এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার

রিমি রুম্মান ১৮ অক্টোবর ২০১৯, শুক্রবার, ০৫:১৭:৫১অপরাহ্ন সমসাময়িক ৮ মন্তব্য

প্রথম সন্তান জন্মের দুইমাস আগেই চাকুরিটি ছেড়ে দিয়েছিলাম শুধুমাত্র সন্তানকে মন উজাড় করে সময় দিবো বলে। তার সাথে গায়ে গা ঘেঁষে থাকবো বলে। আমার আর কাজে ফেরা হয়নি। হয়নি মানে আজ অব্দিও ফেরা হয়নি। সেই সময়ে প্রতিনিয়ত আধো আধো বোলে তাকে কথা বলা শিখতে, দাঁড়াতে, হাঁটতে শিখতে সাহায্য করছিলাম। আমরা মা-ছেলে গভীর এক মমতায় জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করছিলাম। চার বছর বয়সে যেদিন সে প্রথম স্কুলে যাওয়া শুরু করলো, সেদিনই প্রথম আমরা একে অপরের কাছ থেকে কিছু সময় আলাদা হয়েছিলাম। এবং অতটুকু সময়েই মনে হয়েছিল যেন অনন্তকাল আমরা একে অপরকে দেখিনি। মাকে ছেড়ে সেদিনই প্রথম এতটুকুন মানুষটির কোথাও যাওয়া। প্রথমবারের মতো সন্তানকে ছেড়ে কি ভীষণ অসহায় আর একাকি হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন, তা মনে করলে আজও বুকের ভেতরটা অদ্ভুত এক হাহাকারে মোচড় দিয়ে উঠে। এখনো খুব স্পষ্ট মনে আছে, খুব ভোরে তাকে তৈরি করে সাথে নিয়ে ছুটেছিলাম রুজভেল্ট এভিনিউ আর সেভেনটি সেভেন ষ্ট্রীটের প্রি স্কুলের দিকে। প্রথম দিন মাত্র দু'ঘণ্টার ক্লাস। স্কুলের সামনে রাজ্যের অভিভাবকের ভিড়। একে একে সব শিশুদের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। ছেলেটি আমার হাত ছেড়ে যেতে যেতে অশ্রু টলমল চোখে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, এটুকু মনে আছে। তারপর নিথর পাথর হয়ে কতক্ষণ গেটে দাঁড়িয়েছিলাম জানি না। একটা সময় তাকিয়ে দেখি আশেপাশে কেউ নেই। স্কুল গেটে আমি একা, বিচ্ছিন্ন কোন দ্বীপের ন্যায় একেবারেই একাকি ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। ভেতরে কোথাও যেন নাড়ি ছেঁড়ার ব্যাথা অনুভব করি। মনকে শক্ত করে ভাবি, মাত্র তো দুই ঘণ্টা, দেখতে দেখতেই চলে যাবে সময়। স্কুলের সামনে পার্ক করা গাড়িতে বসে থেকেছি কিছুক্ষণ। অতঃপর এপথ ওপথ ঘুরেছি অকারণে হন্যে হয়ে। লাইব্রেরীতে কিছু কাজ ছিল, বেমালুম ভুলে গিয়েছি। উদ্দেশ্যহীন এলোমেলো ড্রাইভ করতে করতে একটা সময় আবিষ্কার করি, আরে, এ যে ওরই স্কুলের আশেপাশে চক্রাকারে ঘুরছি আমি ! একপর্যায়ে সেভেনটি এইট ষ্ট্রীট ধরে যেতে যেতে আচমকা খেয়াল হল, ও পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষজন আমার গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। এমন করে কি দেখছে সকলে এই দিকে ! আমি চেতনে ফিরে আসি। এ যে ওয়ানওয়ে রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছি ! ভাগ্যিস কোন পুলিশের গাড়ি ছিল না সেখানে সেই মুহূর্তে। উল্টো দিক থেকেও কোন গাড়ি এসে পড়েনি। নইলে নির্ঘাত ঘটে যেতে পারতো কোন দুর্ঘটনা। স্কুলের সামনে রুজভেল্ট এভিনিউতে গাড়ি পার্ক করে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গিয়ে স্কুলগেটের বেল টিপি। একজন শ্বেতাঙ্গ নারী সামনে এসে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে জানতে চায় কেন এসেছি, কোন সমস্যা ! আমি ততোধিক বিস্ময় নিয়ে বলি, ছেলেকে নিতে এসেছি। সে আবারও জানতে চায়, কোন সমস্যা ? আমার জ্ঞান ফেরে। ডানে বাঁয়ে তাকাই। স্কুলের সামনে কোন অভিভাবকের ভিড় কিংবা জটলা নেই ! হাত ঘড়ির দিকে তাকাই। উফ্‌ মাত্র একঘণ্টা সময় পেরিয়েছে ! সরি বলে গাড়ির দিকে ফিরি। ওহ্‌ গড, ট্র্যাফিক এনফোর্সমেন্ট এজেন্ট ওইদিকে যাচ্ছে ! রুদ্ধশ্বাসে ছুটে গিয়ে গাড়িতে বসি। আমি যে পার্কিং মিটারে পয়সা দিতেও ভুলে গিয়েছিলাম ! এমন চেতন আর অবচেতনে কেটে গিয়েছিল সন্তানের সাথে ক্ষণিক বিচ্ছেদের সময়টুকু, তার স্কুল জীবনের প্রথম দিনটি। সেইদিন খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করি, মায়েদের মন বড় বেশি মায়ার মন। সন্তান চোখের আড়াল হলে অজানা আশংকায় বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠে, হাহাকার করে।

