুক্তা , রংপুরের শতরঞ্চি নিয়ে লেখাটা পড়ে খুব ভালো লাগলো । আরও অনেক উদ্যোক্তা এগিয়ে আসুক এর উৎপাদন আরও বাড়ুক । তিস্তার নদী ভাঙ্গা মানুষ খুব কষ্টে থাকে । তাদের কাজ হোক । কেমন যেন একটা গভীর টান আছে আমার রংপুরের মানুষের সাথে । এভাবে আরও অনেক লেখা আসা করবো আপনার কাঁচ থেকে ।
আরজু মুক্তা
রংপুরের প্রতি আপনার ভালোবাসা দেখে আমার ভালো লাগলো। কখনো আসলে বলিয়েন। চেষ্টা করি লেখার।
ভালো থাকবেন সবসময়
শুভ কামনা