আমার বোন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়েও কোন চাকুরিতে যোগ দেয়নি পিঠেপিঠি দুই সন্তানকে মানুষ করবে বলে। সে চাকুরিতে যোগ দিলে, দিনের অধিকাংশ সময় বাহিরে থাকলে সন্তানদের আদর যত্নের কমতি হবে এই ভেবে জীবনের উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের কথা ভাবেনি। বিসর্জন দিয়েছে নিজের সমস্ত সাধ আহ্লাদ। সন্তানের কথা ভেবে পথে ঘাটের নানান রকম অঘটন আর অমঙ্গল আশংকায় ভীত থেকেছে সার্বক্ষণিক। অসুস্থ শরীরে এখনও পর্যন্ত সন্তানদের ভার্সিটিতে আনা নেয়ার কাজটি করে যাচ্ছে সেচ্ছায়। সন্তানরা বড় হয়েছে। তারা একাই আসা-যাওয়া করতে পারবে বলে বিরক্ত প্রকাশ করে। তাদের বন্ধুরা হাসাহাসি করে এতো বড় মেয়েদের এখনো মা ভার্সিটি পৌঁছে দেয় বলে। তবুও মায়ের মন বলে কথা। এ তো গেলো বোনের কথা। এবার আসি মায়ের কথায়। আমার এখনো খুব মনে আছে আমার মায়ের সেইসব দিনের কথা। আপার ভার্সিটির ক্লাস শুরু হয়ে যাবার ঠিক আগের কোন একদিন, যেদিন মাস খানেকের জন্যে বাসা ছেড়ে যেতো, সেদিন ওকে বিদায় দিয়ে এসে আম্মা বুকে বালিশ চেপে অঝোরে কাঁদতেন। কয়দিন মুখখানা এক আকাশ মেঘ করে থাকতেন। ভালোমন্দ রান্না করলেও খেতে চাইতেন না। বলতেন, আপাকে ছাড়া আপার পছন্দের খাবার গলা দিয়ে নামে না। আবার ছোট ভাইটাকেও হোস্টেলে রেখে এসে একইভাবে নিদারুণ কষ্ট পেতেন। দিনভর কাঁদতেন আর কোরআন তেলওয়াত করে প্রার্থনা করতেন সন্তানের মঙ্গল কামনায়। আমি যেহেতু সবার পরে বাসা ছেড়েছি পড়াশুনার উদ্দেশ্যে কিংবা হোস্টেলের উদ্দেশ্যে, তাই মায়ের এইসব বেদনাবিধুর সময়ের, সন্তানের সাথে সাময়িক বিচ্ছেদে হাহাকারের দিনগুলোর জ্বলজ্বলে সাক্ষী হয়ে আছি আজও।

সন্তানের বিষয়ে প্রতিটি মায়ের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য প্রায় একই।

অনাগত সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখানোর স্বপ্নে বিভোর প্রতিটি মা-ই জানেন যে, জন্মদানের মুহূর্তে তাঁর নিজের জীবন প্রদীপটুকু নিভে যাবার সম্ভাবনা কতখানি। তবুও কি তাঁর স্বপ্ন দেখা থেমে থাকে ? সন্তানের মুখখানা দেখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার মাঝেও যেন সুখ। জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত মায়েদের ত্যাগের কথা আর না-ই বলি। আবার নিরবে, নিঃশব্দে, নিভৃতে একজন বাবা সংসারের প্রয়োজনে দিনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেন অর্থ আয়ের পিছনে ছুটে। সন্তানের মুখে ভালোটা তুলে দিবেন বলে। পছন্দের জামাটা কিনে দিবেন বলে, কিংবা লেখাপড়ার সীমাহীন খরচ মিটাবেন বলে। নিজের সুখ আর সাধটুকু বিসর্জন দিয়ে নানান কায়দায় অর্থ সাশ্রয় করে সন্তানের জন্যে সুখ কিনেন বাবারা। এটাই শাশ্বত সত্য, প্রতিটি বাবা-মায়ের স্বপ্ন কিংবা সাধ, যা-ই বলি না কেন, সব তাঁদের সন্তানকে ঘিরে। বাবা-মায়ের বুকের গভীরে থাকে সন্তানের জন্যে অন্তহীন ভালোবাসা। সেই ভালোবাসার, আদরের কলিজার টুকরোকে যদি কেউ পিটিয়ে মেরে ফেলে, তবে যে কেবল তাঁকেই মেরে ফেলা হয় না। মেরে ফেলা হয় বাবা-মা'কেও, মেরে ফেলা হয় গোটা পরিবারকে। সর্বোপরি তাঁকে ঘিরে অনেকগুলো মানুষের স্বপ্নকে। হ্যাঁ আমি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের কথা বলছি। যাকে শিবির সন্দেহে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনের কতিপয় নেতারা নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। ক'দিন আগে খোদ রাজধানীতেই ছেলেধরা সন্দেহে স্কুলের সামনে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় একজন মা'কে। এভাবে কাউকে মেরে ফেলা যায় ? জীবন এতো ঠুনকো ? এ কোন অন্ধকার সময়ে বাস করছে আমার দেশের মানুষজন ? এ যে রাতের চেয়েও অন্ধকার সময় ! আমরা যারা জীবনের কঠিন বাস্তবতায় প্রিয় স্বজনদের ছেড়ে, দেশ ছেড়ে হাজার মাইল দূরে বাস করছি, প্রিয় মাতৃভূমিতে একের পর এক ঘটে যাওয়া এমন অনাকাংখিত ঘটনায় আমরা যারপরনাই ব্যথিত। স্বদেশ আর স্বদেশের মানুষজনের জন্যে আমাদের প্রার্থনা ব্যতীত আর কী-বা করার আছে !

রিমি রুম্মান
কুইন্স, নিউইয়র্ক
0 Shares

৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